সম্পাদকীয়
নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে হবে
দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমছেই না। গত ২০২০ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘ডেলিভারিং রোড সেফটি ইন বাংলাদেশ : লিডারশিপ প্রায়রিটিস অ্যান্ড ইনিশিয়েটিভস টু ২০৩০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিটি ক্ষেত্রেই দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ শীর্ষে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে দুর্ঘটনাকবলিত প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মারা যান ১০২ জন। পাশের দেশ ভুটানে এ সংখ্যা ১৬ দশমিক ৭০, ভারতে ১৩, নেপালে ৪০ ও শ্রীলঙ্কায় সাতজন। যদিও বাংলাদেশে প্রতি হাজারে যানবাহন আছে মাত্র ১৮ জনের। ভারতে এ সংখ্যা ১৫৯, নেপালে ৮১, ভুটানে ১০৯ ও শ্রীলঙ্কায় ৩২৭। বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনের দুর্ঘটনায় গড়ে দুজন সাইকেল চালকের মৃত্যু হয়। দুই বা তিন চাকার মোটরযানের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ১১ দশমিক ২০। আর গাড়ি ও হালকা যানের ক্ষেত্রে প্রতি ১০ হাজার যানের দুর্ঘটনায় ১৩ দশমিক ৩০ গাড়িচালক ও ২৮ দশমিক ৬০ যাত্রী প্রাণ হারান। ট্রাকচালকের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ছয় দশমিক ১০, বাসচালকের ক্ষেত্রে আট দশমিক ২০ ও বাসযাত্রীর সংখ্যা ২৮৬ দশমিক ৬০। ২০২০ সালের পর চলে গেছে তিন বছরেরও বেশি সময়, কিন্তু অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। বরং অবনতি হয়েছে। অতি সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করলে এমন হতাশার চিত্রই দেখা যাচ্ছে।
আমরা জানি, রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নিয়মিত সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির হিসাব প্রকাশ করে। সংগঠনটির গত চার বছরের দুর্ঘটনার হিসাব অনুসারে, ২০১৯ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫ হাজার ২১১ জন। পরের বছর সংখ্যাটি বেড়ে হয় ৫ হাজার ৪৩১। ২০২১ সালে সড়কে নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন। ২০২২ সালের ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সড়কে মৃত্যু হয়েছে ৬ হাজার ৫৪৮ জনের। এর মধ্যে গত বছর জুলাইয়ে সর্বোচ্চ ৭৩৯ জন নিহত হন। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাত্রী কল্যাণ সমিতিও। তাদের প্রতিবেদনেও সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে গত বছর সর্বোচ্চ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। তাদের হিসাবে, ২০২১ সালের চেয়ে ২০২২ সালে সড়কে দুর্ঘটনা ১৯ দশমিক ৮৯ আর মৃত্যু বেড়েছে ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। সর্বশেষ এবারের ঈদের পর যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গতবারের তুলনায় সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ৩১.২৫ শতাংশ। চলতি ঈদে ১৫ দিনে ৩৯৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০৭ জন নিহত হয়েছেন। আর আহত হয়েছেন ১৩৯৮ জন। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে- খোলা চোখে দেখলে এ কথা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু কথায় আছে ‘বাতির নিচেই অন্ধকার’। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা দেখে এমন বলে মনে করে, অনেক বিশেষজ্ঞ। কারণ চকচকে রাস্তার অনেক ত্রুটিই বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছাড়া শনাক্ত করা যায় না। কিন্তু দেখা যায়, উল্লেখিত ত্রুটির কারণে বার বার রাস্তার নির্দিষ্ট জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা বিবিসির এক প্রতিবেদনে রাস্তার নির্মাণ-ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন মোটরযান, অতিরিক্ত পণ্যবহন, নিয়ন্ত্রিত তদন্ত কমিটি, মহাসড়কে হালকা যান, ফিটনেসবিহীন যান, অদক্ষ, প্রশিক্ষণহীন ও ক্লান্ত চালক, বেপরোয়া গতি, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা অধিকাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান মনে করেন, ‘যানবাহনের গতি বাড়ানোর জন্য সড়ক প্রশস্ত করা হচ্ছে, লেন বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু যান চলাচলের ব্যবস্থাপনায় কোনো শৃঙ্খলা নেই। গতি তারতম্যে মহাসড়কে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।’ বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, মহাসড়কে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে, তার বড় কারণ বেপরোয়াভাবে বা অতিরিক্ত গতিতে চালানোর প্রতিযোগিতা এবং বিপজ্জনক ওভারটেকিং। ঈদের দিন থেকে পরের কয়েকদিন সড়ক ফাঁকা থাকায় এ সুযোগে পাল্লাপাল্লি করে গাড়ি ওভারটেক করেন চালকরা। সড়ক পরিবহন বিধিমালার ১২৫-এ গতিসীমা নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও কীভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করা হবে, তা বলা নেই। মহাসড়কগুলো উন্নত করার কারণে চালকদের মধ্যে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর প্রবণতা বেড়েছে। কিন্তু এ গতি নিয়ন্ত্রণ করতে কার্যকর কোনো স্মার্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। একই সাথে বাংলাদেশে যানবাহনের চালকদের সাইড দেয়ার সংস্কৃতিও গড়ে ওঠেনি। বেশি গতিসম্পন্ন যানবাহনকে অনেকটা জোর করেই ওভারটেক করতে হয়।
আমরা মনে করি, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, যানবাহনের চালক ও মালিক এবং যাত্রী সবারই ভূমিকা আছে। এক্ষেত্রে কারো অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। যারা রাস্তা নির্মাণে ত্রুটিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না কিংবা দুর্ঘটনা রোধের কারণগুলো অবহেলা, নয়তো দায়িত্বহীনতার কারণে এড়িয়ে যাচ্ছেন, তাদেরও রাস্তায় চলতে হয়। তাদের প্রিয় সন্তান, স্ত্রী, মা-বাবা ও স্বজনরাও প্রতিদিন নামছেন। তাই সবার নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেই তাদের দায়িত্ব নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা। নয়তো সামান্য অসচেতনতা ও অবহেলার জন্য তাদের জীবনে আসতে পারে স্বজনহারানোর কান্না, যা আমাদের কারো কাম্য নয়। আমরা আশা করি, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টরা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন।
এ পাতার অন্যান্য খবর
এ বিভাগ বা পাতায় আর কোন সংবাদ, কবিতা বা অন্যকোন ধরণের লেখা পাওয়া যায়নি।