রেজি : ডিএ ৫১৭ ॥ ৬৩ বর্ষ : ২য় সংখ্যা ॥ ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ॥ ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী ॥ ২৯ মাচ ২০২৪

॥ মুহাম্মদ নূরে আলম ॥
বিংশ শতাব্দীতে এ উপমহাদেশে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রাহি.) ছিলেন একজন প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক। তাঁর ইসলামী দর্শনভিত্তিক সাহিত্য ও তাফসির বিশ্বে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে ব্যাপক হারে প্রশংসিত ও সমাদৃত হয়ে আসছে। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রাহি.) বিংশ শতাব্দীর প্রভাবশালী চিন্তকদের অন্যতম। খেলাফত পতন পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থায় ইসলামী পুনর্জাগরণ দৃষ্টিতে তিনি অনবদ্য অবদান রেখেছেন। দেশে দেশে ইসলামী পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলনসমূহে তাঁর লেখনী ও চিন্তাদর্শনের প্রভাব ব্যাপক। মুসলিম বিশ্বে ইসলামী পুনর্জাগরণ প্রশ্নে ওস্তাদ মওদূদীর সাহিত্য, চিন্তা ও দর্শন ব্যাপকভাবে প্রাসঙ্গিক।
যে সকল ক্ষণজন্মা মনীষী ঘুমন্ত মুসলিমদের জাগরণ ঘটিয়ে ইসলামকে সমুন্নত করেছেন, তাদের একজন হলেন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রাহি.)। ঐতিহাসিক পর্যালোচনায় স্পষ্টত সাংবাদিক জীবন ও রাজনৈতিক জীবন থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত জীবন পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রেই সফলতার এক দুর্লভ ক্ষেত্র তৈরি করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার ইসলামী রাজনীতিতে ‘ইসলামে রাজনীতি আছে’ বিষয়টি তিনিই প্রথম প্রমাণ করার প্রয়াস চালিয়েছেন। যখন দিশেহারা মুসলিম উম্মাহ নেতৃত্ব সংকটে ভুগছিলেন, এমনই সময়ে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের হায়দরাবাদ রাজ্যের (বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশ) আওরঙ্গাবাদ শহরে ১৯০৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আবুল হাসান মওদূদী ছিলেন প্রসিদ্ধ আইন ব্যবসায়ী। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় ছোটবেলা থেকেই বালক মওদূদীর নির্মল হৃদয়ে ইসলামের বীজ দানা বাঁধতে শুরু করে। এক্ষেত্রে তাঁর পিতার নিবিড় তত্ত্বাবধান ও মাতা রোকেয়া বেগমের স্নেহের পরশ ছিল সার্বক্ষণিক অনুষঙ্গ। পিতার একান্ত ইচ্ছা ছিল ছেলেকে বড়মাপের আলেম বানাবেন। সেই অনুযায়ী তাঁর লেখাপড়া শুরু হয়। বাল্যকালের ৯ বছর পর্যন্ত বাড়িতেই গৃহশিক্ষকের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর তিনি আওরঙ্গাবাদে ফোরকানিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ১৯১৬ সালে তার পিতা তাকে হায়দরাবাদ দারুল উলুম মাদরাসায় ভর্তি করে দেন উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে। কিছুদিন পর তাঁর পিতা অসুস্থ হয়ে গেলে তিনি তাঁর পিতাকে নিয়ে ভুপালে চলে যান এবং সেবা শুশ্রুষায় লেগে যান। ১৯২০ সালে তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। মূলত ওস্তাদ মওদূদী পিতার ইন্তেকালের পর তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষ হয় এবং পারিবারিক অর্থ সংকট নিরসনের জন্য সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। জ্ঞান অর্জনের অদম্য ইচ্ছা থেকে ওস্তাদ মওদূদী সাংবাদিকতার পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে যান।
