ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

জামায়াত সাতক্ষীরা-৪ আসনে সুবিধাজনক অবস্থানে, আ’লীগশূন্য মাঠে মরিয়া বিএনপি


১৬ অক্টোবর ২০২৫ ১৪:৩৭

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: নির্বাচন কমিশন ঘোষিত সংসদীয় আসনের চূড়ান্ত সীমানা অনুযায়ী পূর্বের রূপে ফিরেছে সাতক্ষীরা-৪ আসন (শ্যামনগর, তৎকালীন সাতক্ষীরা-৫)। ২ লাখ ৯৫ হাজার ৫৩৬ ভোটার নিয়ে গঠিত আসনটিতে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে যেমন উচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি অনেকের জন্য হতাশারও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপি শিবিরের চরম হতাশা বিরাজ করলেও স্বস্তিতে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী। বর্তমানে মাঠে নেই কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগ। চোখে পড়ছে না জাতীয় পার্টির কোনো কার্যক্রমও। এ সুযোগে আসনটি পুনরুদ্ধার করতে চায় জামায়াতে ইসলামী। অপরদিকে সাতক্ষীরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আসনটিতে একবারও জিততে না পারা বিএনপিও চায় প্রথমবারের মতো জিতে আসনটি তারেক রহমানকে উপহার দিতে। সব মিলিয়ে এ আসনে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে মূল লড়াইটা হবে। তবে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে এলে বদলে যেতে পারে সমীকরণ।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য মতে, ১৯৮৪ সালে সাতক্ষীরা জেলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সাতক্ষীরা জেলায় পাঁচটি সংসদীয় আসন ছিল। এক্ষেত্রে জেলার শ্যামনগর উপজেলা নিয়ে ছিল সাতক্ষীরা-৫ আসন। ২০০৮ সালে সাতক্ষীরা জেলা থেকে একটি আসন কমিয়ে চারটি আসন করা হয়। যেখানে শ্যামনগরের সঙ্গে কালিগঞ্জের আটটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠন করা হয় সাতক্ষীরা-৪ আসন। এভাবেই চলেছে ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত। সম্প্রতি আবারো সাতক্ষীরার চারটি সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। যেখানে শুধুমাত্র শ্যামনগর উপজেলা নিয়ে গঠন করা হয়েছে সাতক্ষীরা-৪ আসন।
সূত্রমতে, সাতক্ষীরা-৪ (শ্যামনগর-কালিগঞ্জ আংশিক) নির্বাচনী এলাকায় স্বাধীনতা পরবর্তী ১৩টি নির্বাচনের, আমি, ডামি, নৈশ্য ও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৭টিতেই আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থীরা জয়লাভ করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে অল্প ভোটের ব্যবধানে হেরে জান জামায়াতের প্রার্থী। জাতীয় পার্টি একবার এবং মুসলিম লীগ প্রার্থী একটি নির্বাচনে বিজয়ী হয়।
সংসদীয় আসনের এ ভাঙা-গড়ার খেলায় এ আসনে কখনো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন শ্যামনগর থেকে, কখনো কালিগঞ্জ থেকে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা প্রস্তুতি নিয়েছেন শ্যামনগর-কালিগঞ্জ ধরে, কিন্তু আকস্মিক সীমানা পরিবর্তন হওয়ায় কালিগঞ্জ অংশের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা পড়েছেন বিপাকে, যা তাদের জন্য অস্বস্তিরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপরীতে শ্যামনগর অংশের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা রয়েছেন স্বস্তিতে।
শ্যামনগরের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেন্দ্র অনুযায়ী কমিটি গঠন, পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণ, প্রচারণা ও গণসংযোগের মধ্য দিয়ে সাতক্ষীরা-৪ আসনে জামায়াত মনোনীত একক প্রার্থী ও সাবেক এমপি (সংসদ সদস্য) গাজী নজরুল ইসলামের নির্বাচনী প্রস্তুতি জোরদার করেছে দলটি। একইভাবে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশায় তৃণমূলে গণসংযোগের পাশাপাশি দলকে সুসংগঠিত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ড. মনিরুজ্জামান মনির, শ্যামনগর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও জেলা বিএনপির সদস্য মাস্টার আব্দুল ওয়াহেদ এবং শ্যামনগর উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সদস্য