রেজি : ডিএ ৫১৭ ॥ ৬৩ বর্ষ : ৮ম সংখ্যা ॥ ঢাকা, শুক্রবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ॥ ৮ জিলকদ ১৪৪৫ হিজরী ॥ ১৭ মে ২০২৪

ড. মুহাম্মদ খলিলুর রহমান


পর্ব-১
প্রাথমিক কথা : আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অগণিত সৃষ্টিজগতের মাঝে মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ জীব। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দিয়ে সমাজ পরিচালনা, খেলাফত প্রতিষ্ঠা, সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যে মানুষের সমাজ পরিচালনার শপথ করিয়েছিলেন মূলত রূহজগৎ থেকেই এবং সেদিন বলেছিলেন, ‘আমি কি তোমাদের রব (তথা আইনদাতা বিধানদাতা, ত্রাণকর্তা, প্রাণকর্তা, রিজিকদাতা, হুকুমদাতা শাসনকর্তা) নই? (সমস্ত মানুষের রুহ সেদিন এক বাক্যে বলেছিল) অবশ্যই আপনি আমাদের রব।’ -সূরা আ’রাফ : ১৭২।
তিনি মানুষ সৃষ্টির পর মানুষকে মানবতার মহান মিশন দিয়ে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের সামনে আদি পিতা আদম আ.কে সৃষ্টির বিশেষ পরিকল্পনা জানান দিয়ে আদম- হাওয়াকে (আ.) দুনিয়ায় প্রেরণ এবং আদম-হাওয়ার মাধ্যমে বংশবিস্তার, কিয়ামত পর্যন্ত মানবতাকে সমুন্নত রাখার নির্দেশনা দেন। তিনি তাঁর এ জমিনে তাঁরই আইন ও বিধান মতে জীবন, পরিবার, সমাজ ও দেশ গঠনের স্থায়ী মিশন দিয়েই মানুষকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। মানবজীবনের সর্বস্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সমাজকে শান্তিপূর্ণ ও আবাসযোগ্য করার নিমিত্তে মানুষ মানুষের জন্য কাজ করবেÑ এটিকে মানবতা বলা হয়েছে। প্রথম মানুষ আদি পিতা হযরত আদম (আ.)-কে আল্লাহ সব বিষয়ের জ্ঞান ও যোগ্যতা দান করেন এবং বিশ্বে আল্লাহর খেলাফত পরিচালনার মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। সঙ্গে সঙ্গে সকল সৃষ্ট বস্তুকে করে দেন মানুষের অনুগত।
মানব সৃষ্টির গোড়ার কথা: মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী, আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদের বিভিন্ন বংশ ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যেন তোমরা পরস্পর পরিচিতি লাভ করতে পারো।’ (সূরা হুজুরাত : ১৩)। “স্মরণ কর সেই সময়ের কথা, যখন তোমার প্রভু ফেরেশতাদের বললেন, আমি মিশ্রিত পচা কাদার শুকনো মাটি দিয়ে ‘মানুষ’ সৃষ্টি করব। অতঃপর যখন আমি তার অবয়ব পূর্ণভাবে তৈরি করে ফেলব ও তাতে আমি আমার রূহ ফুঁকে দেব, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদায় পড়ে যাবে।” (হিজর : ২৮-২৯)। প্রথম পর্যায়ে মাটি থেকে সরাসরি আদমকে অতঃপর আদম থেকে তার স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করার পরবর্তী পর্যায়ে আল্লাহ আদম সন্তানদের মাধ্যমে বনি আদমের বংশ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেছেন। এখানেও রয়েছে সাতটি স্তর। যেমন : মৃত্তিকার সারাংশ তথা প্রোটোপ্লাজম, বীর্য বা শুক্রকিট, জমাট রক্ত, মাংসপিণ্ড, অস্থিমজ্জা, অস্থি পরিবেষ্টনকারী মাংস এবং সব শেষে রূহ সঞ্চারণ (মুমিনূন : ১২-১৪, মুমিন ৪০/৬৭, ফুরকান : ৪৪, তারেক : ৫-৭)।
