রেজি : ডিএ ৫১৭ ॥ ৬৩ বর্ষ : ২য় সংখ্যা ॥ ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ॥ ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী ॥ ২৯ মাচ ২০২৪

॥ নাসির হেলাল॥
বাঙালি কবিদের মধ্যে কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) হলেন বিস্ময়কর প্রতিভাধর কবি। বাংলা সাহিত্যে অনেক কবি প্রতিভার দেখা মিললেও নজরুলের মতো অনন্য প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন হয়তো এক-আধজন কবি। মূলত তাঁর লেখালেখির শুরু মাত্র ২১ বছর বয়সে এবং শেষ মাত্র ৪২ বছর বয়সে। তিনি ১৯৭৬ সালে ইন্তেকাল করলেও ১৯৪২ সালে অসুস্থ হওয়ার পর আর কোনো লেখালেখি করতে পারেননি। অঙ্কের হিসাবে তাঁর লেখালেখির সময় মাত্র ২০-২১ বছর। এ ২০-২১ বছর বয়সে তিনি যা রচনা করেছেন, যা বাঙালি জাতিকে তথা বিশ্বকে দিয়ে গেছেন, তা দেখলে বিস্ময়ে ‘থ’ হয়ে থাকা ছাড়া পণ্ডিতজনদের কোনো গত্যন্তর থাকে না। একাধারে তিনি ছড়া, কবিতা, গান, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করেছেন। খবর, সম্পাদকীয় লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন। অপরদিকে গানের সুর দিয়েছেন, গান গেয়েছেন, অভিনয় করেছেন। আর সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তো সম্পূর্ণ নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছেন, নবযুগের জন্ম দিয়েছেন। তাঁর সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতাকে তিনি নতুন এক জীবন দান করেছেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নে জন্মগ্রহণকারী এ কবিকে আমরা শুধু বিদ্রোহী কবি হিসেবেই চিনি। অবশ্য কবিতার সাথে সাথে তিনি যে গানের মুকুটহীন সম্রাট সে কথাটাও কমবেশি জানি। কিন্তু তাঁর সাংবাদিক জীবন সম্বন্ধে স্কলারগণ জানলেও সাধারণ নজরুল ভক্তরা সেভাবে জানেন না। কারণ তাঁর সাংবাদিক জীবন ও সাংবাদিকতা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা বা লেখালেখি হয় না। অথচ তাঁর সাংবাদিক জীবনটা ছিল  অত্যন্ত বর্ণাঢ্য ও বিচিত্র।
নজরুল ইসলাম বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি। অবশ্য বাংলার হিন্দু-মুসলমানের পক্ষ থেকে কবিকে ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতা এলবার্ট হলে জাতীয়ভাবে সম্মাননা প্রদান করা হয়। এ অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তাঁকে দেয়া মানপত্রটি পাঠ করেন এস. ওয়াজেদ আলী। এর উত্তরে কবি একটি ‘প্রতিভাষণ’ দান করেন। কবির প্রতিভাষণের পর আবেগোচ্ছল কণ্ঠে নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু নজরুলের কবিতা ও গানের ভূয়সী প্রশংসা করে বক্তৃতা দেন।
কাজী নজরুল ইসলাম ১৯১৭ সালে সৈনিক হিসেবে ৩৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে যোগদান করেন এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এ যুদ্ধে অংশগ্রহণের সময়ে করাচিতে থাকাকালীন তিনি সাহিত্যকর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং লেখালেখি শুরু করেন। অবশ্য কিশোর বয়সে তাঁর পিতার ইন্তেকালের কারণে তাঁকে ওই অল্প বয়সে সংসারের হাল ধরতে হয়। সে সময় তিনি লেটো দলে যোগ দেন