রেজি : ডিএ ৫১৭ ॥ ৬৩ বর্ষ : ৫ম সংখ্যা ॥ ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ॥ ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী ॥ ২৬ এপ্রিল ২০২৪

॥ প্রফেসর ড. আবদুল লতিফ মাসুম ॥
এ উপমহাদেশের ইসলামী জাগরণের অগ্রদূত, মুসলিম জাতিসত্তার রূপকার ও মহান মনীষার ধারক কবি-দার্শনিক আল্লামা ইকবাল ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। মুসলিম বিশ্বের এক দুঃসময়ে চিন্তার পুনর্গঠন ও মুসলমানদের জন্য একটি স্বাধীন-স্বতন্ত্র রাষ্ট্র নির্মাণে তিনি অনিবার্য় অনুঘটক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মূলত কবি, শিক্ষাবিদ, আইনবিদ এবং অবশেষে রাজনৈতিক দার্শনিক। আর সকলের মতো তিনি সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের আলোকে তার জীবন শুরু করেছিলেন। লিখেছিলেন ‘তারানা ই হিন্দ’। সেটি আজ ভারতের সমর-সংগীত। ভারতের প্রতি ইঞ্চি মাটি ছিল তার কাছে পরম পবিত্র। ১৯০৫ থেকে ১৯০৮ সালে ইউরোপে জাতিরাষ্ট্রের স্বরূপ অন্বেষণের পর জাতীয়তাবাদ তথা সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তার চিন্তার পরিবর্তন ঘটে। ইকবাল আধুনিক সভ্যতার তথা ইউরোপীয় জাতিসত্তার দ্বৈধতা বৈপরীত্য অনুভব করেন। পশ্চিমা ইতিহাসের মাত্রায় ধর্ম কীভাবে ধর্মহীনতার ভিত রচনা করে তা অনুধাবন করার অভিজ্ঞান লাভ করেন তিনি। যথার্থ মুক্তির সন্ধানে তিনি মার্কসবাদ ও লেলিনবাদ অধ্যয়ন করেন। বহুল নন্দিত লেলিন কবিতায় পরলোকগত এ বলশেভিকের জবানীতে তিনি বলছেন, ‘স্থাপত্য চাও তো দেখো ব্যাংকগুলোর দিকে/ধনিকের সৌধগুলো চার্চের চেয়ে ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন/ বাণিজ্য-নিশ্চয় আছে, বস্তুত সেটা জুয়ার খেলা। একজনের লাভে হাজার জনের মৃত্যু।’ (ফাহমিদ-উর-রহমান:২০১০:৬৪)। পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদ এবং সোভিয়েত সমাজতন্ত্রবাদ উভয়েরই অবাস্তবতা, অগ্রহণযোগ্যতা ও অসারতা উপলব্ধি করেন তিনি। এ ধারায় তিনি ইউরোপীয় দর্শন-গণতন্ত্র-রাজতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্র সবকিছুকেই নাকচ করেন। ইসলামী চিন্তার পুনর্গঠনের মাধ্যমে সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে তিনি ইসলামকে উপস্থাপন করেন। যে ধর্মকে নাকচ করার জন্য পুঁজিবাদ ও সমাজবাদ তাদের বৈপরীত্য সত্ত্বেও অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে তখন আল্লামা ইকবালের রাজনৈতিক দর্শন পৃথিবীকে এক নতুন আলোর সন্ধান দেয়। তিনি ‘তার অফুরন্ত চিন্তাশক্তি ও উদ্যম দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন একদিকে সর্বভুক আগ্রাসী পাশ্চাত্যের দাপাদাপি অন্য সম্প্রদায়ের রাষ্ট্রিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও তমদ্দুনিক নির্জীবতা, অবক্ষয় ও দূষণের মধ্যে এটিই হচ্ছে উত্তরণের একমাত্র পন্থা। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে মুসলমানের আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার নির্ভুল উপায়’। তাই তিনি লিখলেন, “রাজতন্ত্র কিংবা গণতন্ত্র যাই হোক না কেন? দ্বীন থেকে পৃথক হলে তা চেঙ্গেজীই হবে জেনো”।