মাটির সকল উপাদানের সার নির্যাস একত্রিত করে আঠালো ও পোড়ামাটির মতো শুষ্ক মাটির তৈরি সুন্দরতম অবয়বে রূহ ফুঁকে দিয়ে আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আদম (আ.)-এর পাঁজর থেকে তার স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করেন। আর এ কারণেই স্ত্রী জাতি স্বভাবগতভাবেই পুরুষ জাতির অনুগামী ও পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট। অতঃপর স্বামী-স্ত্রীর মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে একই নিয়মে মানব বংশ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী। সেদিন থেকে মানুষ পূর্ণ চেতনা ও জ্ঞানসম্পন্ন সভ্য মানুষ হিসেবেই যাত্রারম্ভ করেছে এবং আজো সেভাবেই তা অব্যাহত রয়েছে। ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমাদের মাতৃগর্ভে আকার-আকৃতি দান করেছেন, যেমন তিনি চেয়েছেন। তিনি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। তিনি মহাপরাক্রান্ত ও মহাবিজ্ঞানী।’ (আলে ইমরান : ৬)। তিনি আরও বলেন, ‘তিনি তোমাদেরকে তোমাদের মাতৃগর্ভে সৃষ্টি করেন একের পর এক স্তরে তিনটি অন্ধকারাচ্ছন্ন আবরণের মধ্যে।’ (যুমার : ৬)। তিনটি আবরণ হলোÑ পেট, রেহেম বা জরায়ু এবং জরায়ুর ফুল বা গর্ভাধার। উপরোক্ত আয়াতগুলোয় আদম সৃষ্টির তিনটি পর্যায় বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমে মাটি দ্বারা অবয়ব নির্মাণ, অতঃপর তার আকার-আকৃতি গঠন ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহে শক্তির আনুপতিক হার নির্ধারণ ও পরস্পরের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান এবং সব শেষে তাতে রূহ সঞ্চার করে আদমকে অস্তিত্বদান। অতঃপর আদমের অবয়ব (পাঁজর) থেকে কিছু অংশ নিয়ে তার জোড়া বা স্ত্রী সৃষ্টি করা। সৃষ্টির সূচনা পর্বের এ কাজগুলো আল্লাহ সরাসরি নিজ হাতে করেছেন। (ছোয়াদ : ৭৫)। মাতৃগর্ভের তিন তিনটি গাঢ় অন্ধকার পর্দার অন্তরালে এভাবে দীর্ঘ ৯ মাস ধরে বেড়ে ওঠা প্রথমত একটি পূর্ণ জীবন সত্তার সৃষ্টি, অতঃপর একটি জীবন্ত প্রাণবন্ত ও প্রতিভাবান শিশু হিসেবে দুনিয়ায় ভূমিষ্ঠ হওয়া কতই না বিস্ময়কর ব্যাপার। কোনো মানুষের পক্ষে এ অনন্য-অকল্পনীয় সৃষ্টিকর্ম আদৌ সম্ভব কি? মাতৃগর্ভের ঐ অন্ধকার গৃহে মানবশিশু সৃষ্টির সেই মহান কারিগর কে? সেই মহান শিল্পী, যিনি রক্তপিণ্ড আকারের জীবন টুকরাটিকে মাতৃগর্ভে পুষ্ট করেন? অতঃপর ১২০ দিন পর তাতে রূহ সঞ্চার করে তাকে জীবন্ত মানবশিশুতে পরিণত করেন এবং পূর্ণ-পরিণত হওয়ার পর সেখান থেকে বাইরে ঠেলে দেন। (আবাসা : ১৮-২০)।
পুরুষ ও নারীর সংমিশ্রিত বীর্যে সন্তান জন্মলাভের তথ্য কুরআনই সর্বপ্রথম উপস্থাপন করেছে। (সূরা দাহর : ২)। আধুনিক বিজ্ঞান এ তথ্য জনতে পেরেছে মাত্র গত শতাব্দীতে ১৮৭৫ সালে ও ১৯১২ সালে। তার পূর্বে এরিস্টটলসহ সকল বিজ্ঞানীর ধারণা ছিল যে, পুরুষের বীর্যের কোনো কার্যকারিতা নেই। রাসূলের হাদীস বিজ্ঞানীদের এ মতকে সম্পূর্ণ বাতিল ঘোষণা করেছে। [মুত্তাফাক আলাই, মিশকাত হা/৪৩৩-৪৩৪ ‘পবিত্রতা’], কেননা সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, সন্তান প্রজননে পুরুষ ও নারী উভয়ের বীর্য সমানভাবে কার্যকর। এ কারণেই আল্লাহ অহংকারী মানুষকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘মানুষ কি দেখে না যে, আমরা তাকে সৃষ্টি করেছি শুক্রবিন্দু থেকে? অতঃপর সে হয়ে গেল প্রকাশ্যে বিতণ্ডাকারী’। ‘সে আমাদের সম্পর্কে নানারূপ দৃষ্টান্ত বর্ণনা করে। অথচ সে নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে ভুলে যায়, আর বলে যে, কে জীবিত করবে এসব হাড়গোড়সমূহকে, যখন সেগুলো পচে-গলে যাবে? (ইয়াসিন : ৭৭-৭৮)। প্রথমে মাটি দ্বারা অবয়ব নির্মাণ, অতঃপর তার আকার-আকৃতি গঠন ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহে শক্তির আনুপতিক হার নির্ধারণ ও পরস্পরের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান এবং সব শেষে তাতে রূহ সঞ্চার করে আদমকে অস্তিত্বদান। অতঃপর আদমের অবয়ব (পাঁজর) থেকে কিছু অংশ নিয়ে তার জোড়া বা স্ত্রী সৃষ্টি করা। সৃষ্টির সূচনা পর্বের এ কাজগুলো আল্লাহ সরাসরি নিজ হাতে করেছেন। (ছোয়াদ : ৭৫)।