এবং কিছু গান ও নাটক রচনা করেন। সেই শিশু বয়সের লেখালেখি তাঁর পরবর্তী জীবনে সাহিত্য সাধনায় প্রভাব ফেলা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সৈনিক জীবনে করাচিতে থাকাকালে ১৯১৯ সালে তাঁর রচিত ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’ প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সওগাত’ পত্রিকায়। মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন সম্পাদিত এ পত্রিকাটি ছিল বাঙালি মুসলমানের পথিকৃত পত্রিকা।
কাজী নজরুল ইসলামের সব লেখালেখির মধ্যে প্রবলভাবে দ্রোহের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। সময়টা ছিল আন্দোলন-সংগ্রামে উত্তাল। ব্রিটিশ শাসনামলে উপমহাদেশের মানুষ ছিল ব্রিটিশদের চোখে জন্তু-জানোয়ারের মতো। শাসকশ্রেণির অত্যাচার, নির্যাতন টগবগে তরুণ কবি মেনে নিতে পারেননি কখনো। অন্যদিকে তাঁর স্বজাতি মুসলমানরা ছিল প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের থেকে অনেক পিছিয়ে। উপরন্ত তারা ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন। ইসলামের নামে তথাকথিত মোল্লা মৌলভীদের দৌরাত্ম্য এত বেশি ছিলো যে, তা সহ্য করা ছিল কঠিন। সব মিলিয়ে তরুণ কবি নজরুল যেন বোমার মতো ফেটে পড়লেন। তিনি ইংরেজ রাজশক্তির বিরুদ্ধে, পাশাপাশি সামাজিক অনাচার, অবিচার, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহ ঘোষণা করেন- কখনো লেখালেখিতে, কখনো ভাষণ-প্রতিভাষণে, কখনোবা সাংবাদিকতায়, সম্পাদকীয়তে।
ব্রিটিশ সরকার ১৯২০ সালে বেঙ্গলি রেজিমেন্টে ভেঙে দিলে কাজী নজরুল ইসলাম চলে আসেন কলকাতায়। কলকাতায় এসে তিনি প্রথমে ওঠেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের রমাকান্ত স্ট্রিটের বোর্ডিং হাউসে। এরপর তিনি মোজাফফর আহমদের      
৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের আস্তানায় গিয়ে ওঠেন। সময়টা ছিলো অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের উত্তাল সময়। মূলত এ সময়েই তাঁর লেখার শুরু। তিনি সওগাত, মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় লেখা শুরু করেন। ওই ১৯২০ সালের ১২ জুলাই সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগে’র যাত্রা শুরু হয়। পত্রিকাটি মোজাফফর আহমদ ও কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। যদিও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নাম সম্পাদক হিসেবে ছাপা হতো। এর আগে অবশ্য বিজলী, আত্মশক্তি, শঙ্খ, সংহতি, বঙ্গবাসীর মতো রেডিক্যাল পত্রিকা প্রকাশ হয়ে আসছিল। পত্রিকাগুলো শ্রমজীবী মানুষের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করতো। তবে কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় ‘নবযুগ’ ও ‘ধূমকেতু’ প্রকাশের পর সংবাদপত্র জগতে ভিন্ন মাত্রায় নবযুগের সূচনা হয়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সৈনিক স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এখান থেকে পায় বিদ্রোহের পর্যাপ্ত মাল-মশলা। নজরুলের করস্পর্শে পত্রিকাগুলো ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিতে সক্ষম হয়। নবযুগ, ধূমকেতু, লাঙল, গণবাণী, সেবক, সওগাত এসব পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করেছেন, সেখানে চাকরি করেছেন। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকাগুলো ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মুখোপত্র হিসেবে বিবেচিত হতো।