সেই সময়ের রাজনৈতিক সংকটে নিপতিত গোটা মুসলিম বিশ্বকে নতুন গানে, নতুন জীবনে উদ্দীপ্ত করতে চেয়েছেন আল্লামা ইকবাল। তার উদ্দেশ্য পরাজিত পরাহত মিল্লাতে ইসলামিয়াকে নতুন আত্মপ্রত্যয় নতুন পরিচয় প্রদান। ইসলামী সাম্যের বন্ধনে আবদ্ধ দুর্জয় আত্মশক্তির উদ্ভাবন চেয়েছিলেন তিনি। চিন্তার পরিবর্তনের পর ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের তিনি দেখিয়েছিলেন নতুন পথ-অভিন্ন এক রাষ্ট্রিক সত্তা। আর এক মনীষী উইল ফ্রেড কান্ট ওয়েল তার এ পরিবর্তিত দর্শনকে বলেছেন, অভাবনীয় এবং মন্তব্য করেছেন স্যার সৈয়দ আহমদ খানের পর ভারতীয় ইসলামের জন্য এটা ছিল সবচেয়ে বর অবদান। (W. C Smith, Modern Islam India) কবির এ আবেদন কোনো ধর্ম বা গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং তা সকল মানুষের। তার ভাষায় ‘সকল তীর্থের সেরা তীর্থ হবে/প্রেমের ভিতর দিয়ে এ মানুষের মুক্তি আসবে”। ইকবাল দর্শনকে যথার্থভাবে অনুধাবন করলে বোঝা যাবে ‘তিনি দৃষ্টি দিয়েছিলেন উচ্চতর মূল্যবোধ আর মহত্তর চেতনার ওপরে প্রতিষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার দিকে। তিনি মনে করেছিলেন এ নতুন সমাজ ব্যবস্থার কাঠামো গড়ে দেবে ইসলাম। ইসলামের ভিত্তিতে তিনি মানব ঐক্যের এক স্বপ্ন দেখেছিলেন’। তারানা ই হিন্দ-এর কবি এবার লিখলেন তারানাই মিল্লি, ‘চীন ও আরব হামারা হিন্দুঁস্তা হামারা/মুসলিম হ্যাঁয় হম ওয়াতান হ্যাঁয় সারা জাহান হামারা’।
আল্লামা ইকবালের দর্শন, কাব্য ও কবিতায় আর একটি বিষয় ছিল অনন্য। আর তা ছিল ইসলামী সাম্যবাদ। আবুজার গিফারী ইসলামের যে সাম্য ও সত্যের কথা বলেছেন, তা আবারও ঘনিষ্ঠভাবে উচ্চারিত হয়েছে আল্লামা ইকবালের কবিতায় ও কাব্যে। কাব্যগ্রন্থ জাভিদনামায় তিনি লিখেছেন, ‘কোরআন কাকে বলে? সে হলো ধনিকের মৃত্যু পরোয়ানা/আর অন্নহারা যারা, সর্বহারা দাস, কুরআন আশ্রয় তার’। এ বিশ্বাস ও আদর্শ নিয়ে তিনি গোটা বিশ্বের মানুষের মুক্তি চেয়েছেন। নির্য়াতিত, নিপীড়িত ও অধঃপতিত মিল্লাতে ইসলামিয়ার স্বাধীনতা ও সক্ষমতার ভিত রচনা করতে চেয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন একমাত্র আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও রাসূলের আদর্শের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের শক্তির উৎস। তিনি দাবি করতেন মানবতার মুক্তির জন্য ইসলামরে কালজয়ী ভূমিকা নিরর্থক ও নিস্পন্দন হয়ে যায়নি। সমগ্র মানবজাতি যেখানে সমাজ রূপান্তরের নিরন্তর সংগ্রামে নিয়োজিত, সেখানে ইসলামও অভীষ্ট উদ্দিষ্টে নিবেদিত। তার ব্যাখ্যাটি এরকম, ‘I have selected the Islamic community as my starting point not because of my national or religious prejudice, but because it is the most practicable line of approach to the problem.’
