হিন্দুত্ববাদী ভারতের সঙ্গে তালেবানের মৈত্রীপূর্ণ সম্পর্ক কতদিন টিকবে?


১৬ অক্টোবর ২০২৫ ১৩:৩৭

॥ ফেরদৌস আহমদ ভূইয়া ॥
ভারত বিগত তিন দশক ধরেই তালেবানকে সন্ত্রাসী অভিহিত করে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করা থেকে শুরু করে চতুর্মুখী বিরোধিতাই করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সাথে তালেবানের দোহার শান্তি আলোচনারও বিরোধিতা করেছিল ভারত। ১৯৯৬ সালে যখন তারা প্রথম ক্ষমতায় আসে, তখন তালেবানদের উৎখাত করতে নর্দান অ্যালায়েন্সকেই সহযোগিতা করেছে। ভারত শুধু তালেবানবিরোধী নীতিই গ্রহণ করেই থেমে থাকেনি ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত তালেবানবিরোধী সরকারকে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা করেছে অব্যাহতভাবে। আবার ২০২১ সালে তালেবানরা দ্বিতীয়বার আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে, তখন ভারত কাবুলে তার দূতাবাস গুটিয়ে চলে আসতে বাধ্য হয়। এমনি একটি পরিস্থিতিতে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকীর ভারতে আট দিনের সফর অকল্পনীয় এবং মুসলিম বিশ্বের কাছে অপ্রত্যাশিতও বটে। ভারতের সাথে তালেবান সরকারের এতো মাখামাখি মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্র ও সাধারণ জনগণ ভালোভাবে নেয়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুসলিমরা তালেবানের এ ধরনের পদক্ষেপের কঠোর সমালোচনা করে নিন্দা জানাচ্ছে। এমতাবস্থায় হিন্দুত্ববাদী ভারতের সঙ্গে তালেবানের এ মৈত্রীপূর্ণ সম্পর্ক কী টিকবে?
মুসলিম বিশ্বের সহযোগিতায় তালেবানের পুনরায় ক্ষমতায় : তালেবানরা যখন পশ্চিমা শক্তিসহ দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ শক্তি ভারতের বিরোধিতার মুখে টিকতে পারছিল না তখন পাকিস্তানসহ বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশই এগিয়ে আসে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম পরাশক্তি পাকিস্তানের সার্বিক সহযোগিতা ও মুসলিম বিশ্বের সমর্থনেই তালেবানরা আফগানিস্তানে পুনরায় ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে। পাকিস্তানের পাশাপাশি ইরান, কাতার ও সৌদি আরবও তালেবানদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে সহযোগিতা করেছে। অথচ সেই তালেবানরা মুসলিম উম্মাহর চিরশত্রু ভারতের বিজেপি সরকারের সাথে মিত্রতা স্থাপন করছে। মিত্রতা স্থাপনের লক্ষ্যে গত সপ্তাহে আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকী ভারত সফর করেছেন। মুত্তাকী যখন ভারত সফর করেছেন, তখনই পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে হামলা ও পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলেই আফগানিস্তানের তালেবান গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। রুশ দখলদারিত্ব থেকে আফগানিস্তান উদ্ধারে পাকিস্তানই তালেবানদের প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে অর্থ ও অস্ত্র যোগান দিয়েছে। পাকিস্তানের ভূমি ব্যবহার করেই আফগান তালেবানরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের সব প্রস্তুতি গ্রহণ করে। অবশ্য তালেবানদের চরমপন্থার কারণে পাকিস্তান একসময় তাদের থেকে দূরে সরে আসে।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তান ভ্রাতৃপ্রতিম দুই দেশের মধ্যে সংঘাতের কারণে আঞ্চলিক শক্তি ইরান সৌদি আরব ও কাতার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। তারা পৃথক পৃথক বিবৃতিতে ইসলামাবাদ ও কাবুলকে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে তাদের ইস্যুগুলো সমাধানে সংলাপ করতে বলেছে। অবশ্য তাদের আহ্বানে দুই দেশই যুদ্ধ বন্ধ করেছে।
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে উভয় পক্ষকে সংলাপ ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে অগ্রাধিকার দিতে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতে বলেছে।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে যে, ইরান তার চারপাশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখাকেই গুরুত্ব প্রদান করে। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ইরান দুই প্রতিবেশী ও মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনে যেকোনো সহযোগিতা প্রদান করতে প্রস্তুত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাইয়েদ কারিবুল্লাহ সাদাত বলেছেন, বর্তমানে যুদ্ধ অব্যাহত থাকা মানে সব দেশের জন্যই ক্ষতিকর। এটার সমাধান নির্ভর করছে পাকিস্তানে অবস্থিত আফগান দূতাবাস ও কাবুলে পাকিস্তান দূতাবাসের মাধ্যমে পারস্পরিক সমঝোতা ও যোগাযোগের ওপর।
