সংবাদ শিরোনামঃ

ভোট ডাকাতির আশঙ্কা ** বাংলা সাহিত্য বিশ্বে ছড়িয়ে দিন ** দেশের রাজনীতি এখন ছাই চাপা তুষের আগুন ** বিশ্ব হিজাব দিবস পালিত ** হারলেন ট্রাম্প, টিকলেন হিলারি ** মধ্যবর্তী নির্বাচনের চাপ ** বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিলেন খালেদা জিয়া ** অন্তর্দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত জাতীয় পার্টি ** মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা আজও পূর্ণাঙ্গ হয়নি ** শিশু নির্যাতন ও অপহরণ বন্ধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে ** নিশ্চিত অনিশ্চয়তার মুখে দেশ ** নাজাত লাভের উপায় ** যেভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি হলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ** নড়াইল সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাস করছে ** করতোয়া নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন হুমকিতে তীরবর্তী স্থাপনা **

ঢাকা, শুক্রবার, ২৩ মাঘ ১৪২২, ২৫ রবিউস সানি ১৪৩৭, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

এবনে গোলাম সামাদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস প্রফেসর এবং ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মভূষণ’ খেতাবপ্রাপ্ত ড. আনিসুজ্জামান নয়া দিগন্ত পত্রিকায় আমার রচিত একটি স্তম্ভের (১৮.১১.২০১৫) যথেষ্ট সমালোচনা করে চট্টগ্রামে ‘অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্মারক বক্তৃতা’ প্রদান করেছেন, যা বাংলাদেশের খ্যাতনামা দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোতে প্রকাশিত (২২ জানুয়ারি ২০১৬) হয়েছে। এর শিরোনাম দেয়া হয়েছে- ‘আমরা কি এক সঙ্কটের মুখোমুখি?’। আনিসুজ্জামান এ দেশে একজন খুবই খ্যাতনামা ব্যক্তি। তিনি যে আমাকে তার বক্তৃতায় গুরুত্ব দিয়েছেন, সে জন্য শ্লাঘা বোধ করছি। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। তাই তিনি যা বলেছেন, তাতে রুষ্ট হইনি। আমি বিশ্বাস করি, বাদ-প্রতিবাদে প্রকৃত সংবাদ বা তথ্য বেরিয়ে আসে। তার বক্তৃতার প্রতিবাদ করছি, কেননা আমি চাচ্ছি বাদ-প্রতিবাদে প্রকৃত তথ্য উদঘাটিত হোক। কোনো বিতণ্ডার মনোভাব আমার মধ্যে বিরাজ করছে না।

আনিসুজ্জামান সাহেব যে মেজর প্রেমিস থেকে তার বক্তব্য প্রদান করেছেন, আমি মনে করি- বস্তুগতভাবে সেটা যথার্থ নয়। তাই তার সিদ্ধান্ত আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। প্রথমে আসা যাক, সাবেক পাকিস্তান রাষ্ট্রের কথায়। সাবেক পাকিস্তান ছিল একটি রাষ্ট্র, দু’টি রাষ্ট্র নয়। কিন্তু আনিসুজ্জামানের বক্তৃতায় সাবেক পাকিস্তানকে ধরে নেয়া হয়েছে দু’টি দেশ। সেটা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বলতে হয়, আদৌ যথার্থ নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গ্রন্থকারেরা বলে থাকেন, কোনো দেশ ‘রাষ্ট্র’ কি না, সেটা বিচারের মাপকাঠি হলো অন্যান্য রাষ্ট্র ওই দেশটিকে একটি রাষ্ট্র বলে স্বীকার করে কি না। অর্থাৎ যে দেশ একটি রাষ্ট্র বলে অন্য রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত, তাকেই বলতে হবে একটি রাষ্ট্র। সাবেক পাকিস্তান একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত ছিল। সাবেক পাকিস্তান ছিল জাতিসঙ্ঘের একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত সদস্য। আমরা এক সময় সবাই ছিলাম তখনকার পাকিস্তানের নাগরিক। কিন্তু আনিসুজ্জামানের বক্তৃতায় মনে হয়, তিনি কেবল তদানীন্তন পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের অধিবাসীদেরই বলতে চান পাকিস্তানি। তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের বলতে ইচ্ছুক নন ‘পাকিস্তানি’। অথচ সারা বিশ্বে এ দুই অঞ্চলের মানুষকে বলা হতো ‘পাকিস্তানি’। কেননা, এ দুই অঞ্চলের মানুষের পাসপোর্টেই লেখা থাকত, পাসপোর্ট বহনকারী হচ্ছেন পাকিস্তানি। তিনি পাকিস্তানের নাগরিক। আনিসুজ্জামান সাবেক পাকিস্তান আমলে পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে বা অন্য কোনো কারণে বিদেশে গিয়েছেন কি না জানি না। যদি যেয়ে থাকেন, তবে বাইরের বিশ্বে তাকে পরিচয় দিতে হয়েছে পাকিস্তানি হিসেবেই। সাবেক পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ড ছিল প্রেসিডেন্টের হাতে। সাবেক পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ছিল একটি, দু’টি নয়। এরা ছড়িয়ে ছিল সারা পাকিস্তানে, পশ্চিমে ও পূর্বে। এরা কোথাও ‘হানাদার বাহিনী’ হিসেবে পরিচিত ছিল না। যেহেতু আনিসুজ্জামান ধরে নিয়েছেন সাবেক পাকিস্তান একটি রাষ্ট্র ছিল না, তাই সৃষ্টি হতে পারছে তার চিন্তা-বিভ্রাট। সাবেক পাকিস্তান রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাভাষী মুসলমানদের পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হওয়ার কারণে। না হলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হতে পারত না। শেখ মুজিব তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি, বক্তৃতা করি। খেলার দিকে আর নজর নাই। শুধু মুসলিম লীগ আর ছাত্রলীগ। পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নাই (শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী। পৃষ্ঠা-১৫। দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০১২)।