এ উদ্যম ও উপলব্ধি শুধুমাত্র তার একার নয়। সেদিন ঔপনিবেশিক ভারে আক্রান্ত ইসলামী দুনিয়া জেগে ওঠার প্রয়াসে নিরন্তর আন্দোলনরত ছিল। আর এর ভিত্তিভূমি নির্মাণ করেছিলেন আরবের আব্দুল ওয়াহাব, দিল্লির শাহ ওলি উল্লাহ, রায় বেরিলির সৈয়দ আহমেদ শহীদ, ফরিদপুরের শরীয়তউল্লাহ, নারিকেলবাড়িয়ার নেছার আলী তিতুমীর। জামাল উদ্দিন আফগানীর প্যান ইসলামিজম বা নিখিল মুসলিম বিশ্ব চিন্তার ভিত নির্মাণ করে যাচ্ছিলেন আল্লামা ইকবাল। আলীগর আন্দোলনের স্যার সৈয়দ আহমেদের সমঝোতার পথে এগোননি তিনি। ইকবালের জাভিদনামায় ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে ইসলাম উজ্জীবনের আবেদন। জাতীয়তাবাদের রাষ্ট্র পরিচয়ের বাইরে ইসলামী বিশ্বের সাধারণ ঐক্যের তত্ত্ব দিয়েছিলেন তিনি। মিল্লাতে ইসলামিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি। ১৯০৯ সালে লাহোরের আঞ্জুমানে তিনি পাঠ করলেন শেকোয়া। আল্লাহর বিরুদ্ধে মুসলমানদের অভিযোগের দরখাস্ত। ১৯১০ আলীগড়ে গিয়ে তিনি ইসলামের সামাজিক ও রাজনৈতিক আদর্শ তুলে ধরেন। ১৯১৩ সালে লাহোরের মচিগেটে পেশ করলেন জওয়াবে শেকোয়া। শেকোয়া আর জওয়াবে শেকোয়া নিয়ে ইকবাল হয়ে উঠেছিলেন বিশ্ব মুসলিমের কবিকণ্ঠ। তাত্ত্বিকরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে দ্বি-জাতি তত্ত্ব পেয়েছে নতুন প্রাণ। রাজনীতি থেকে যখন ধর্ম বিতারণে পাশ্চাত্য প্রয়াশ অব্যাহত, তখন তিনি ইসলাম তথা ধর্মের জয়গান গেয়েছেন। ১৯২০ সালে আসরার-ই-খুদীর ইংরেজি অনুবাদ পাশ্চাত্যে আলোড়ন তোলে। তখন থেকেই বিকশিত হয় ইকবালের আন্তর্জাতিক পরিচয়। আসরার-ই-খুদীর পরে প্রকাশিত হয় রমুজে বেখুদী। এরপর তার আদর্শ ও বিশ্বাসের উচ্চারণ ঘটে জাভিদনামায়। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয় তার মূল্যবান দর্শনচিন্তা Reconstruction of Religious thought in Islam. এ মহাকাব্যে ইকবাল প্রত্যাখ্যান করেছেন ভাগ্যবাদী দর্শন। সুফিবাদের অপব্যাখ্যায় ইসলামকে মসজিদ ও মাদরাসায় সীমাবদ্ধ করার প্রয়াস এর বিরোধী ছিলেন তিনি। তিনি বলতে চেয়েছেন যে, জীবনবিমুখতা মানুষের অধঃপতনের সূচনা করে। ‘যখন সে মনে করে, ইহলৌকিক অস্তিত্ব এতই মায়া যে তার থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার মধ্যেই মুক্তি খুঁজে হতাশ ও অচেতন মন। পাশ্চাত্য বা প্রাচ্যের নিস্পৃহ দর্শন তার মগজে ভর করে। জীবনকে অস্বীকার করে পলায়নই মনোবৃত্তির বিরোধী ছিলেন তিনি। কবি চেয়েছিলেন ব্যক্তি ও সমাজে দৃশ্যমান নিষ্ক্রিয়তা ভাঙতে। নতুন সৃজনশীল ধারণার উজ্জীবন চেয়েছেন তিনি। তিনি এমন দর্শনের কথা বললেন যা মানুষকে সচল করে। মানুষের তেজ ও বিক্রমের কথা বেশি করে উচ্চারিত হয়। তার কবিতার ভাষায় ‘আমি আছি যে মুহূর্তে আমি গতিমান, যখন হারাই গতি সে মুহূর্তে আমি বিলীয়মান’। আসরার ই খুদীতে তিনি আত্ম নির্মাণের তিনটি ধাপের কথা বলেছেন, প্রথমটি হচ্ছে, আইনের