আফগানিস্তানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সৌদি আরব ও কাতারের আহ্বানে আমরা যুদ্ধ বন্ধ করেছি। তবে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে পুনরায় কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে আফগানিস্তান যথাযথ জবাব দেবে।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি বলেছেন, তার দেশ জাতীয় স্বার্থ ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি আরো বলেন, ভারত-সমর্থিত খারেজি সন্ত্রাসীরা আফগানিস্তানের ভূখণ্ড থেকেই এ হামলা চালিয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের মনিটরিং রিপোর্ট দ্বারাই তা প্রমাণিত।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুহসিন নাকভি দাবি করেছেন যে, আফগান বাহিনী পাকিস্তানের ভূখণ্ডে হামলা চালিয়েছে যা আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন।
আফগানিস্তান আপাতত তাদের দিক থেকে যুদ্ধ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকী। গত ১২ অক্টোবর রোববার নয়াদিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
মুত্তাকী বলেন, আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো- যার মধ্যে কাতার, সৌদি আরব অনুরোধ করে বলেছে, এই সমস্যার একটা সমাধান দরকার। সেজন্য আমরা আমাদের থেকে আপাতত অভিযান বন্ধ রেখেছি। তিনি আরো বলেন, পাকিস্তান যদি শান্তি ও সুসম্পর্ক না চায়, তাহলে আফগানিস্তান অন্যান্য বিকল্পই গ্রহণ করবে।
ওয়াশিংটনের গবেষণা কেন্দ্র কুইন্স ইনস্টিটিউটের আফগানিস্তান ও পাকিস্তান বিশ্লেষক অ্যাডাম ওয়েইনস্টাইন বলেন, গত ১১ অক্টোবর শনিবারের সংঘর্ষ মাত্র কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হয়েছিল। তাঁর মতে, সম্ভবত এর কারণ উভয় দেশই উত্তেজনা আরও বাড়ার বিষয়ে সতর্ক থাকতে পারে। ‘পাকিস্তান এখনো কোনো ধরনের শাসন পরিবর্তনে জড়িত হতে চায় না, তবে তালেবানরা জানে, লড়াই আরও এগিয়ে নিলে তারা পাকিস্তানিদের দ্বারা পরাজিত হবে।’
তবে ১৪ অক্টোবর মঙ্গলবার শেষ খবরে জানা গেছে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের উভয় দেশের মধ্যে আবার পাল্টাপাল্টি হামলা হয়েছে। কাবুল থেকে প্রেরিত শীর্ষস্থানীয় একটি পত্রিকার খবরে জানা গেছে, অস্ত্রবিরতি ভেঙে গত মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) ভোর থেকে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান পাল্টাপাল্টি রকেট হামলা চালিয়েছে। কাবুলে বিভিন্ন সূত্র থেকে এমন তথ্য জানা গেছে। স্থানীয় সাংবাদিকদের ভাষ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার ভোর ৪টা নাগাদ দক্ষিণ আফগানিস্তানের কান্দাহার প্রদেশের শুরাবাক জেলায় রকেট হামলা চালায় পাকিস্তান। তবে হামলায় তাৎক্ষণিক হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
আফগান সূত্র জানায়, প্রথমে পাকিস্তানের দিক থেকে হামলা চালানো হয়। জবাবে ইসলামী আমিরাতের সরকার নতুন করে পাকিস্তানি চৌকি এবং অবস্থানের ওপর পাল্টা রকেট হামলা চালায়।
এই রকেট হামলা প্রমাণ করছে, কাতার ও ইরানের পরামর্শে যে অস্ত্রবিরতি শুরু হয়েছিল, তা ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই ভেঙে পড়ল। এতে অস্ত্রবিরতির ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা প্রশ্নও দেখা দিল। অবশ্য এর আগে সোমবার দুই পক্ষ থেকেই অস্ত্রবিরতিকে স্বাগত জানানো হয়েছিল।
পাশাপাশি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আফগানিস্তানের বিষয়ে যে ধরনের মন্তব্য করেছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে, দুই দেশের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি হচ্ছে। গত কয়েক বছরে তালেবান নেতৃত্বাধীন ইসলামী আমিরাতের সরকারকে ‘অন্তর্র্বর্তী বা আফগানিস্তানের সরকার’ বলে অভিহিত করেছে ইসলামাবাদ। তবে গত রোববার থেকে তারা আফগান সরকারকে কার্যত পাকিস্তান নির্ধারিত সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, পাকিস্তানের ওপর সাম্প্রতিক সময়ে একসঙ্গে হামলা চালিয়েছে আফগান তালেবান, তেহরিক-ই-তালেবান (টিটিপি) এবং বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। অর্থাৎ আফগান সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ মন্তব্য নিয়ে এখনো আমিরাতের সরকার কোনো মন্তব্য করেনি।