আনিসুজ্জামান সাহেব আমার সমালোচনা করেছেন, কারণ আমি বলেছি বাংলাদেশের মানুষের মনে একটা মুসলিম স্বাতন্ত্র্য-চেতনা ফিরে আসছে। তিনি বলেছেন, এটা বলছি, কারণ আমি পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন। এখানেও ঘটছে একই রকম চিন্তা-বিভ্রাট। তিনি ধরে নিচ্ছেন, কেবল বর্তমান পাকিস্তানেরই উদ্ভব হয়েছিল মুসলিম চিন্তাকে নির্ভর করে। আর তা কেবল টিকে আছে সেখানেই। বাংলাদেশের মানুষ কোনো দিনই পাকিস্তান চাননি। নিজেদের ভাবেননি যে তারা মুসলমান। কিন্তু আমরা দেখলাম, শেখ মুজিব বলেছেন, ‘পাকিস্তান আনতেই হবে। নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নাই।’ এই মুসলিমচেতনা নতুন করে আবার ফিরে আসছে নতুন পরিস্থিতিতে। সাবেক পাকিস্তান রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। এর উদ্ভব হয়েছিল তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে, হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। ব্রিটিশ শাসনামলে যদি হিন্দু জাতীয়তাবাদের উদ্ভব না হতো, তবে মুসলিম জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হতো না। ব্রিটিশ শাসনামলেই এই উপমহাদেশে উদ্ভব হতে পেরেছিল হিন্দুত্বের ধারণার।