প্রতি আনুগত্য। দ্বিতীয়টি, আত্মশাসন। তৃতীয়টি বিনাদ্বিধায় আল্লাহর প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব মেনে নেওয়া। আসরার ই খুদীর ১৭ বছর পর প্রকাশিত হয় জাভিদনামা। সেখানে তিনি দেখেন বিশ্বযুদ্ধের ঘনঘটা, সাম্রাজ্যবাদের আদিপত্য, ফ্যাসিবাদের অনাচার ও সমাজতন্ত্রের উগ্র উত্থান। তিনি বললেন, নিজের সামনে, সমাজের সামনে এবং আল্লাহর সামনে নিজেকে প্রকাশ করার মাধ্যমে মানুষ আত্মবিকাশ আর আত্মোজ্জীবনের পক্ষে বিকশিত হয়। এ পর্যায়ের ঈমানদারদের তিনি অভিহিত করেছেন ‘মর্দে মুমিন’ বলে। আত্মস্বার্থ আর ক্ষমতার স্বার্থকে নাকচ করেছেন তিনি। বলেছেন আত্মনির্মাণের কথা, নিজকে সমাজের সামনে নিবেদনের কথা এবং সমষ্টিগত আন্দোলনের কথা। তার দর্শন ছিল সুফিবাদ নয়, ভাববাদ নয়, জীবনবাদ। তার বক্তব্যের সারবস্তু হচ্ছে, বস্তু নয়, ভোগের তাড়না নয় পৃথিবী শাসন করবে ধর্ম। এ ধর্ম আচার সর্বস্ব হবে না, হবে কর্মশাসিত ধর্ম। একসময় মার্কসবাদের দিকেও ঝুঁকেছিলেন তিনি। মাঝখানে বলে রাখা ভালো যে যারাই ইসলামের সাম্য ও ন্যায়বিচারের কথা বলেছেন অনেকেই তাদের ভুলভাবে ইসলামী মার্কসবাদী বলেছেন। ইরানে যখন কমিউনিস্ট তুদেহ পার্টি আন্দোলনে শরিক ছিল, তখন তাকে পাশ্চাত্য ইসলামী মার্কসবাদী অভিধায় অভিহিত করতে চেয়েছে। কারণ ইসলামী আন্দোলনের লোকেরা ভূমি, ব্যাংক, খনিজ ও বড় বড় শিল্প জাতীয়করণের কথা বলেছে। ইকবালের ইসলামকে সর্বহারার মুক্তির পথ বাতলানোর প্রক্রিয়াকে অনেকে মার্কসবাদী প্রবণতা বলেছেন। তবে মূলত এটি ছিল ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার প্রতিরূপ। মুস্তাদআফিন বা সর্বহারার শব্দটি ইসলামী পরিভাষায় নতুন নয়। আল্লামা ইকবাল পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের প্রতিযোগিতায় ইসলামকে মধ্যম আদর্শ হিসেবে তুলে ধরেছেন। এখানে ‘কর্মের প্রণোদনা আছে ভোগের তাড়না নেই। জীবন আর জগতের বাস্তবতাকে ইসলাম অস্বীকার করে না। আবার ইসলাম অন্য ধর্মের মতো নয়, যা পৃথিবীকে মনে করে মায়া। ইসলাম বৌদ্ধের মতো মনে করে না নির্বানিই মুক্তি’। বরং ইসলাম বলে ‘লা রাহবাতাও ফিল ইসলাম-ইসলামে বৈরাগ্য নেই।’ রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এটি সমর্থিত হয়েছে এভাবে ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়’। ইকবাল তাই ভোগবাদী, নিয়ন্ত্রণবাদী, সর্বাত্মকবাদী ও সুফিবাদী সকলকে অস্বীকার করেছেন। ইসলামী চিন্তার পুনর্গঠন দর্শনে তিনি বলেছেন, কুরআনের মর্মবাণী নিয়তির ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। ইকবাল কোনো সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাম্প্রদায়িকতা দ্বারা ইসলামকে সীমিত করেননি। তিনি ইসলামকে দেখেছেন মানবতার ধর্ম হিসেবে। এক আন্তর্জাতিক সমাজশক্তি হিসেবে। ইকবাল ইসলামের সংস্কারের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। তিনি একালে ইসলামী ইজতেহাদের ধারণাকে নতুন দোতনা দান করেন।