তালেবানের সাথে ভারতের তিন দশকের তিক্ত সম্পর্ক
তালেবান সরকার ও তালেবানের সাথে কোনো সময়ই ভারতের সম্পর্ক ভালো ছিল না। বরং সবসময়ই তালেবানের সাথে ভারতের সম্পর্ক ছিল বৈরি। তার মূল কারণ ছিল তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা। ১৯৯৬ -২০০১ সালে প্রথম তালেবান সরকারকে উৎখাতে নর্দান অ্যালায়েন্সকেই সমর্থন দিয়েছিল দিল্লি। তারপর ২০০১ সাল থেকে যখন আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর উপস্থিতি ছিল, তখনো ভারত তালেবানবিরোধী নীতি গ্রহণ করে এবং তালেবানকে সন্ত্রাসী বাহিনী বলেই অভিহিত করতো। যুক্তরাষ্ট্র যখন দোহায় তালেবানের সাথে শান্তি আলোচনা করে, তখনো ভারত এটার বিরোধিতা করে। শুধু তাই নয়, ২০২১ সালে তালেবানের কাবুল দখলের পর ভারত তার দূতাবাস ফেলে চলে আসে।
গত চার বছর আগে ২০২১ সালের আগস্ট মাসে তালেবানের এক নেতা আফগানিস্তানে সৈন্য প্রেরণ নিয়ে ভারতকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে তালেবান। ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনই হুঁশিয়ারি দিলেন তালেবানের মুখপাত্র মুহাম্মদ সোহেল শাহীন।
আফগানিস্তানে ভারত যদি নিজেদের উপস্থিতির জানান দেয়, তবে তা তাদের জন্য ভালো হবে না। এএনআইকে সুহেল শাহিন বলেন, ‘যদি ওরা (ভারত) আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠায়, তাহলে তা তাদের জন্য ভালো হবে না। আগে যারা সামরিক শক্তি নিয়ে এখানে এসেছে, তাদের ভবিতব্য দেখেছে ভারত। তো এটা তাদের জন্য খোলা বই।’
এমনি একটি পরিস্থিতিতে কাবুলের সাথে দিল্লির সম্পর্কের উন্নয়ন আশা করা ছিল দুরাশা। অতীতের তিক্ততা ও আদর্শগত ব্যবধানের পাশাপাশি পাকিস্তানের ভৌগোলিক উপস্থিতি ছিল দুই পক্ষের মধ্যে এক কঠিন প্রাচীর।
আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর
আফগান পররাষ্টমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকী আট দিনের সফরে ভারত গিয়েছেন। তিনি এ সফরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সাথে সিরিজ বৈঠক করেছেন। ২০২১ সালে তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পর এটা হচ্ছে উচ্চপর্যায়ের সফর। এ সফরে মুত্তাকী ভারতের কর্মকর্তাদের সাথে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিষয়ে আলোচনা করেছেন। মুত্তাকীর সাথে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক শেষে জয়শঙ্কর বলেছেন, তারা শিগগিরই কাবুলে ভারতের দূতাবাস চালু করবেন। তালেবানরা পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর দিল্লি তাদের কাবুল দূতাবাস বন্ধ করে চলে এসেছিল।
মি. জয়শঙ্কর বলেছেন, ‘আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা আফগানিস্তানের জাতীয় উন্নয়নের পাশাপাশি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং স্থিতিস্থাপকতায় অবদান রাখে।’ তিনি ‘আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং স্বাধীনতার প্রতি ভারতের পূর্ণ প্রতিশ্রুতি’ নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে মুত্তাকী ভারতকে ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ বলে অভিহিত করেছেন এবং আরও বলেছেন যে তার সফর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত করবে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, ইসলামাবাদ, দিল্লি ও তালেবান কেউই আন্দাজ করতে পারে নাই যে তালেবানের ক্ষমতা গ্রহণের পর এতো দ্রুত ইসলামাবাদের সাথে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে ভারতের সাথে সম্পর্ক পুনস্থাপন হবে।
কারা এ তালেবান
তালেবান শব্দটি পশতু ভাষা, পশতু ভাষায় তালেবান অর্থ হচ্ছে ছাত্র। ১৯৯০-র দশকের শুরুতে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান থেকে পিছু হটে, তখন পাকিস্তানে এ তালেবান আন্দোলনের জন্ম নেয়। মূলত মাদরাসাগুলোতেই তালেবানরা প্রথম সংগঠিত হয়। এ আন্দোলনে মূলত পশতুন অর্থাৎ পশতু ভাষাভাষীদেরই প্রাধান্য। পাকিস্তান ও আফগানিস্তান এ দুই দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পশতুভাষীদের বসবাস। আফগানিস্তানে প্রায় ১০ লাখ লোক এই ভাষায় কথা বলে। এরা সবাই পশতুন জাতির লোক। পাকিস্তানে আরও প্রায় ৯৫ লাখ লোক পশতু ভাষায় কথা বলেন।