পত্রিকার নাম বাংলায় রাখা
সাধারণত সে সময়ে মুসলমান সম্পাদক সম্পাদিত পত্রিকার নাম আরবি, ফারসি, উর্দুতে রাখা হতো। যেমন- আজাদ, সওগাত, মোহাম্মাদী, আখবারে মোহাম্মাদী প্রভৃতি। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর পত্রিকার নাম দেন বাংলায়। যেমনÑ নবযুগ, ধূমকেতু, লাঙল, সেবক প্রভৃতি। আবার সংবাদের শিরোনাম দিতেন কবিতার লাইন উদ্ধৃত করে। যেমন কবি রবীন্দ্রনাথের গানের লাইনÑ ‘তোমারই গেহে, পালিছে স্নেহে/ আমি ধন্য ধন্য হে’- নজরুল এ থেকে শিরোনাম দিলেন, ‘তোমারই জেলে, পালিছ ছেলে/ আমি ধন্য ধন্য হে’। তিনি সম্পাদকীয় লিখতেন তাঁর মতো করে জ্বালাময়ী ভাষায়। আবার তিনি সম্পাদক শব্দের পরিবর্তে লিখেন ‘সারথি’ শব্দটি। এটা ছিলো সম্পূর্ণ নজরুলীয় স্টাইল।
নবযুগ : কলকাতার ৬ টার্নার স্ট্রিট (বর্তমানে নাম নবাব আবদুর রহমান স্ট্রিট) থেকে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ১৯২০ সালের ১২ জুলাই ‘নবযুগ’ পত্রিকাটি প্রকাশ করা শুরু করেন। পত্রিকাটি ছিল একটি সান্ধ্য দৈনিক। সম্পাদক হিসেবে হক সাহেবের নাম ছাপা হলেও পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন মোজাফফর আহমদ ও কাজী নজরুল ইসলাম। পত্রিকার ডিক্লেয়ারেশন ছিল মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর নামে।
‘নবযুগ’ পত্রিকার কোনো সংরক্ষিত কপি পাওয়া যায়নি। অবশ্য এর সাইজ ২০ ইঞ্চি বাই ২৬ ইঞ্চি ছিল বলে জানা গেছে। হ্যান্ড কম্পোজের এ পত্রিকার প্রতি কপির মূল্য ছিল মাত্র এক পয়সা। পত্রিকাটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে খোদ মোজাফফর আহমদ তাঁর ‘স্মৃতিকথা’য় লিখেছেন, ‘১৯২০ সালের ১২ জুলাই কাজী নজরুল ইসলাম ও আমার সম্পাদনায় ‘নবযুগ’ বার হলো। নিশ্চয়ই নজরুলের জোরালো লেখারগুণে প্রথম দিনেই কাগজ জনপ্রিয়তা লাভ করলো। দৈনিক কাগজে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাদের একজনেরও ছিল না। নজরুল ইসলাম কোনোদিন কোনো দৈনিক কাগজের অফিসেও ঢোকেনি। তবুও সে বড় বড় সংবাদগুলো পড়ে সেগুলোকে খুব সংক্ষিপ্তাকারে নিজের ভাষায় লিখে ফেলতে লাগলো। তা না হলে কাগজে সংবাদের স্থান হয় না। নজরুলকে বড় বড় সংবাদের সংক্ষেপণ করতে দেখে আমরা আশ্চর্য হয়ে যেতাম। ঝানু সাংবাদিকরাও এ কৌশল আয়ত্ব করতে হিমশিম খেয়ে যান। তারপরে নজরুলের দেওয়া হেডিং-এর জন্য ‘নবযুগ’ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
উক্ত উদ্ধৃতিতে যে বড় বড় সংবাদের কথা বলা হয়েছে তা সকালে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিকে বের হতো। তা থেকে নির্বাচিত সংবাদ বাংলায় খুব সংক্ষেপ করে পুনঃপ্রকাশ করা হতো। ‘নবযুগে’র হেডিং-এর বিষয়ে তৃণা মিত্র ঘোষ লিখেছেন, ‘দৈনিক নবযুগ’ পত্রিকার জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ ছিল নজরুলের দেওয়া শিরোনাম। এ শিরোনামগুলো ছিল পাণ্ডিত্যে, বৈদগ্ধে সমৃদ্ধ। শিরোনামে বৈচিত্র্য আনতে তিনি লোক সাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, এমনকি রবীন্দ্রনাথের রচনারও দ্বারস্থ হয়েছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার পংক্তি ভেঙে নতুন শিরোনাম রচনা করেছিলেন। যেমন-
১. ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
     পরান সখা ফৈসুল, হে আমার।’
বা,
২. ‘কালোতে ধলাতে লেগেছে এবার
     মন্দ মধুর হাওয়া।
      দেখি নাই তবু দেখি নাই ওগো,
       এমনি ডিনার খাওয়া।’
প্রসঙ্গক্রমে বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের কবিতার লাইনও এসে পড়ত। ব্রাত্যজনের পক্ষ নিতে হবে, এ বোধ নজরুলের জীবনের অভিজ্ঞান ছিল। ‘নবযুগ’-এ তাই শ্রমিকের, কৃষকের, সংখ্যালঘুর স্বর জোরালো হয়ে উঠেছিল প্রথম থেকেই। ‘নবযুগে’র নজরুল তাই ভেদাভেদহীন এক অসাম্প্রদায়িক স্বর গড়ে তোলার চেষ্টা করেন স্বল্প সময়েই। নাম প্রবন্ধটিতেই নজরুল লেখেন-‘এসো ভাই হিন্দু! এসো  মুসলমান! এসো বৌদ্ধ! এসো ক্রিশ্চিয়ান! আজ আমরা সব বন্দিত্ব কাটাইয়া, সব সংকীর্ণতা, সব মিথ্যা, সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়া, ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি।’ ( মাসান্তিক নতুন গতি, ১৪ বর্ষঃ পঞ্চম সংখ্যা, নজরুল সংখ্যা, মে ২০২৩, ৮৮ তালতলা লেন, কলকাতা)।
‘নবযুগে’ কৃষক শ্রমিকদের কথা লেখা হতো। জ্বালাময়ী ভাষায় নজরুল ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে লিখতেন। ফলে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার পত্রিকা কতৃপক্ষকে সতর্ক করা হয়। ১৯২০ সালে যখন শ্রমিক ধর্মঘট চলছিল তখন নজরুলের ‘মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে?’ প্রবন্ধটি ছাপা হয়। এরপরই পত্রিকাটি ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়ে। জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। এসব নানা কারণে হক সাহেবের সাথে নজরুলের মতবিরোধ দেখা দেয়। একপর্যায়ে ১৯২০ সালের ডিসেম্বরে তিনি ‘নবযুগ’ ছেড়ে দেন।
দৈনিক সেবক
মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ১৯২১ সালের ১ ডিসেম্বর ‘দৈনিক সেবক’ নামে একটি পত্রিকা বের করেন। ‘নবযুগ’ ছাড়ার পর কিছুদিন কুমিল্লায় কাটিয়ে কলকাতায় ফিরে নজরুল ‘দৈনিক সেবকে’ যোগ দেন। ১০ ডিসেম্বর সংখ্যায় ‘অগ্রসর’ শিরোনামে সরকারবিরোধী সম্পাদকীয় প্রকাশের দায়ে পত্রিকাটি নিষিদ্ধ হয় এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪ ধারায় উক্ত সম্পাদকীয় লেখার অজুহাতে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁকে গ্রেফতার করা হয়।
কিছুদিন পর অবশ্য পত্রিকার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে ‘দৈনিক সেবকে’র জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারের জন্য কাজী নজরুল ইসলাম ও আবুল কালাম শামসুদ্দিন প্রমুখকে নিয়োগ দেওয়া হয়। নজরুল এখানে একশত টাকা বেতন পেতেন। কিন্তু কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যুর পর তার স্মরণে একটি সম্পাদকীয় লেখেন। পত্রিকার পলিসি মোতাবেক মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী ও আবুল কালাম শামসুদ্দিন সম্পাদকীয়টি কাটছাট করে প্রকাশ করেন। স্বাধীনচেতা নজরুল ইসলাম বিষয়টি মোটেই মেনে নিতে পারেননি। তাই ডাকযোগে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। এরপর ১৯২২ সালের আগস্ট মাসে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।
