গণতন্ত্রহীনতার কারণে অর্থনৈতিক সংকট প্রকট হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঘাটতি ও ডলার সংকটের কারণে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আর নেই। আমদানি ব্যয় বাড়ায় শুধু উৎপাদন কমছে না, সাথে সাথে বেকার সমস্যাও প্রকট হচ্ছে।
সরকারি হিসাবেই দেশে বেকারের সংখ্যা বর্তমানে ২৫ লাখ ৯০ হাজার। ২০২৩ সাল শেষে গড় বেকারের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৭০ হাজার। এর মানে গত বছরের তুলনায় এখন দেশে বেকারের সংখ্যা বেশি। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে শ্রমশক্তি জরিপ এ তথ্য প্রকাশ করেছে। এ জরিপ প্রতিবেদনে গত জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত বেকার পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও কমে এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১৬৩ কোটি ডলার পরিশোধের পর রিজার্ভ নামছে ১৮ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। এ নিবন্ধ যখন লেখা হচ্ছে (গত ১৩ মে সোমবার) তখন রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৪ সালের শুরুর দিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর ছাড়ানোর পর আর কখনো নিচে নামেনি। আকু একটি আন্তঃদেশীয় লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে প্রতি দুই মাস অন্তর বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল ও পাকিস্তানের মধ্যকার লেনদেনের দায় পরিশোধ করা হয়। একসময় শ্রীলঙ্কা আকুতে থাকলেও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে গত বছর তারা নিজ থেকেই বেরিয়ে যায়। আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। এ ঋণের জন্য বিভিন্ন শর্ত মানতে হচ্ছে। আইএমএফ আগামী জুনে রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করেছে। ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের সময় অবশ্য শর্ত ছিল আগামী জুনে ২০ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ রাখতে হবে। গত মার্চে নিট রিজার্ভ রাখার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয় ১৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার।
ডলারের দাম নির্ধারণ করে সরকার সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করছে। অর্থনীতিবিদরা বিষয়টি ইতিবাচক বলে মনে করছেন না। তারা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মানতেই সরকার এ ভুল পথে হাঁটছে। সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পেতে আইএমএফের বিভিন্ন শর্ত মানতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে হচ্ছে। আমরা মনে করি, এসব শর্ত অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ আরও বাড়িয়ে তুলছে। সর্বশেষ একদিনে ডলারের দাম ৭ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৬.৩৬ শতাংশ। ডলারের এ দর বৃদ্ধিতে চাপ তৈরি হবে বিদেশি ঋণ পরিশোধে। পাশাপাশি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ১৮ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসায় আরেক চাপ তৈরি হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন ব্যয়ে বড় অংশের জোগান আসে বিদেশি ঋণ সহায়তায়। এ ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে সরকারের ব্যয় এখন ক্রমেই বাড়ছে। ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে সুদহার বেড়ে যাবে। বাড়বে সংকট। সরকারি-বেসরকারি বিদেশি ঋণ আরও ব্যয়বহুল হবে। পুঁজিবাজার থেকে বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহার বেড়ে যাবে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা ইতোমধ্যেই সত্যে পরিণত হতে শুরু করেছে। কার্ব মাকের্টে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করেছে। আমাদের বাজার অর্থনীতি আমদানিনির্ভর হওয়ায় নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চাপে পড়েছে দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও বিত্তহীন শ্রেণি। আমরা মনে করি, এ সংকট মোকাবিলা করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য। গণতন্ত্রহীনতার কারণে সংশ্লিষ্টরা তা উপলব্ধি করছেন না। ফলে সংকট দিন দিন বাড়ছে। সরকার সমর্থক অর্থনীতিবিদরাও বিষয়টি তুলে ধরে সমাধানের তাগিদ দিচ্ছেন। আমরা আশা করি, দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থে মতপার্থক্য ভুলে চলমান সংকট মোকাবিলায় গণতন্ত্রের পথে ফিরতে সবাই যার যার অবস্থান থেকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে কসুর করবেন না।
এ পাতার অন্যান্য খবর
এ বিভাগ বা পাতায় আর কোন সংবাদ, কবিতা বা অন্যকোন ধরণের লেখা পাওয়া যায়নি।