নেতা নির্বাচনে সর্বক্ষেত্রে যে গুণগুলো প্রত্যাশিত


১৬ অক্টোবর ২০২৫ ১৩:৫৮

॥ একেএম রফিকুন্নবী ॥
মহান আল্লাহ তাঁর বাগান সাজানোর জন্য যুগে যুগে নেতা পাঠিয়েছেন, যা শুরু হয়েছিল আদম আ.কে দিয়ে। জান্নাতের আবহাওয়ায় তার কাজ শুরু হলেও আল্লাহর হুকুমের বরখেলাপের কারণে নবী আদম আ. ও তাঁর প্রিয়সঙ্গী বিবি হাওয়া আ.কে দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন দুনিয়ার বাগান সাজাতে। সর্বশেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মদ সা. দুনিয়ায় তাঁর সাজানো কাজ শেষ করে বিদায় হজে আরাফাত ময়দানে লাখো জনতার সামনে বলেছিলেন, ‘আমি কি তোমাদের কাছে আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পালন করেছি? জনতার পক্ষ থেকে জানান দিয়েছিল যে, হ্যাঁ, আপনি আপনার দায়িত্ব সবটাই পালন করেছেন।’
আজকের যুগেও নবীর দেখানো পথেই দুনিয়া সাজাতে হবে। তাই তো পথে-প্রান্তরে নেতা বানাতে হবে দেশ চালানোর উপযোগী করে। তাই কারা নেতার আসনে বসবে, তাদের কী কী গুণাবলি থাকতে হবে, তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব আজ।
নেতাকে প্রথমেই হতে হবে বালেগ। যাতে তিনি আল্লাহ ও তাঁর নবীদের দেখানো পথে দেশ চালানোর যোগ্যতার প্রকাশ ঘটাতে পারেন। নেতাকে সততার সাথে তার কাজকর্ম চালাতে হবে। তিনি পারিপার্শ্বিক জ্ঞানের অধিকারী হবেন। আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে তাকে দায়িত্বের সবটুকু পালন করতে হবে। মনে রাখতে হবে মহান আল্লাহ আপনার সব কাজ দেখছেন। শুধু তাই নয়, আপনার অপ্রকাশিত চিন্তার খবরও তিনি রাখেন। তাই তো সূরা জিলজালে আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের অনুপরিমাণ ভালো কাজের ও অনুপরিমাণ মন্দ কাজের হিসাব তিনি খোলা কিতাবে লিখে রাখছেন।’ তাই আমাদের সব কাজের হিসাব যেমন দুনিয়ায় পর্যালোচনা হবে আবার কাল কিয়ামতেও এর জবাব দিতে হবে- এ অনুভূতি নিয়েই আমাদের নেতাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।
আমরা যারা জনগণের ভোটে গ্রামের মেম্বার, চেয়ারম্যান, কমিশনার, মেয়র, এমপি সর্বক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা, ঈমান-আমলে মিল থাকলেই তাকে নেতা বানাতে হবে। মসজিদের ইমাম নির্বাচনে যদি তার পোশাক-আশাক কুরআনের জ্ঞান, হাদিসের জ্ঞান বাস্তব জীবনে মানলেই তাকে আমরা ইমাম বানাবো। আবার গ্রামের মেম্বার, চেয়ারম্যান, কমিশনার, মেয়র, এমপি বানাতেও তাদের জ্ঞান, সততা, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজমুক্ত সত্যের সাক্ষ্য দেয়ার মতো লোককেই নেতা বানাতে হবে। তিনি যেমন সংসদে ইসলামী আইন বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবেন, আবার নামাজের সময় তাকে যদি ইমাম হতে বলা হয় তাও তিনি যোগ্যতার সাথে ইমামতি করতে পারবেন। আমরা এমন নেতা বানাতে চাই।
বর্তমানে দেশে নেতা বানানোর মৌসুম চলছে। এখনই আমাদের নেতার চরিত্র, সততা, লেনদেন বাস্তব জীবনে পালন করেন কিনা, তা আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হবে। যে ব্যক্তিকে আপনি আপনার দুঃখের ও সুখের জীবনে হাতের কাছে পাবেন। তার আচার-ব্যবহার নমনীয়তা আছে কিনা, তার জ্ঞানের সাথে তার আচার-আচরণের মিল আছে কি না, সবই বিচারে আনতে হবে।
আমাদের ঘর থেকে শুরু করে সমাজ, রাষ্ট্র সর্বক্ষেত্রেই ঈমানের বলে বলীয়ান লোকদের নেতা বানাতে হবে। আমাদের মসজিদের ইমাম, ইউনিয়ন, পৌরসভার চেয়ারম্যান, এমপি, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট, বিচারপতি বানাতেও যোগ্যতার মূল্যায়ন করেই নিয়োগ দিতে হবে। আমরা গত ৫৪ বছর নেতা বানাতে যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারিনি। তাই তো নেতারা পানের দোকান থেকেও চাঁদা নেয়, আর প্লেনের দোকান থেকেও চাঁদা নেয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে তার পিয়নের শত শত কোটি টাকা অবৈধভাবে আয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ফ্যাসিস্ট হাসিনা। তাই দেশের নেতা যদি জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন না ঘটায়, তবে দেশের অবস্থা ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