ধূমকেতু
১৯২২ সালের ১১ আগস্ট ‘ধূমকেতু’ প্রথমে অর্ধ-সাপ্তাহিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কবি নিজেই পত্রিকার নামকরণ করেন। আফজালুল হক মুদ্রাকর ও প্রকাশক হিসেবে পত্রিকার ডিক্লেয়ারেশন নেন। ৩২ নম্বর কলেজ স্কয়ারে ‘ধূমকেতু’র দপ্তর ছিল। পত্রিকাটি ৭৯ নম্বর বলরামদে মেটকাফ প্রেস থেকে প্রকাশিত হতো। ক্রাউনফলিও সাইজের ৮ পাতা পত্রিকাটির প্রতি কপির মূল্য ছিলো মাত্র এক আনা। বার্ষিক চাঁদা ছিল ৫ টাকা। পত্রিকার সম্পাদক বা সারথি ছিলেন কবি নজরুল ইসলাম। নিজস্ব স্টাইলে কবি নজরুল সম্পাদককে ‘সারথি’ নামে অবিহিত করেন।
‘ধূমকেতু’র প্রথম সংখ্যায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাণী-
কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু,
‘আয় চলে আয়রে ধূমকেতু,
আঁধারে বাঁধ অগ্নি সেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষণের তিলক রেখা,
রাতের ভালে হোক্ না লেখা
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে,
আছে যারা অর্দ্ধচেতন।’
‘ধূমকেতু’তে লিখতেন সে সময়কার সেরা লেখকগণ-
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, হুমায়ুন কবীর, শিবরাম চক্রবর্তী, অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত, প্রবোধচন্দ্র সেন, হেমেন্ত কুমার রায়, বলাইদেব শর্মা, বীরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন  প্রমুখ। স্বাধীনতার দাবি ছিল ‘ধূমকেতু’র মূলমন্ত্র। নজরুল ‘ধূমকেতু’ প্রকাশের উদ্দেশ্য প্রথম সংখ্যায় জানিয়ে দিয়েছিলেন-
‘ধূমকেতু’ কোনো সাম্প্রদায়িক কাগজ নয়। মনুষ্যধর্মই সবচেয়ে বড় ধর্ম। হিন্দু মুসলমান মিলনের অন্তরায় বা ফাঁকি, কোনখানে তা দেখিয়ে দিয়ে এর গলদ দূর করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য।’
যখন কংগ্রেসের দাবি ছিল শুধুমাত্র স্বরাজ, ঠিক তখনই ‘ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করে। নজরুল ইসলাম ১৯২২ সালের ১৩ অক্টোবর সংখ্যায় ‘ধূমকেতুর পথ’ শিরোনামের লেখায় লেখেন-
‘সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।’ ... স্বরাজ-টরাজ বুঝি না। কেননা ও-কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ‘ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশ বিদেশিদের অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসনভার, সব থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনো বিদেশিদের মোড়লি করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না।’
তিনি আরও লেখেন, ‘পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে, সকল কিছু নিয়মকানুন বাঁধন-শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে।’