সূচনা থেকে এযাবৎ এ দীর্ঘ পথপরিক্রমায় মানুষ কখনোই মানুষ ব্যতীত অন্য কিছু ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে চার্লস ডারউইন বলে মানুষ বানর বা উল্লুকের বিবর্তিত রূপ। যে ‘বিবর্তনবাদ’  (Theory of Evolution) পেশ করেছেন, তা বর্তমানে একটি মৃত মতবাদ মাত্র এবং তা প্রায় সকল বিজ্ঞানী কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
মানবদরদিই প্রকৃত মানুষ : সৃষ্টিকুলের সামগ্রিক কল্যাণ সাধন, বিশ্বব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ, মানবতার কল্যাণে সবকিছু সুচারুরূপে ও কার্যকরভাবে পালন যিনি করবেন তিনিই প্রকৃত মানুষ।
‘এরা এমন সব লোক, যাদের আমি যদি পৃথিবীতে কর্তৃত্বদান করি, তাহলে এরা সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং খারাপ কাজ করতে নিষেধ করবে। আর সব বিষয়ের পরিণাম আল্লাহর হাতে।’ -সূরা আল-হজ : ৪১।
 ‘তোমাদের মধ্যে এমন কিছু লোক অবশ্যই থাকতে হবে, যারা নেকী ও সৎকর্মের দিকে আহ্বান জানাবে, ভালো কাজে নির্দেশ দেবে ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে। যারা এ দায়িত্ব পালন করবে, তারাই সফলকাম হবে।’ -সূরা আলে-ইমরান : ১০৪।
 ‘হে ঈমানদারগণ! ইনসাফের পতাকাবাহী ও আল্লাহর সাক্ষী হয়ে যাও, তোমাদের পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে গেলেও। উভয়পক্ষ ধনী বা অভাবী যাই হোক না কেন, আল্লাহ তাদের চেয়ে অনেক বেশি কল্যাণকামী। সুতরাং নিজেদের কামনার বশবর্তী হয়ে ইনসাফ থেকে বিরত থেক না। আর যদি তোমরা পেঁচালো কথা বল অথবা সত্যতাকে পাশ কাটিয়ে চলো, তাহলে জেনে রাখো, তোমরা যা কিছু করছো, আল্লাহ তার খবর রাখেন।’ -সূরা আন-নিসা : ১৩৫।
‘হে ঈমানদারগণ! সত্যের ওপর স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত ও ইনসাফের সাক্ষ্যদাতা হিসেবে অটল থাকবে। কোনো দলের শত্রুতা তোমাদের যেন এমন উত্তেজিত না করে দেয়, যার ফলে তোমরা ইনসাফ থেকে সরে যাও। ইনসাফ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত করো এবং আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ তা সম্পর্কে জ্ঞাত’। -সূরা আল-মায়েদা : ৮।
‘হে মুসলিমগণ! আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় আমানত তার হকদারদের হাতে ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। আর লোকদের মধ্যে বিচার-ফয়সালা করার সময় আদল ও ন্যায়নীতি সহকারে সুবিচার করো।’ -সূরা আল-নিসা : ৫৮।
কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রে উন্নতি, অগ্রগতি, শান্তি-শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে জীবন গঠন ও জীবন পরিচালনা একান্ত জরুরি। তাই আসুন, সত্যিকার মানুষরূপে নিজেদের গড়ে তুলি, মানব সৃষ্টির গোড়ার ইতিহাস স্মরণ করে আমরা নিজেদের রহমানের পরিপূর্ণ বান্দা হিসেবে তৈরি করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হই। (চলবে)
লেখক : গবেষক, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।


এ পাতার অন্যান্য খবর

এ বিভাগ বা পাতায় আর কোন সংবাদ, কবিতা বা অন্যকোন ধরণের লেখা পাওয়া যায়নি।

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।