আল্লামা ইকবাল শুধু কবি ও দার্শনিক ছিলেন না, তিনি অবিভক্ত উপমহাদেশের রাজনীতিতে দিক নির্দেশনা দান করেছেন। রাজমোহন গান্ধী তার প্রখ্যাত গ্রন্থ মুসলিম মাইন্ড এ ইকবাল কে একজন রাজনীতিবিদ এর চেয়েও জাতির দিক নির্দেশনাকারী বলেই অভিহিত করেছেন। ১৯২৬ সালে আল্লামা ইকবাল পাঞ্জাব আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৩০ সালে মুসলিম লীগের এলাহাবাদ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন। আর সেখানেই দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাস ভূমির। সভাপতির ভাষণে তিনি বললেন, ‘I would like to see the Punjab, Northwest Fortier Province, Sind and Baluchistan amalgamated in to a single state The formation of a consolidated North Western Indian Muslim state appears to me to be the final destiny of the Muslim, at least of North West India. ঐ ভাষণে পূর্বাঞ্চলের কথা না থাকলেও ১৯৩৭ সালে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে লিখিত এক পত্রে পূর্বাঞ্চলকেও স্বতন্ত্র আরেকটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অন্তর্ভুক্তির কথা বলেন। তার ভাষায়, Why should not the Muslims of North west India and Bengal be considered as nations entitled to self-determination. (এখানে এক জাতি নয়, এক রাষ্ট্র নয়, বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে।) এখানে তিনি পশ্চিম থেকে ১ হাজার মাইল দূরের বাঙালি মুসলমানকে নতুন করে পৃথক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। একই চিঠিতে তিনি ইসলামী নীতি বাস্তবায়নের জন্য ইসলামী ভূখণ্ডের ওপর জোর দেন। একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি ব্যতীত ইসলামী আদর্শে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। পরবর্তীকালে আরেকজন ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদীর কণ্ঠে একই কথা ধ্বনিত হয়। তার কথার মর্মার্থ ছিল এরকম- ভারত অখণ্ডিত বা খণ্ডিত হবে কিনা, সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে একখণ্ড ভূমি যেখানে আল্লাহর দীন অনুযায়ী দেশটি শাসিত হবে। দেওবন্দ ঘরানার প্রধান মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী অখণ্ড ভারতের পক্ষে ছিলেন। তিনি আল্লামা ইকবালের ধারণাকে নাকচ করেছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি কায়েদে আজমকে কাফেরে আজম বলেছিলেন। এ সময়ে আবারও আল্লামা ইকবাল জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে ইসলামকে ধারণ করেছেন। নেশন বা টেরিটরিকে নয়। আল্লামা ইকবাল উপমহাদেশের মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের সংকট (Crisis of Identity) দূর করেন। আত্মবিশ্বাস ও আত্মবিকাশের কথা তুলে ধরেন। অবশেষে নির্ভুলভাবে মুসলিম জনগোষ্ঠীর গন্তব্য দূরদর্শীর মতো নির্ণয় করেন। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ বলেন, ‘Iqbal gave Indian Islam a sense of separate destiny.(Vincent A. Smith, The Oxford History of India. Oxford and London: 1964). কবি শঙ্খ ঘোষ বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ যদি নতুন সভ্যতার বিন্যাসের কথা ভাবতে গিয়ে তপবনের ভারত বর্ষের বর্ণনা করতে পারেন, যদি পুরাণ বা উপনিশদের শ্লোকে আশ্রয় খোঁজেন বার বার- তখন কি তাকে সাম্প্রদায়িক ভাবি আমরা? তাহলে ইকবালই-বা কেন ভাবতে পারবেন না যে কুরআনের মধ্যেই থেকে গেছে অনেক সমাধান সূত্র।’
আল্লামা ইকবাল শতবর্ষ আগে এ উপমহাদেশের রাজনীতি, সমাজনীতি ও ধর্মনীতি নিয়ে যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও দর্শন দিয়েছেন, আজও তা জীবন্ত। মনে হয় এদিনের কথা ভেবেই তিনি দিয়েছিলেন দিক নির্দেশনা। তার দূরদৃষ্টি, তার স্বপ্ন সফল হয়েছে। ভারতের পশ্চিম অংশে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান। প্রাথমিক অবস্থায় পূর্ব ও পশ্চিম এক দেহে লীন হলেও পরবর্তীকালে লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে একটি স্বতন্ত্র-স্বাধীন আবাসভুমি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় পূর্ব ও পশ্চিম কোথাও আল্লামা ইকবালের আদ্দিষ্ট ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র পরিপূর্ণভাবে কায়েম হয়নি। আল্লামা ইকবালের সময়ে যে সমস্যা ও সমীকরণ তাড়িত করেছে, উপমহাদেশের জনগোষ্ঠীকে আজও সেই সংকটে নিপতিত কোটি কোটি মানুষ। তার তারানা-ই-হিন্দ-এর প্রিয় হিন্দুস্তান আজ সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে প্লাবিত। মুসলিম জনগোষ্ঠী আজও সেই চিরায়ত দ্বন্দ্বে বিভোর। দুটি মুসলিম ভুখণ্ডেই রয়েছে অনৈক্য অরাজকতা ও অবিশ্বাসের দেয়াল। সেদিন আল্লামা ইকবাল যে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন, ‘তোমার এক নবী, এক দীন, এক ঈমান, একটাই পুণ্য কাবা, এক আল্লাহ, এক কুরআন-তাহলে কেন সর্বত্র মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারো না?’ কবি নজরুল যেন কবি ইকবালের প্রতিধ্বনি করছেন, ‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান?’ আজকের বিশ্বে মুসলমানদের রাষ্ট্র আছে আদর্শ নেই, শাসন আছে সুশাসন নেই। অনৈক্যই মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংকট- এখানে অথবা সেখানে। দেশে অথবা বিদেশে। অভ্যন্তরে অথবা আন্তর্জাতিকভাবে- একই দৃশ্য সর্বত্র। অবশেষে নজরুলের ভাষায় প্রার্থনা, ‘দাও তওফিক দাও খোদা ইসলামে, মুসলিম জাঁহা পুনঃ হক আবাদ। দাও সেই হারানো সালতানাত। দাও ভাইয়ে ভাইয়ে সেই মিলন। সেই স্বার্থ ত্যাগ সেই দৃপ্ত মন। হোক বিশ্ব মুসলিম এক জামাত। উড়ুক নিশান ফের যুক্ত চাঁদ।’



অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।