বাংলা চলিত ভাষায় প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা ‘ধূমকেতু’কে নজরুল নিজের মনের মতো করে অন্যায়-অবিচার, শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে যেমন তেজোদ্দীপ্ত ভাষায় লিখে ব্রিটিশ সরকারের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন; অপরদিকে পত্রিকাটিকে নিজের মতো করে সাজিয়েছিলেন। যেমন- ‘পরদেশপঞ্জি’ নামে বিভাগটিতে পররাষ্ট্রবিষয়ক লেখা ছাপা হতো। ‘মুসলিম জাহান’ নামক বিভাগে মুসলিম বিশ্বের খবরাখবর থাকতো। ‘দেশের খবর’ বিভাগটিতে দেশীয় রাজনীতির খবর প্রকাশ হতো। মহিলাদের জন্য ছিল ‘সান্ধ্যপ্রদীপ’ নামে একটি বিভাগ। ‘অগ্নি সম্মার্জনী’ নামক বিভাগে থাকতো রাজনৈতিক পর্যালোচনা।
‘ধূমকেতু’র ঝড়ো তাণ্ডবে ব্রিটিশ সরকার প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়। আত্মরক্ষার জন্য সরকার মাত্র এক মাসের মাথায় ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর লীলা মিত্রের লেখা ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ত’ প্রবন্ধ এবং  কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘আনন্দময়ীর আগমন’ শিরোনামের কবিতা প্রকাশের অজুহাতে ওই সংখ্যাটি নিষিদ্ধ করে। উক্ত সংখ্যাটির কারণেই কবি নজরুলকে ২৩ নভেম্বর পুলিশ কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করে। বিচারে নজরুলের এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। কবি জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন ১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর।
লাঙল ও গণবাণী
‘লাঙল’ পত্রিকাটির আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯২৫ সালের ১৫ নভেম্বর। জেল থেকে বের হয়ে নজরুল কংগ্রেসের অঙ্গ সংগঠন লেবার স্বরাজ পার্টিতে যোগদান করেন। এমনকি লেবার স্বরাজ পার্টির ইশতেহার নজরুলই রচনা করেন, যা লাঙলে প্রকাশিত হয়। এটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল। ‘লাঙলে’র প্রধান পরিচালক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নাম ছাপা হতো নজরুলেরই সৈনিক জীবনের বন্ধু মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের। কিন্তু সম্পাদনার দায়িত্ব নজরুলই পালন করতেন। পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে বলে দেওয়া হয়েছিল, ‘বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের কবিতা প্রতি সংখ্যায় ছাপা হবে।’ সে মোতাবেক প্রথম সংখ্যাতে ছাপা হয় ‘সাম্যবাদী’ কবিতাটি। কবিতাটির জনপ্রিয়তার কারণে লাঙলের ওই সংখ্যাটির ৫ হাজার কপি মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিক্রি হয়ে যায়। পরে লাঙলের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যায় ছাপা হয় ‘কৃষকের গান’ ও ‘সব্যসাচী’ কবিতা দুটি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘লাঙল’ পত্রিকাকেও আশীর্বাণী পাঠান। মানবেন্দ্রনাথ রায় বিদেশ থেকে ‘লাঙলে’র দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যায় ‘লাঙল’ ও নজরুলের ভূমিকা প্রসঙ্গে আলোচনা করেন। ১৯২৬ সালের আগস্ট মাসে ‘লাঙলে’র নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘গণবাণী’। এ সময় কাগজের দায়িত্বে আসেন মোজাফফর আহমদ। ১৯২৭ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ পত্রিকায় নজরুল নিয়মিত লেখালেখি করেন। ১৯২৬ সালের ২৬ আগস্ট সংখ্যায় দাঙ্গার পটভূমি সামনে রেখে ছাপা হয়েছিল নজরুলের ‘মন্দির ও মসজিদ’ এবং পরের সংখ্যায় ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধ দুটি।