আমরা ছিলাম গ্রেট ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে। গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এইচ এইচ অ্যাসকুইথ (১৮৫২-১৯২৮) ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কমন্স সভায় বলেন, হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্যের ব্যাপারটা কেবল ধর্মভিত্তিক নয়। এর উদ্ভব ঘটতে পেরেছে ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণে। ১৯০৯ সালে গঠিত হয় মর্লি-মিন্টো রিফর্ম কমিশন। এই কমিশনের সুপারিশ অনুসারে, এ উপমহাদেশের মুসলমানেরা পেলেন স্বতন্ত্র নির্বাচনের অধিকার। তদানীন্তন বাংলা প্রদেশে মুসলমানেরা পেলেন মুসলমানদের জন্য পাঁচটি স্বতস্ত্র নির্বাচনী আসন। মুসলমানেরা সাধারণ নির্বাচনী আসনেও দাঁড়াতে পারবেন। কিন্তু এ পাঁচটি স্বতন্ত্র আসনে কেবল মুসলমানেরাই দাঁড়াতে পারবেন এবং তাদের নির্বাচনে কেবল মুসলমান ভোটাররাই দিতে পারবেন ভোট। এভাবে সারা ভারতের ভোটের নির্বাচনে হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্য স্বীকৃতি পায়, যা সূত্রপাত ঘটায় দ্বিজাতিতত্ত্ব ধারণার। হিন্দু-মুসলমান বিরোধের একটা প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায় গো-মাংস ভণ। হিন্দুরা গরুকে পূজা করে থাকেন। তারা গো-মাংস ভণ করাকে মনে করেন অপরাধ। কিন্তু মুসলমানের কাছে তা অপরাধ ছিল না। সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে হিন্দুরা গঠন করেন গো-রা সমিতি। তারা বাধা দিতে শুরু করে মুসলমানদের গো-মাংস ভণে। এতে সৃষ্টি হয় প্রচণ্ড হিন্দু-মুসলমান বিরোধ। সৃষ্টি হয় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার (Cow-Killing Riots), যা ব্রিটিশ শাসনামলের আগে এই উপমহাদেশে ঘটত না। ব্রিটিশ শাসনামলে অনেক স্থানে হিন্দুরা ঢাকঢোল পিটিয়ে তাদের পূজার প্রতিমাকে নিয়ে যেতে আরম্ভ করেন মসজিদের পাশ দিয়ে, নামাজ পড়ার সময়। এ নিয়েও বাধতে আরম্ভ করে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। হিন্দু-মুসলমান বিরোধ চরমে উঠলে পাঞ্জাবের বিখ্যাত হিন্দু নেতা লালা লাজপৎ রাই প্রস্তাব রাখেন (১৯২৫), তদানীন্তন ভারতের পশ্চিম অঞ্চলের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নিয়ে একটি পৃথক বড় প্রদেশ গঠন করতে এবং পূর্বাঞ্চলের মুসলমান প্রধান অংশ নিয়ে আরেকটি বড় প্রদেশ গঠন করতে। তিনি বলেন, এ রকম বড় দু’টি প্রদেশ গঠন করলে এই উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান সঙ্ঘাত অনেক কমে যাবে। তার এই প্রস্তাব পাকিস্তান প্রস্তাবেরই পূর্ব সূচনা। পাকিস্তানের ধারণাটাকে তাই বলা চলে না মুসলমানদের মস্তিষ্কপ্রসূত (দ্রষ্টব্য : শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলা দেশের ইতিহাস, চতুর্থ খণ্ড; পৃষ্ঠা ৩৪৫। ডিসেম্বর ১৯৭৫, কলকাতা)। মহারাষ্ট্রের হিন্দু মহাসভার বিখ্যাত নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকার (১৮৮৩-১৯৬৬) বলেছেন, ‘মুসলমানেরা কেবল বিধর্মীই নন, তারা হলেন পরদেশী। তাদের ভারত থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে।’ তদানীন্তন সারা ভারতে হিন্দুদের এক অংশের মধ্যে উদিত হতে দেখা যায় মুসলমান বিতাড়নের মনোভাব। ফলে পাকিস্তান আন্দোলন হয়ে ওঠে জোরালো। এখন ভারতে গো-মাংস ভণের অভিযোগে মুসলমানকে মরতে হচ্ছে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হলো। এখন চলেছে সেখানে রামমন্দির গড়ার তোড়জোড়। বাংলাদেশের ইতিহাস ও ভৌগোলিক অবস্থান এমন যে, ভারতের ঘটনা বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের মনে গুরুতর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করেই পারে না। এ কারণে বাংলাদেশে বাংলাভাষী মুসলমানের মনে ফিরে আসছে একটা মুসলিমচেতনা। এই চেতনা বর্তমান পাকিস্তান থেকে পাচার হয়ে বাংলাদেশে আসছে না; বাংলাদেশের ভেতর থেকেই উঠছে। এটা অধ্যাপক আনিসুজ্জামান উপলব্ধি করতে পারছেন বলে মনে হয় না। তাই তিনি এ েেত্র দেখছেন বর্তমান পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের হাত। অনেকের মতে, সাবেক পাকিস্তানের পশ্চিম ও পূর্বাংশের মধ্যে এক ধর্ম ছাড়া আর কিছুর মিল ছিল না। কিন্তু মিল ছিল ইতিহাসের। মিল ছিল উগ্র হিন্দুত্বের ভয়ের। ভারতঘেরা বাংলাদেশের মুসলমানের মনে তাই জাগছে বর্তমান পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ইচ্ছা। এর মূলে কাজ করছে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে নিরাপত্তা দেয়ার এষণা। কিন্তু এ েেত্রও আনিসুজ্জামান পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে না। তিনি ও তার সাথীরা চাচ্ছেন বর্তমান পাকিস্তানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে। কিন্তু পাকিস্তানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ কিভাবে লাভবান হবে, সেটা থাকছে অস্পষ্ট। আমরা বাস করছি না ১৯৭১-এর দুনিয়ায়। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল একটা প্রবল পরাশক্তি। কিন্তু সেই শক্তির পতন ঘটেছে। তার সাথে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ এখন আর কোনো নিরাপত্তা লাভের সুযোগ পেতে পারে না। কেননা তার অস্তিত্বই আর নেই। অন্য দিকে ভারতে নেই ইন্দিরার কংগ্রেস সরকার। এর জায়গায় মতায় এসেছে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার। কিন্তু বিজেপি যে কারণেই হোক চাচ্ছে বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে। এ দিক থেকেও রাজনীতির প্রোপট হয়ে পড়েছে অনেক ভিন্ন। কিন্তু আনিসুজ্জামান সাহেবরা এই পরিবর্তিত অবস্থায় আঁকড়ে থাকতে চাচ্ছেন তাদের ১৯৭১-এর মনোভাবকে। তাদের উচিত তাদের ভাবনা-চিন্তাকে হালনাগাদ করা; পরিবর্তিত অবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করা। তা না হলে তারা পড়তে পারেন এক সঙ্কটেরই মধ্যে। কিন্তু তাদের সঙ্কটকে দেশবাসী মনে করবেন না বাংলাদেশের সঙ্কট হিসেবে।

