বন্যা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু এ দুর্যোগের মূলে প্রকৃতির বৈরী আচরণের চেয়ে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীই প্রধানত দায়ী। বন্যার অনেক কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- নদনদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ অথবা বাধাগ্রস্ত করা, দখল, দূষণ ও জলাশয় ভরাট করে অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা নির্মাণ। দুঃখজনক হলেও সত্য, এর সব কারণই দেশে বিদ্যমান।
যৌথ নদী কমিশন সূত্র বলছে, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রায় ৪০৫টি নদী প্রবাহিত হচ্ছে। এ নদীগুলোর মধ্যে ৫৭টি হচ্ছে আন্তঃসীমান্ত নদী। ৫৭টি আন্তঃসীমান্ত নদীর মধ্যে ৫৪টি নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং ৩টি এসেছে মিয়ানমার থেকে। ৫৪টির মধ্যে ৫১টি নদী বস্তুতপক্ষে তিনটি বৃহৎ নদী পদ্মা (গঙ্গা), ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনার অববাহিকাভুক্ত। এ তিনটি নদী অববাহিকার মোট আয়তন ১.৭২ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার, যার মাত্র ৭ শতাংশ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত। বর্ষা মৌসুমে পানির অতি আধিক্য এবং শুকনো মৌসুমে পানির স্বল্পতা আমাদের দেশের পানিসম্পদ ক্ষেত্রে এক রূঢ় বাস্তবতা। পানিসম্পদ সংক্রান্ত সকল পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন বহুলাংশে নির্ভর করে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অভিন্ন ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীর পানির যথাযথ বণ্টন ও ব্যবস্থাপনার ওপর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ভারতের দাদাগিরির কারণে ৫৪টি আন্তঃসীমা নদীর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়েও গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন সূত্র বলছে, আন্তজার্তিক আইন বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে ভারত ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যবহারের জন্য প্রায় ১ হাজার বাঁধ নির্মাণ করেছে। তারা ইচ্ছেমতো পানি আটকে রাখে, আবার ইচ্ছেমতো ছাড়ে। তাদের এমন পানি আগ্রাসনের কারণে আমরা শুষ্ক মৌসুমে পানি পাই না, আবার বর্ষাকালে বন্যায় ভাসি। ইচ্ছেমতো পানি আটকে দেয়ার কারণে নদনদীগুলো পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে পানির অভাবে ফসলি জমি উর্বরতা হারাচ্ছে। পানির প্রভাবে প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যাঘাত ঘটানোর কারণে নদনদীর তীর ভেঙে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন।
এবারও বর্ষকাল শুরু হচ্ছে। বন্যার আগাম আগমনবার্তায় আতঙ্কিত মানুষ। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত গত বুধবারের (১৯ জুনের) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুনামগঞ্জে নদনদীর পানি কিছুটা কমলেও হাওর এলাকায় বন্যার পানি হুহু করে বাড়ছে। গত ১৯ জুন বুধবার সুরমা নদীর পানি প্রবাহিত হয় ৪০ সে.মি ওপর দিয়ে। সুনামগঞ্জ পৌর শহরের নতুনপাড়া, শান্তিবাগ, ধোপাখালী, বাঁধনপাড়া, বলাকা, মোহাম্মদপুর, ষোলঘর, নবীনগর, কাজীর পয়েন্টসহ বিভিন্ন এলাকায় পানি বেড়েছে। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নিচু এলাকার মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে উঁচু স্থানে ছুটছেন। গত ১৮ জুন মঙ্গলবার অনেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছেন। সবার চোখে-মুখে ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার আতঙ্ক। সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন নিম্নআয়ের মানুষ। হাওর এলাকার বাড়িঘরের আঙিনায় পানি ছুঁইছুঁই করছে। পশুসহ পরিবার-পরিজন নিয়ে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে ছুটছেন তারা। এদিকে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। অব্যাহত পাহাড়ি ঢলে জেলার ছাতক, দোয়ারাবাজার, শান্তিগঞ্জ, জগন্নাথপুর, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, মধ্যনগর, দিরাই, শাল্লা, জামালগঞ্জ উপজেলার গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তবে এ বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছাতক, দোয়ারাবাজার ও সদর উপজেলা।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সূত্রে জানা যায়, ১৮ জুন মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত জেলার দুটি পৌরসভাসহ ৭৭ ইউনিয়নের ৭৮১টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বন্যাকবলিত লোকসংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ৭ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। এর মধ্যে ছাতক উপজেলার ৫ হাজার জন। শুধু সুনামগঞ্জ, সিলেট এলাকা নয়, যমুনার পানি বাড়া অব্যাহত থাকায় বিপাকে পড়েছেন সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুরের চরাঞ্চলের মানুষ।
আমরা মনে করি, বন্যা ভয়াবহ রূপ নেয়ার আগেই আমাদের সাবধান হতে হবে। মানুষকে সতর্ক করার সাথে সাথে তাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় ও সুষম খাদ্য ও পানীয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমানো এবং ভবিষত্যের ক্ষতি থেকে দেশ রক্ষা করতে ভারতের সাথে আলোচনা অব্যাহত রাখার সাথে সাথে আন্তর্জাতিক আদালতসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে এ সমস্যা তুলে ধরতে হবে। তবেই এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব বলে আমরা মনে করি।
এ পাতার অন্যান্য খবর
এ বিভাগ বা পাতায় আর কোন সংবাদ, কবিতা বা অন্যকোন ধরণের লেখা পাওয়া যায়নি।