১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান আক্রমণের পর থেকে আফগান মুজাহিদীনদের মধ্যে বিভিন্ন ইসলামিক গোষ্ঠী তৈরি হতে শুরু করে। এদের মধ্যে একটি ছিল তালেবান, যারা মূলত আফগানিস্তানের মাদরাসাগুলোয় পড়াশোনা করা ছাত্রদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল।
তালেবানদের প্রথম ক্ষমতা গ্রহণ
১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তারা দেশের বেশিরভাগ অংশ দখল করে নেয় এবং ১৯৯৬ সালে তালেবানরা অধ্যাপক বুরহানউদ্দিনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত একটি নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে কাবুলের ক্ষমতা গ্রহণ করে। বুরহানউদ্দিন রব্বানী ছিলেন আফগান মুজাহিদ বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম সংগঠক ও নেতা।
তৎকালীন তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিলো মাত্র তিনটি দেশ: পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত।
একটি বিষয় অঘোষিতভাবে আলোচিত যে পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি জিয়া-উল- হক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগানদের যুদ্ধ করার জন্য যাবতীয় ট্রেনিং, অস্ত্র, অর্থ দিয়েছিল। আনুমানিক ১০ লাখ আফগানকে আশ্রয় দিয়েছিল পাকিস্তানে।
তালেবান সরকারের পতন
২০০১ সালে আল কায়েদা ও বিন লাদেনের ইস্যু নিয়ে আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের পর দ্রুত তালেবান সরকারের পতন ঘটে। কারণ মার্কিন বিমান বাহিনীর নিরবিচ্ছিন্ন বোমা হামলা এবং মার্কিন-সমর্থিত তালেবানবিরোধী বিশেষ বাহিনীর অভিযান মোকাবিলা করার মতো সামর্থ্য তৎকালীন তালেবান সরকারের ছিল না। এর ফলে সে বছরের নভেম্বরের মধ্যেই তারা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়। আগ্রাসনে আনুমানিক ৮,০০০ থেকে ১২,০০০ তালেবান নিহত হন, যা তার বাহিনীর মোট জনশক্তির ২০ শতাংশ ছিল। এরপর আফগানিস্তান ইসলামী আমিরাতের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যায় এবং মোল্লা ওমরসহ তালেবানের অধিকাংশ বড় বড় নেতাই আত্মগোপনে চলে যান।
২০০১-২০২১ ক্ষমতার বাইরে তালেবান
২০০১ সালে মার্কিন আগ্রাসনের পর কার্যত তালেবান আন্দোলন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। মার্কিন হামলায় বেঁচে যাওয়া তালেবান সদস্যরা পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং অধিকাংশই লোকালয় ছেড়ে পাহাড় পর্বত বা পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে যায়। প্রায় ২ বছর যাবত তারা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। পরবর্তী ২০০৩ সালের মে এবং জুন মাসে উচ্চ তালেবান নেতারা একত্র হতে সক্ষম হয় এবং তারা ঘোষণা করেন যে, তালেবান যোদ্ধারা পুনরায় সংগঠিত হয়েছে এবং তারা আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও তার অধীনস্থ ন্যাটোর বাহিনীকে বিতাড়িত করার জন্য গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে।
পুনরায় ক্ষমতায়, তবে ম্যান্ডেট নেই জনগণের
তারপর দুই দশকের গেরিলা যুদ্ধের পর ২০২১ সালে তালেবানরা দ্বিতীয়বার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে। তালেবানরা ক্ষমতায় আসলে কাবুল বিশ্বের একটি দেশ ছাড়া কোনো দেশই কূটনৈতিক স্বীকৃতি পায়নি। যে বিজেপি সরকারের সাথে তালেবানরা বিশেষ সম্পর্ক গড়তে চাচ্ছে, সেই ভারত এখনো বর্তমান তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। পাকিস্তানসহ মিত্র দেশগুলো আফগানিস্তানের বর্তমান তালেবান সরকারকে একটি অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবেই বিবেচনা করছে। তালেবানরা ৫ কোটি নাগরিকের আফগানিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করেছে কিন্তু গণরায় নেয়নি। বিগত চার বছর ধরে ক্ষমতায় থাকলেও আফগানিস্তানের তালেবান সরকার গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকার পরিচালনার কোনো ম্যান্ডেট নেয়নি। সরকার পরিচালনার জন্য সাধারণ জনগণের কোনো ম্যান্ডেট নেয়ারও কোনো পরিকল্পনা তালেবানদের আছে কিনা, তাও জানা যায়নি।
সূত্র : আল জাজিরা, বিবিসি ও টুলুনিউজ।