ওস্তাদ মওদূদীর সাংবাদিকতা জীবন: অধ্যয়নের প্রতি ছোটবেলায় মওদুদীর যেমন আকর্ষণ ছিল, লেখালেখির প্রতিও ছিল প্রবল আগ্রহ। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। পিতার মৃত্যুর পর ১৫ বছর বয়সেই সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন পারিবারিক ব্যয় নির্বাহ করার জন্য। তাঁর বড় ভাই সাইয়েদ আবুল খায়ের মওদূদী বিজনৌর (ইরলহড়ৎব) থেকে প্রকাশিত আল মাদীনা পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন। তরুণ আবুল আ’লা মওদূদীও সম্পাদকীয় স্টাফের একজন সদস্য হিসেবে আল মাদীনা পত্রিকায় যোগদান করেন। পাশাপাশি খেলাফত আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯১৮ সালে জবলপুরের জনৈক তাজউদ্দীন সাপ্তাহিক তাজ নামে একটি পত্রিকা বের করেন। সাইয়েদ আবুল খায়ের ও সাইয়েদ আবুল আ’লার ওপর এর সম্পাদনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারণে কয়েক মাস পরই পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে হয়। এ সময় তাঁরা কিছুকাল ভুপালে অবস্থান করে আবার দিল্লি আসেন। দিল্লিতে অবস্থানকালে সাইয়েদ আবুল আ’লা ইংরেজি ভাষা শেখেন। তিনি গভীর মনোযোগের সাথে ইংরেজি ভাষায় লিখিত দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ-বিজ্ঞানের বই-পুস্তক পড়তে থাকেন।
‘তাজ’ ও ‘মুসলিম’ পত্রিকার সম্পাদক ওস্তাদ মওদূদী : ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ শাসিত উপমহাদেশের মুসলিমরা ওসমানী খেলাফাতের অখণ্ডতা অক্ষুণ্ন রাখার দাবিতে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে। এই আন্দোলনেরই নাম খেলাফাত আন্দোলন। এ আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জওহর ও তাঁর ভাই মাওলানা শওকাত আলী। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তরুণ ব্যারিস্টার হুসাইন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯১৮ সনে গঠিত জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ খেলাফাত আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায়। আরো সমর্থন জানায় অল ইন্ডিয়া ন্যাশনাল কংগ্রেস। প্রবল বেগে এগোচ্ছিল খেলাফাত আন্দোলনের জোয়ার। এ প্রেক্ষাপটে তাজউদ্দীন সাহেব ১৯২০ সনে জবলপুর থেকে আবার সাপ্তাহিক তাজ পত্রিকার প্রকাশনা শুরু করেন। ১৯২০ সনের শেষভাগে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী দিল্লিতে চলে আসেন। ১৯২১ সালে তিনি  জবলপুরে ‘তাজ’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র সতর বছর। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী সাপ্তাহিক তাজ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে চলমান রাজনীতির দিকে তীক্ষ দৃষ্টি রাখছিলেন। খেলাফত আন্দোলনের জোয়ার তখন জবলপুরেও পৌঁছে। তিনি আন্দোলনের বিভিন্ন তৎপরতার সাথে জড়িত হন। জবলপুরে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন জনসভায় তরুণ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীকে বক্তৃতা দিতে হয়। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর নিরলস প্রচেষ্টায় সাপ্তাহিক তাজ পত্রিকাটি দৈনিক তাজে উন্নীত হয়। কিন্তু দৈনিক তাজ বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনি। তাজ পত্রিকায় ওস্তাদ মওদূদীর লেখায় তত্ত্বজ্ঞান, বিচক্ষণতা, মানুষের মনে ইসলামের জাগরণ সৃষ্টি করার নিপুণ দক্ষতা ছিল লক্ষ করার করার মতো। পথহারা মুসলিমদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে লেখনী চালিয়ে যান। একবার একটি প্রবন্ধে তিনি ইংরেজদের জুলুম-নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন, যার আক্রোশে ক্ষুব্ধ হয়ে ইংরেজ সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়।
জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ‘মুসলিম’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশনার উদ্যোগ নেয়। ১৯২২ সালে দিল্লিতে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি মাওলানা আহমদ সাঈদ ও মুফতি কেফায়ত উল্লাহর অনুরোধে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের মুখপত্র ‘মুসলিম’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন আবুল আ’লা মওদূদী। ১৯২২ সালে ‘মুসলিম’ পত্রিকায় সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে তিনি লেখালেখি চালিয়ে যান। ১৯২৩ সনে ‘মুসলিম’ পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ভুপাল চলে যান। কিছুকাল পর তিনি আবার দিল্লি ফিরে আসেন। ওস্তাদ মওদূদীর সাংবাদিকতা জীবনে লেখালেখির মাঝে তিনি লক্ষ করলেন, ইসলামী জ্ঞানের বহু জগৎ এখনো তাঁর কাছে অজানা রয়ে গেছে। তাই তিনি যখন ১৯২১ সালে দিল্লিতে আসেন, তখন থেকেই সাংবাদিকতার পাশাপাশি হাদীস, তাফসির, ফিকাহসহ অন্যান্য ইসলামী বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন এবং ইংরেজি ভাষা শিক্ষা লাভ করেন।
১৯২৪ সালে পুনরায় ‘আল-জমিয়ত’ নামে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের মুখপত্রের প্রকাশনা শুরু হয়। ১৯২৫ সালে সাইয়েদ মওদূদীকে আবার ‘আল-জমিয়ত’-এর সম্পাদক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯২৮ সাল পর্যন্ত টানা দায়িত্ব পালনের পর জমিয়ত কর্তৃপক্ষের সাথে জাতীয়তার প্রশ্নে মতবিরোধ হলে তিনি পদত্যাগ করেন। চার বছর বিরতির পর ১৯৩২ সালে মাসিক ‘তরজুমানুল কুরআন’ প্রকাশনার মধ্য দিয়ে পুনরায় সাংবাদিকতায় জড়িত হন।
দিল্লিতে অবস্থানকালে পত্রিকা সম্পাদনার ফাঁকে ফাঁকে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী প্রখ্যাত আরবী ভাষাবিদ মাওলানা আবদুস সালাম নিয়াযীর কাছে আরবী ভাষা শিখতে থাকেন। তিনি ছিলেন দারুণ পরিশ্রমী। তিনি আল কুরআনের তাফসির, আল হাদীস, আল ফিক্হ ও অন্যান্য বিষয় ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন করেন। তরুণ বয়সেই তিনি ইসলামী জীবনদর্শন ও জীবনবিধানের একজন সুপণ্ডিতরূপে গড়ে ওঠেন। ১৯২৬ সালে দিল্লির ‘দারুল উলুম ফতেহপুরি’ থেকে ‘উলুম-এ-আকালিয়া ওয়া নাকালিয়া’ সনদ লাভ করেন। ১৯২৮ সালে উক্ত প্রতিষ্ঠান (দারুল উলুম ফতেহপুরি) থেকে ‘জামে তিরমিযী’ এবং ‘মুয়াত্তা ইমাম মালিক’ সনদ লাভ করেন।
ওস্তাদ মওদূদীর কর্মময় জীবনের প্রথম গ্রন্থ ‘আল জিহাদ’ : ১৯২৬ সালে যখন স্বামী শ্রদ্ধানন্দ সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হনএ হত্যাকাণ্ডের পর হিন্দুরা ইসলামের জিহাদ সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়াতে থাকে। এক জুমাবার মাওলানা মুহাম্মাদ আলী দিল্লির জামে মাসজিদে ভাষণ দিচ্ছিলেন।
 ইসলামে জিহাদ সম্পর্কে হিন্দু নেতারা যেই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন, তার জওয়াব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি উল্লেখ করলেন তাঁর ভাষণে। শ্রোতাদের মধ্যে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ছিলেন। তিনি তখন ছাব্বিশ বছরের একজন যুবক। মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জওহর বক্তৃতা শুনে তিনি সংকল্প গ্রহণ করেন এ বিষয়ে লিখবেন। ‘আল জমিয়ত’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর জ্ঞানগর্ব লেখা ‘আল জিহাদ ফিল ইসলাম’। ২৪ বছর বয়সে প্রথম সর্বজন প্রশংসিত ৫ শতাধিক পৃষ্ঠার বিশাল বই ‘আল-জিহাদ ফিল-ইসলাম’ (১৯২৭ সালের ১৫ জুন) লেখেন। ১৯২৬ ও ১৯২৭ সালে মোট চব্বিশটি কিস্তিতে তিনি ইসলামের ‘আল জিহাদ’ সংক্রান্ত ধারণা অত্যন্ত পরিচ্ছন্নভাবে তুলে ধরেন জনসমক্ষে। তাঁর লেখা অনেকের মুখে ভাষা ফুটিয়েছে। হিন্দু নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতির মোকাবিলা করার হাতিয়ার জুগিয়েছে। ১৯২৮ সালে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ এক অবাক করা কাণ্ড করে বসে। উপমহাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে সংগঠিত করে রাজনীতিতে একটি স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টির প্রচেষ্টা না চালিয়ে জমিয়ত অল ইন্ডিয়া ন্যাশনাল কংগ্রেসের রাজনৈতিক স্ট্যান্ডের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের এ ভূমিকা সঠিক বলে মেনে নিতে পারেননি। ফলে তিনি ‘আল জমিয়ত’ পত্রিকার সম্পাদক পদে ইস্তফা দেন। এ সময় তিনি গবেষকের মন নিয়ে ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহি.), ইমাম হাফিয ইবনুল কাইয়্যিম (রাহি.) ও শাহ ওয়ালীউল্লাহর (রাহি.) গ্রন্থাবলী অধ্যয়ন করতে থাকেন।