আশেক এলাহি মুন্না। এ তালিকায় আরও রয়েছেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও তৎকালীন সাতক্ষীরা-৪ (কালিগঞ্জ-দেবহাটা) আসনের সাবেক এমপি কাজী আলাউদ্দিন ও জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক এডভোকেট সৈয়দ ইফতেখার আলী। তবে কাজী আলাউদ্দিন ও এডভোকেট সৈয়দ ইফতেখার আলী পড়েছেন আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসজনিত জটিলতায়। আর বাকি মনোনয়নপ্রত্যাশীরা শ্যামনগরে অবস্থানগত কারণে সুবিধাজনক স্থানে থাকলেও দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন করতে না পারলে সাতক্ষীরা-৪ আসনে জয় অর্জন করা অসাধ্য হয়ে পড়বে বিএনপির জন্য। যদিও দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, উপজেলা বিএনপির কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলমান। কমিটি গঠনের কার্যক্রম শেষ হলে নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো কোন্দল থাকবে না। এ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন সাতক্ষীরা-৪ (শ্যামনগর-কালিগঞ্জের একাংশ) আসনের সাবেক এমপি এইচএম গোলাম রেজা।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি কলঙ্কজনক দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ডামি নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এসএম আতাউল হক দোলন নৌকা প্রতীক নিয়ে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৩৯৫ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) মনোনীত নোঙর প্রতীকের প্রার্থী এইচএম গোলাম রেজা পান ৩৮ হাজার ৮৮ ভোট।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদে নৈশ্য ভোটের নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৩৮৭ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন এসএম জগলুল হায়দার। তার নিকটতম জামায়াতের গাজী নজরুল ইসলাম পেয়েছিলেন ৩০ হাজার ৪৮৬ ভোট।
এর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি জামায়াত জোট ছাড়ায় বেশিরভাগ দলের ভোট বর্জনের পর অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাতক্ষীরা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের এসএম জগলুল হায়দার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
সব দলের অংশগ্রহণে জোটগতভাবে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাতক্ষীরা-৪ আসনে নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী এইচএম গোলাম রেজা। তিনি পেয়েছিলেন ১ লাখ ৫১ হাজার ১৪৭ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতের গাজী নজরুল ইসলাম পেয়েছিলেন ১ লাখ ১৭ হাজার ৬৭৫ ভোট।
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও তৎকালীন সাতক্ষীরা-৪ (কালিগঞ্জ-দেবহাটা) আসনের সাবেক এমপি কাজী আলাউদ্দিন বলেন, আমি একসময় কালিগঞ্জ-দেবহাটা আসনের এমপি ছিলাম। এখন নির্বাচন কমিশন ঘোষিত সংসদীয় আসনের চূড়ান্ত সীমানা অনুযায়ী দেবহাটা পড়েছে সাতক্ষীরা-২ আসনের (সাতক্ষীরা সদর ও দেবহাটা) মধ্যে, আর কালিগঞ্জ পড়েছে সাতক্ষীরা-৩ আসনের (কালিগঞ্জ-আশাশুনি) মধ্যে। আমি বিগত ১৫ বছর কাজ করেছি শ্যামনগর ও কালিগঞ্জে। এখনো শ্যামনগর ও কালিগঞ্জেই কাজ করছি, প্রতিদিন দুই উপজেলাতেই একাধিক প্রোগ্রামে অংশ নিচ্ছি। দুই আসনের নেতাকর্মীরাই আমাকে চাচ্ছে, তারা বলছে, আমাদের ছেড়ে যেয়েন না। এমন পরিস্থিতিতে আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য দলীয় হাই কমান্ডের সিগন্যালের অপেক্ষায় আছি।
অন্যদিকে স্বস্তিতে থাকা জামায়াতের একক প্রার্থী গাজী নজরুল ইসলাম জানান, আগামী নির্বাচনে সাধারণ মানুষ জামায়াতে ইসলামীকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় দেখতে চায়। সেই লক্ষ্যে আমারা আমীরে জামায়াতের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ভোটারদের কাছে যাচ্ছি। ভোটাররা আমাদের আশ্বস্ত করছেন। এতেই আমরা সন্তুষ্টি। আশা করছি, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হিসেবে জনগণ দাঁড়িপাল্লা প্রতীকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করবেন।