আনিসুজ্জামান সাহেব আমাকে কটা করে বলেছেন, ১৯৭১ সালে আমি রাজশাহী ছেড়ে কলকাতায় গিয়েছিলাম কেন? কিন্তু আমিও কি তাকে প্রশ্ন করতে পারি না, তিনি ১৯৪৭-এর পর ভারত থেকে তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় চলে এসেছিলেন কেন? তিনি তো পূর্ব বাংলায় জন্মগ্রহণ করেননি? পূর্ববাংলা ছিল সাবেক পাকিস্তানের একটি প্রদেশ। যাকে ১৯৫৫ সালের অক্টোবর মাস থেকে সরকারিভাবে বলা হতে থাকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’। কে যে কখন কী প্রয়োজনে কোথায় যাবে, সেটা নানা কিছুর ওপর নির্ভর করে। আমি কলকাতায় গিয়েছিলাম। কারণ, আমার নিজের এক ভাই পশ্চিম বাংলায় করতেন চাকরি। আমি ভাইয়ের কাছে ছিলাম। আমার ভাই কলকাতায় না থাকলে হয়তো আমি অন্য কোনো দেশে যেতাম। সে সুযোগও আমার ছিল। তবে থাকতে চেয়েছিলাম দেশের সীমান্তের কাছেই। সেটারও একটা বিশেষ কারণ ছিল, যেটা এখন আর যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক নয়। আমি কলকাতা থেকে একপর্যায়ে দেশে ফিরতে চেয়েছিলাম। ১২ জুলাই ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে শেখ মুজিব বলে পাঠান তাজউদ্দীন সাহেবকে ছেড়ে সব এমএনএ-কে ঢাকায় যাত্রা করতে। অনেকেই কলকাতা ছেড়ে চলে আসতে চান ঢাকায়। আমিও ভেবেছিলাম, সমস্যার একটা সমাধান হতে যাচ্ছে। কিন্তু ভারত আটকে দেয় সবার দেশে ফেরার পথ। কিন্তু এই ইতিহাস এখনো থেকে গেছে অনেকের অজ্ঞাত। তবে কেউ যদি কলকাতা থেকে প্রকাশিত The Statesman পত্রিকার ১১ জুলাই ’৭১ সংখ্যাটি জোগাড় করে পড়তে পারেন, তবে তা থেকে কিছুটা আভাস পাবেন যে, একটা আলোচনা চলেছিল শান্তিপূর্ণ সমাধানের। এ আলোচনাটা হতে পারত আওয়ামী লীগের এমএনএ’দের সাথে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত যুগান্তর পত্রিকার ১৯৭১-এর ১১ জুলাই সংখ্যায় খবর বেরিয়েছিল, জুলফিকার আলী ভুট্টো তেহরানের এক সংবাদপত্রের প্রতিনিধিকে বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার একটা রাজনৈতিক মীমাংসা হওয়া দরকার। এর জন্য দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে আলোচনায় অংশ নিতে হবে। একই কথা বিবিসি থেকেও প্রচার করা হয়েছিল। কিন্তু তাজউদ্দীন আহম্মদ ছিলেন এ রকম আলোচনার ঘোর বিরোধী। ভারতও এ রকম আলোচনার পে ছিল না। তবে খন্দকার মোশতাক আহমেদ ছিলেন এর প।ে কেউই দেশে আসতে পারেনি। কারণ, পথ আগলে ছিল পশ্চিম বাংলার পুলিশ। সম্ভবত এই ঘটনার কথা আনিসুজ্জামান সাহেবেরও একেবারেই অবিদিত নয়। কেননা তিনি ছিলেন তাজউদ্দীনের খুবই কাছের লোক এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কাছে যথেষ্ট আদৃত। তিনি কলকাতায় গড়েছিলেন এ দেশ থেকে কলকাতায় যাওয়া গায়ক-গায়িকা, নৃত্যশিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নিয়ে একটি দল। তিনি তাদের নিয়ে ঘুরেছিলেন সারা উত্তর ভারতে। তার ল্য ছিল নাচ-গান-অভিনয়ের মধ্য দিয়ে উত্তর ভারতে-বাংলাদেশের স্বাধীনতার পে ইন্দিরা গান্ধী যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তার পে জনমত গঠন। এ সময় উত্তর ভারতে জনমত বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনুকূলে ছিল না। তারা মনে করছিলেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে যেয়ে ভারতের উচিত হবে না কোনো বড় রকমের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া। কেননা যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে হতে পারে একটি প। যুদ্ধ কেবলই যে পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সীমিত থাকবে, তা মনে করা ভুল হবে। যুদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে পারে একটি আন্তর্জাতিক যুদ্ধ, যা আর থাকবে না ভারতের নিয়ন্ত্রণে। পাকিস্তান আন্তর্জাতিকভাবে একটি স্বীকৃত রাষ্ট্র। পূর্ব পাকিস্তানে যা হচ্ছে সেটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তাতে ভারতের হস্তপেকে আন্তর্জাতিক সমাজ ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। একটি প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রকে তারা চাইবে না ভেঙে দিতে। জানি না আনিসুজ্জামান তার দল নিয়ে উত্তর ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর পে জনমত গঠনে কতটা সাফল্য পেয়েছিলেন। কেননা, বাংলা গান উত্তর ভারতে কেউ বোঝে না। সুরের দিক থেকেও পছন্দ করে না। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘জনগণমন’ গান পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া ভারতের আর সব প্রদেশে গাওয়া হয় হিন্দি অনুবাদে। তাই বাংলা গান দিয়ে লোক জাগানো সম্ভব নয় উত্তর ভারতে। আনিসুজ্জামান সাহেব ও তার নাচ-গান-অভিনয়ের সাথীরা ভালোই ছিলেন ভারতে। তারা ইন্দিরা গান্ধীর সৌজন্যে ভালো খেয়েছেন, পরেছেন এবং থেকেছেন ভালো হোটেলে। আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১০-১২ জন অধ্যাপক গিয়েছিলাম কলকাতায়। এদের মধ্যে কয়েকজন পড়েছিলেন দারুণ অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে। অনেক অধ্যাপক আসতেন আমার কাছে। তাদের সবারই প্রশ্ন ছিল, কবে নাগাদ দেশে ফেরা সম্ভব হবে? আনিসুজ্জামানের প্রশ্নের উত্তরে এখানে এটুকুই বলতে পারি।

১৯৭১-এ আমি দেশে ছিলাম না। দেশে কী ঘটেছে তা থেকেছে আমার অজানা। ১৯৭১-এর ২ জুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৩ জন শিক এক যুক্তবিবৃতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আচরণের প্রশংসা করেছিলেন। তাজউদ্দীন দেশে ফিরে এদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন। কাউকে কাউকে পাঠানো হয় জেলে। শেখ মুজিব দেশে ফিরে এদের সবাইকে কারামুক্তির আদেশ দিয়েছিলেন। কেবল তাই নয়, এদের সবাইকে নিযুক্তি দিয়েছিলেন তাদের পূর্বপদে। শেখ মুজিব করতে চাননি প্রতিশোধের রাজনীতি। এটা অনেকের কাছে খুবই প্রশংসনীয় বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু তা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক মহলে হতে পেরেছিল এটি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার উৎস।

লেখক : প্রবীণ শিাবিদ ও কলামিস্ট

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।