১৯৩২ সালে ভারতের হায়দরাবাদ থেকে প্রথম ‘তরজুমানুল কুরআন’ নামক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। ১৯৩৮ সালে খুতবা (হাকীকত সিরিজ) গ্রন্থ গ্রকাশ করেন, যা সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে। নামায, রোজা, হজ, যাকাত, জিহাদ ইত্যাদি বিষয়ে আলাদা আলাদাভাবে সুগভীর চিন্তা ও তাত্ত্বিকতাসমৃদ্ধ বই প্রকাশ করেন। ১৯৪০ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে “ইসলামী হুকুমাত কিস তরাহ কায়েম হোতি হ্যায়” বিষয়ের ওপর এক জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দান করেন, যা পরবর্তীতে গ্রন্থাকারে ইংরেজিতে ‘The Process of Islamic Revolution’ এবং বাংলায় ‘ইসলামী রাষ্ট্র কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে’ নামে প্রকাশিত হয়।
দাওয়াতে দীনের প্রথম পদক্ষেপ মাসিক ‘তরজুমানুল কুরআন’ প্রকাশ: ১৯৩১ সালে ৩১ জুলাই ওস্তাদ মওদূদী দিল্লি থেকে হায়দরাবাদ চলে আসেন। ১৯৩২ সালে আবু মুহাম্মদ মুসলেহ-এর মালিকানাধীন হায়দরাবাদ থেকে মাসিক ‘তরজুমানুল কুরআন’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী। এ সময় তাঁর বয়স ছিল উনত্রিশ বছর। অল্পকাল পর এ পত্রিকার মালিকানাও তাঁর হাতে তুলে দেয়া হয়। তরজুমানুল কুরআনের প্রথম সম্পাদকীয়তে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী লিখেন, ‘‘এই পত্রিকার উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর বাণীকে বুলন্দ করা ও মানুষকে আল্লাহর পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান জানানো। বিশেষ উদ্দেশ্য হচ্ছে আল কুরআনের নিরিখে দুনিয়ায় বিস্তারশীল চিন্তা-চেতনা, মতবাদ, সভ্যতা-সংস্কৃতির ও সমাজতত্ত্বের প্রেক্ষাপটে আল কুরআন ও আস্ সুন্নাহর নীতিগুলো ব্যাখ্যা করা এবং যুগের প্রেক্ষাপটে আল কুরআন ও আস্ সুন্নাহর বিধানগুলোর প্রয়োগ পদ্ধতি নির্দেশ করা। এ পত্রিকা মুসলিমদের এক নতুন জীবনের দিকে আহ্বান জানাচ্ছে।’’ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী তরজুমানুল কুরআনের সৌজন্য কপি পাঠাতেন লাহোরে ড. মুহাম্মাদ ইকবালের কাছে। ড. ইকবাল তখন প্রবীণ দার্শনিক ও কবি। অন্যকে দিয়ে পড়িয়ে তিনি তরজুমানুল কুরআন শুনতেন। ১৯৩৬ সালে ড. ইকবাল সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন তাঁর কর্মস্থল হিসেবে পাঞ্জাবকে বেছে নিতে। সাইয়েদ আবুল আ’লা অপারগতা প্রকাশ করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আল্লামা ইকবালের পরামর্শেই ওস্তাদ মওদূদী মাসিক তরজুমানুল কুরআনের অফিস হায়দরাবাদ থেকে পাঞ্জাবে স্থানান্তর করেন। ইসলামী জাগরণের নকীব হিসেবেই মাসিক তরজুমানুল কুরআনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এখনো পত্রিকার প্রকাশনা অব্যাহত রয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ।