নেতা নির্বাচনের সময়ই প্রার্থীর লেখাপড়া, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, মানবিক পর্যালোচনা করেই তাকে নির্বাচন করতে হবে। দানশীলতাও নেতার একটি বড় কাজ। উন্নয়নের টাকা চুরি করে দান করলে হবে না। তাই নেতার পারিবারিক অবস্থা, আর্থিক অবস্থায়ও নজর রাখতে হবে নেতা বানানোর পূর্বেই। গত ৫৪ বছরে কয়েকটি দল; বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেছে। কিন্তু আদর্শ নেতা তারা সমাজকে উপহার দিতে পারেনি। এমন কোনো দলের নেতা নেই, যাদের দুর্নীতিমুক্ত বলা যায়। জোট সরকারের সময় জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমীর শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ৫ বছর ৩টি মন্ত্রণালয় দুর্নীতিমুক্তভাবে চালিয়ে প্রমাণ করেছেন এ যুগেও সততার সাথে জনগণের সেবা করা যায়। তারপরও লেডি হিটলার হাসিনা এ দুই নেতাসহ শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা, শহীদ মীর কাসেম আলী, শহীদ কামারুজ্জামানের মতো সৎ, জনদরদি, দুর্নীতিমুক্ত নেতাদের ফাঁসি দিয়েছে অন্যায়ভাবে। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকেও একইভাবে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। কিন্তু আজ আদালতে প্রমাণিত হয়ে জামায়াতের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের কেস পর্যালোচনা করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ফাঁসির আদেশ থেকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন। নেতা যদি জনগণের কল্যাণে কাজ না করে, ব্যক্তিগত লোভ-লালসায় লিপ্ত হয়, তবে মানুষ ঐ নেতা থেকে কোনো কল্যাণ পেতে পারে না।
শুধু শেখ হাসিনা নিজেই খারাপ নেতার উদাহরণ হয়নি, তার সব এমপি, মন্ত্রী, আমলা, ব্যবসায়ীসহ মসজিদের ইমাম ও দুর্নীতিতে ভরা নেতাদেরও দেশ থেকে পালাতে হয়েছে। যা ইতিহাসে বিরল ঘটনা। মালয়েশিয়ার উন্নয়নের জনক মাহাথির মোহাম্মদ ১০০ বছর বয়সি নেতা হয়েছেন, নির্বাচনে পরাজয়ের পর দেশ থেকে পালাতে হয়নি। জামায়াতের লোকেরাও নির্বাচনে পরাজিত হয়ে দেশ থেকে পালাননি। দেশে-বিদেশে এমন উদাহরণ আরো আছে, একবার ক্ষমতায় আরেকবার বিরোধীদলে থাকার। কিন্তু হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের পালানোর উদাহরণ দুনিয়ায় একটাই। এবার আসি ১৮ কোটি মানুষের এ দেশকে একটি উন্নত, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজমুক্ত দেশ গড়ার জন্য আদর্শ নেতা বানানোর পরিকল্পনা জামায়াত-শিবিরের কি আছে? জামায়াত ও ছাত্রশিবির এ দেশে আদর্শ নেতা বানানোর জন্য কি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে? বলতে হবে হ্যাঁ, তারা পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে।
আওয়ামী দুঃশাসনের খুন, গুম, নির্যাতনের পরও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক, হাসপাতালসহ দেশের মানুষকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দেয়ার জন্য হাজারো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে; যা গত ৫৪ বছরে দেশের মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। যোগ্যতার সাথে দুর্নীতিমুক্ত থেকেই জামায়াত-শিবিরের তৈরি করা সৎ ও যোগ্য লোক দিয়ে এ প্রতিষ্ঠানগুলো চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যেই নেতা বানানোর উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে বিপুল ভোটের ব্যবধানে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে মাত্র ১ মাসের মধ্যে ইউনিভার্সিটি এলাকায় দারুণ ভূমিকা রেখে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশংসায় ভাসছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এমন নেতা দেখা যায়নি এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়েও এমনই বিজয় পাবে শিবিরের কারখানায় তৈরি যোগ্য নেতার আবির্ভাবে, ইনশাআল্লাহ।