অন্যান্য পত্রিকা
‘লাঙল’ পত্রিকা ছাড়ার পর ১৯২৭ সালের নভেম্বরে তিনি ‘সওগাত’ পত্রিকায় যোগ দেন। এখানে তিনি দীর্ঘ চার বছর চাকরি করেন। সাংবাদিক জীবনে ‘সওগাত’ পত্রিকায় নজরুল বেশি সময় ছিলেন।
‘নবযুগ’ পত্রিকাটি দীর্ঘদিন পর নবরূপে ১৯৪১ সালের অক্টোবরে পুনঃপ্রকাশিত হয়। এবার এটি সান্ধ্য দৈনিকের জায়গায় প্রভাতী দৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর প্রথম। সংখ্যায় ‘নবযুগ’ নামে নজরুলের একটি কবিতা ছাপা হয়। কিন্তু নজরুলের ‘নবযুগে’ যোগদানকে মুসলিম লীগ পন্থীরা ভালোভাবে নিতে পারেনি। বরং তারা বেশ ক্ষুব্ধ হয়। বিষয়টি বুঝতে পেরে নজরুল তাদের উদ্দেশ্য করে লেখেন, ‘আমার লীগ কংগ্রেস’ নামে প্রবন্ধ। এছাড়া ১৯৪২ সালের ২ জুলাই প্রকাশিত হয় ‘আমার সুন্দর’ নামে অন্য আর একটি প্রবন্ধ। উল্লেখ্য যে, ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই পর্যন্ত নজরুলের সম্পাদনায় ‘নবযুগ’ প্রকাশিত হয়। আর ১৯৪৩ সালে ‘নবযুগ’ বন্ধ হয়ে যায়। ‘নবযুগ’ পত্রিকা দিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয়, আবার সেই ‘নবযুগ’ পত্রিকা দিয়েই তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের ইতি ঘটে।
কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব ধূমকেতুর মতো। আসলেন জয় করলেন, আবার চলে গেলন। আকাশে বিদ্যুৎ চমকানোর মতো নজরুল কবিতা, গান, সাংবাদিকতা সকল ক্ষেত্রেই পাঠককে চমকে দিয়েছেন। বিদ্রোহ ছিল তাঁর অস্থি মজ্জায়। তিনি সকল প্রকার কুসংস্কার, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাঁর কলম চালিয়েছেন। সাথে সাথে শাসকশ্রেণির অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। গদ্যে-পদ্যে, ভাষণ-অভিভাষণ-প্রতিভাষণ, সাংবাদিকতা, সম্পাদকীয় সকল ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠের প্রতিবাদী। তিনি যা বিশ্বাস করতেন তা শতকণ্ঠে উচ্চারণ করতেন। সরকারের রক্তচক্ষু, জেল-জুলুম, অত্যাচারকে তিনি থোড়াই কেয়ার করতেন। অসাম্প্রদায়িক কবি ব্যক্তিত্ব কাজী নজরুল কোনো সম্প্রদায়ের রক্তচক্ষুকে কখনো ভয় পাননি। মাত্র ২১ বছর বয়সের একজন তরুণ যেভাবে সাংবাদিকতার জগতে টাইফুনের গতিতে প্রবেশ করে সবকিছু উলটপালট করে দেন তা সত্যি সত্যিই বিস্ময়কর, অচিন্তনীয়।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি : ১. নজরুলের সাংবাদিক জীবন -মু. জাহাঙ্গীর। ২. সাংবাদিকতায় নজরুল - অনুপম হায়াৎ। ৩. কাজী নজরুল ইসলাম; স্মৃতিকথা -মোজাফফর আহমদ। ৪. নজরুল জীবনী- রফিকুল ইসলাম। ৫. নজরুল ইনস্টিটিউট পত্রিকা, একচল্লিশতম সংখ্যা, ঢাকা। ৬. নজরুল একাডেমি পত্রিকা, ৫৫ বর্ষ; সাতচল্লিশ সংখ্যা, ঢাকা। ৭. মাসান্তিক নতুন গতি # ১৪ বর্ষঃ ৫ম সংখ্যা (নজরুল সংখ্যা), মে ২০২৩, কলকাতা।



এ পাতার অন্যান্য খবর

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।