মওদূদী হায়দরাবাদের উসমানীয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান : সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী হায়দারাবাদ ছেড়ে যাবেন শুনে উসমানীয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিয়াত বিভাগের প্রধান মাওলানা মানাযের আহসান গিলানী ওস্তাদ মওদূদীর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হয়ে হায়দরাবাদের নিজামের প্রধানমন্ত্রী স্যার আকবর হায়দারীর সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে মাসিক আটশত পঞ্চাশ রুপি বেতনে ইসলামিয়াতের অধ্যাপক পদে নিযুক্তির প্রস্তাব দেন। সন্দেহ নেই, এটি ছিল খুবই লোভনীয় প্রস্তাব। তাঁর বড়ো ভাই সাইয়েদ আবুল খায়েরও তাঁকে এ প্রস্তাবে সম্মত হতে বলেন। কিন্তু আল্লাহর দীনের আওয়াজ বুলন্দ করার মহান প্রেরণা তাঁকে এ লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার হিম্মত জোগায়। আল্লাহর দীনকে জমিনে বিজয়ী করার জন্য ইকামতে দীনের কাজকে ছড়িয়ে দিতে বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদ গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন! অথচ তার সমালোচকরা কীভাবে বলতে পারে তিনি পড়াশোনা করেননি বা অল্প শিক্ষিত? সেই সময় ওস্তাদ মওদূদী তাঁর বড় ভাইকে বলেন, ‘‘আমি (দেশের রাজনৈতিক) দিগন্তে দুর্যোগের ঘনঘটা দেখতে পাচ্ছি। সারা দেশের ওপর দিয়ে এক ভয়ানক ঝড় বয়ে যাবে। এর পরিমাণ ১৮৫৭ সনের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিণামের চেয়েও গুরুতর হবে। হায়দরাবাদে অবস্থান করে আমি এ সম্পর্কে সতর্ক সংকেত দিতে পারবো না। এখানে তা বিবেচিত হবে রাষ্ট্র্রদ্রোহিতা বলে। আমাকে এমন এক জায়গায় যেতে হবে, যেখান থেকে আমি স্বাধীনভাবে আমার মত প্রকাশ করতে পারবো।
কাওমের খিদমতে আমি নিজকে নিয়োজিত করতে চাই। আমি বিত্তহীন। কিন্তু আমার বিত্তহীনতা আমার সংকল্পের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। আমাকে তাড়াতাড়ি করতে হচ্ছে। আমি বিলম্ব করতে পারছি না। প্রথমে অর্থ বানানোর জন্য আমি যদি দেরি করি, সেই অর্থ বানানো যাত্রার বিড়ম্বনা সইতে আমাকে বাধা দেবে। ভাই, আমাকে আমার তাকদীরের পথে অগ্রসর হবার অনুমতি দিন। আমাকে আপনার দোয়া রদিন। পথ বন্ধুর। কিন্তু যদি ইচ্ছা থাকে, আল্লাহর অনুগ্রহ যদি লাভ করি, আমি আমার মিশনে সফল হবোই। আমার কাছে বৈষয়িক সুবিধা অর্জনের চেয়ে আমার মিশনের সফলতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’’ আমি আমার সাধ্যমতো উম্মাহর খেদমত করার চেষ্টা করবো। আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করা যেতে পারে না। আমার বিশ্বাস, যদি আমার উদাত্ত আহ্বানের মধ্যে আন্তরিকতা ও সততা থাকে, তাহলে আমার মনের আবেগ ব্যর্থ হবে না। (জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২০)।
ওস্তাদ মওদূদী রাজনীতির ক্ষেত্রে যেমন দক্ষ ছিলেন, ঠিক তেমনি সাংবাদিক হিসেবেও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে, সাহিত্য সৃষ্টিতেও অভিজ্ঞ ছিলেন। ছেলেবেলা থেকেই সাহিত্য সৃষ্টির প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। গত অর্ধশতাব্দীকাল যাবত মাওলানা মওদূদীর বিপ্লবী সাহিত্যের বলিষ্ঠ ভূমিকা লাখোকোটি মানব সন্তানের চিন্তার রাজ্যে বিপ্লব এনে দিয়েছে। তিনি বিশ্বব্যাপী ইসলামী আন্দোলনের নতুন এক উত্থান সৃষ্টি করেছেন কলমের সাহায্যে। মুসলমানদের চিন্তাজগতে শতাব্দীর যে স্থবিরতা দানা বেঁধেছিল, মাওলানা মওদূদীর সাহিত্য তা দূর করে ব্যাপক সুদূরপ্রসারী স্বচ্ছ নির্মল চিন্তাধারার সঞ্চার করে দিয়েছে। তিনি ইসলামকে সাহিত্যের মাধ্যমে একটি স্থবির ও প্রাচীন গতানুগতিক ধর্মের পরিবর্তে একটি বিপ্লবী জীবনধারা হিসেবে পেশ করেছেন।
লেখক : সাংবাদিক।
তথ্য সূত্র : ১. মাওলানা মওদূদী : একটি জীবন একটি ইতিহাস। ২. জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, লেখক আব্বাস আলী খান। ৩. আমার আব্বা আম্মা, লেখক সাইয়েদা হুমায়রা মওদূদী। ৪. ইমাম মওদূদী রহ. চিন্তাধারা ও তাজদীদ, লেখক ড. ইউসুফ আল কারযাভী। ৫. একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণ তার থেকে বাঁচার উপায়, আব্বাস আলী খান। ৬. জীবনে যা দেখলাম, অধ্যাপক গোলাম আযম। ৭. ইসলামী জাগরণের তিন পথিকৃৎ, এ কে এম নাজির আহমদ।



এ পাতার অন্যান্য খবর

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।