জাতীয় নির্বাচনের কাজ এগিয়ে চলছে। আশা করা যায়, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে। তবে নির্বাচনের পূর্বেই ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিচার, জুলাই সনদের আইনগত স্বীকৃতি, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ আচরণ অবশ্যই বাস্তবে জনগণের কাছে প্রকাশ্য হতে হবে। বিচারের কাজ এগোচ্ছে। ইতোমধ্যেই কয়েকটি মামলার বিচার শেষ পর্যায়ে। গুমের মামলার তদন্তে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ পেয়েছে, যা দুনিয়ার ইতিহাসে নির্যাতনের কলাকৌশলে বিরল তথ্য আবিষ্কার হয়েছে। আয়নাঘরের বিবরণ দিতে গিয়ে একজন মহিলা আর্মি অফিসার কথিত বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে হাসিনার গোপন কক্ষে যাতায়াতের এবং হাতে খাম ধরিয়ে দেওয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছেন, যা আপনারা মিডিয়ার বিভিন্ন খবর নিলে জানতে পারবেন। যদিও দীর্ঘদিন পূর্বেই মরহুম ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন আমাকে এ নেতাদের হাসিনার থেকে প্যাকেট পাওয়ার তথ্য দিয়েছিলেন। তাই নেতা সৎ, যোগ্য ও লোভ-লালসাহীন না হলে দল বা দেশ ভালোভাবে চালানো সম্ভব নয়।
আগামীতে সর্বক্ষেত্রে সৎ-যোগ্য নেতা নির্বাচনের বিকল্প নেই। দেশের ৩০০ আসনে ইতোমধ্যেই জামায়াত প্রার্থী ঘোষণা করেছে তাদের কারখানায় তৈরি সৎ-যোগ্য প্রার্থী দিয়ে। তারা জনগণের কাছে তাদের নির্বাচনী কর্মকাণ্ড নিয়ে দ্রুততার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছেন, জনগণ যদি তাদের দেশ সেবার সুযোগ দেয়, তবে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠেই দেশের ও দশের উন্নয়নে কাজ করবেন। যিনি আপনার এলাকার নেতা নির্বাচিত হবেন, তার আচার-আচরণ তো আপনাদের কাছে জানা। তার আয়-ব্যয়, তার আচার-ব্যবহার, তার অতীত বিচার করেই আগামীতে নেতা নির্বাচন করতে হবে। যারা নির্বাচনের পূর্বেই বাজারঘাট, ফুটপাত দখল-বাণিজ্য করছে, তাদের ভোট দেয়া যাবে না। এ সময় যারা আগামীতে জনসেবা করার চিন্তা করছেন, তাদের সব নেগেটিভ কাজ ও কথা থেকে বিরত থাকতে হবে। অতিরঞ্জিত কাজ ও কথা থেকেও বিরত থাকতে হবে। আমরা যারা দাঈ ইলাল্লাহর ভূমিকায় কাজ করতে চাই, তাদের সজাগ দৃষ্টিতে চলতে হবে। আমাদের ভুল ধরা বা পায়েপাড়া দিয়ে ঝগড়া করার লোকের অভাব নেই। জনগণের কাছে পজিটিভ দাওয়াত দিলে জনগণই তাদের প্রত্যাখ্যান করবে। যারা যোগ্য নেতা হিসেবে আগামী দিনে নির্বাচন করতে নমিনেশন পেয়েছেন বা পাবেন, তাদের সততার সাথে, যোগ্যতার সাথে জনগণের ভালোবাসা নিয়েই মাঠে থাকতে হবে। ছাত্র-তরুণ ভোটারদের প্রাধান্য দিয়ে দাওয়াত দিতে হবে। ডাকসুসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন ছাত্র-ছাত্রীদের বিপুল ভোটে বিজয় এসেছে এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সংসদেও শিবির প্যানেল জয়ী হবে, ইনশাআল্লাহ। এসব ভোটার কিন্তু গোটা দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। তারাই আগামী জাতীয় নির্বাচনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে, ইনশাআল্লাহ। বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য, যারাই লাফালাফি করুক, জনগণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। আর অতীতের বস্তাপচা নেতৃত্ব চায় না। তারা এবার ইসলামের পক্ষে ভোট দেবে। আমাদের দায়িত্ব যার যার এলাকার ভোটারদের কাছে পৌঁছা এবং ইসলামের আলোকে সৎ লোকের শাসনের জন্য তৈরি করা। জামায়াতের ক্ষেত্রে দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছেই যেতে হবে।
মহান আল্লাহ তায়ালা ৫ আগস্ট যেভাবে স্বৈরাচারমুক্ত করেছেন এ দেশটাকে। তিনিই আমাদের এ দেশটাকে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে একটি আদর্শ দেশ গড়ার ব্যবস্থা করে দেবেন, যদি আমরা তারই গোলাম হয়ে তাঁর কাছেই সাহায্য চাই।
গুজব থেকে মুক্ত থাকতে হবে। যারা নেতৃত্ব দেবেন, তাদের এলাকায় সত্য ও মিথ্যার বেড়াজাল ভেদ করেই সত্য প্রচারে মগ্ন থেকে জনগণকে মুক্তির দিশা দিতে হবে।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।