রেজি : ডিএ ৫১৭ ॥ ৬৩ বর্ষ : ২য় সংখ্যা ॥ ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ॥ ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী ॥ ২৯ মাচ ২০২৪

॥ প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ॥
‘আর তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো উপাসনা করো না এবং তোমরা পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়ে যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হন, তাহলে তুমি তাদের প্রতি উহ্ শব্দটিও উচ্চারণ করো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না। তুমি তাদের সাথে নম্রভাবে কথা বল’। ‘আর তাদের প্রতি মমতাবশে নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত কর এবং বল, হে আমার প্রতিপালক! তুমি তাদের প্রতি দয়া কর যেমন তারা আমাকে শৈশবে দয়াপরবশে লালন-পালন করেছিলেন’। ‘তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের অন্তরে যা আছে তা ভালোভাবেই জানেন। যদি তোমরা সৎকর্মপরায়ণ হও, তবে তিনি তাওবাকারীদের জন্য ক্ষমাশীল।’ (সূরা ইসরা : ২৩-২৫)।
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ স্বীয় ইবাদতের সাথে পিতা-মাতার সেবাকে একত্রিতভাবে বর্ণনা করেছেন। এর মাধ্যমে এটিকে তাওহীদ বিশ্বাসের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ বোঝানো হয়েছে। এর কারণ সৃষ্টিকর্তা হিসেবে যেমন আল্লাহর কোনো শরিক নেই, জন্মদাতা হিসেবে তেমনি পিতা-মাতারও কোনো শরিক নেই। আল্লাহর ইবাদত যেমন বান্দার ওপর অপরিহার্য, পিতা-মাতার সেবাও তেমনি সন্তানের ওপর অপরিহার্য। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘অতএব তুমি আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। (মনে রেখ, তোমার) প্রত্যাবর্তন আমার কাছেই।’ (লোকমান : ১৪)। এখানেও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞতাকে সমভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
১. আল্লাহর আদেশ অপরিবর্তনীয় : উপরোক্ত আয়াতে ‘আর তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন’। এ আদেশ অর্থ ‘চূড়ান্ত ফয়সালা’। কেননা আল্লাহর ইবাদতের ফয়সালা যেমন চূড়ান্ত, পিতা-মাতার সেবা করার ফয়সালাও তেমনি চূড়ান্ত। এ সিদ্ধান্তে কোনো পরিবর্তন বা নড়চড় নেই। যেমন অন্যত্র এসেছে, ‘তোমরা যে বিষয়ে জানতে আগ্রহী, তার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে।’ (ইউসুফ : ৪১)।
যাকারিয়া বিন সালাম বলেন, জনৈক ব্যক্তি হাসান বাছরী (রহ.)-এর নিকট এসে বলল, আমি আমার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়েছি। জবাবে তিনি বললেন, তুমি তোমার প্রতিপালকের অবাধ্যতা করেছ। লোকটি বলল, আমার ওপর এটিই আল্লাহ আদেশ করেছেন। তখন হাসান বাছরী বললেন, আল্লাহ তোমার ওপর এটি আদেশ করেননি। বলেই তিনি অত্র আয়াতের প্রথমাংশটি পাঠ করলেন।’ (কুরতুবী)। কারণ ‘আল্লাহ কখনো ফাহেশা কাজের আদেশ করেন না।’ (সূরা আ’রাফ : ২৮)। অনুরূপভাবে ‘তিনি বান্দার কুফরীর ওপরে সন্তুষ্ট হন না।’ (সূরা যুমার : ৭)। অতএব অত্র আয়াতে ‘আদেশ করেছেন’ অর্থ ‘ফয়সালা করেছেন’।
২. পিতা-মাতার শরিয়তবিরোধী আদেশ ব্যতীত সবকিছু মানতে হবে : আল্লাহ বলেন, ‘আর যদি পিতা-মাতা তোমাকে চাপ দেয় আমার সাথে কাউকে শরিক করার জন্য, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদের কথা মানবে না। তবে পার্থিব জীবনে তাদের সাথে সদ্ভাব রেখে চলবে।’ (লুকমান : ১৫)। এখানে শিরক বলতে আল্লাহর সত্তার সঙ্গে অন্য কিছুকে শরিক করা। একইভাবে আল্লাহর বিধানের সাথে অন্যের বিধানকে শরিক করা বোঝায়। ধর্মের নামে ও রাষ্ট্রের নামে মানুষের মনগড়া সকল বিধান এর মধ্যে শামিল। অতএব পিতা-মাতা যদি সন্তানকে পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের বাইরে অন্য কিছু করতে চাপ দেন, তবে সেটি মানতে সন্তান বাধ্য নয়। কিন্তু অন্য সকল বিষয়ে সদাচরণ করবে।
মুস’আব বিন সা’দ তার পিতা সা’দ বিন খাওলা হতে বর্ণনা করেন যে, আমার মা একদিন আমাকে কসম দিয়ে বলেন, আল্লাহ কি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতে এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে নির্দেশ দেননি? ‘অতএব আল্লাহর কসম! আমি কিছুই খাবো না ও পান করবো না, যতক্ষণ না মৃত্যুবরণ করব অথবা তুমি মুহাম্মদের সাথে কুফরী করবে।’ (আহমাদ)। ফলে যখন তারা তাকে খাওয়াতেন, তখন গালের মধ্যে লাঠি ভরে ফাঁক করে তরল খাদ্য দিতেন। এভাবে তিন দিন পর যখন মায়ের মৃত্যুর উপক্রম হলো, তখন সূরা আনকাবুতের ৮নং আয়াত নাজিল হলো, ‘আর আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি যেন তারা পিতা-মাতার সাথে (কথায় ও কাজে) উত্তম ব্যবহার করে। তবে যদি তারা তোমাকে এমন কিছুর সাথে শরিক করার জন্য চাপ দেয়, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে তুমি তাদের কথা মান্য করো না। আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তনস্থল। অতঃপর আমি তোমাদের জানিয়ে দেব যেসব কাজ তোমরা করতে।’
অন্য বর্ণনায় এসেছে, মা বললেন, তুমি অবশ্যই তোমার দীন ছাড়বে। নইলে আমি খাব না ও পান করব না, এভাবেই মরে যাব। তখন তোমাকে লোকেরা তিরস্কার করে বলবে, ‘হে মায়ের হত্যাকারী’! আমি বললাম, ‘হে মা! যদি তোমার একশ’টি জীবন হয়, আর এক একটি করে এভাবে বের হয়, তবুও আমি আমার এ দীন ছাড়ব না। এখন তুমি চাইলে খাও, চাইলে না খাও! অতঃপর আমার এ দৃঢ় অবস্থান দেখে তিনি খেলেন। তখন অত্র আয়াত নাজিল হলো। সা’দ (রা.) বলেন, আমার কারণে এভাবে মোট ৪টি আয়াত নাযিল হয়েছে। [২] বস্তুত এমন ঘটনা সকল যুগে ঘটতে পারে। তখন মুমিনকে অবশ্যই দুনিয়ার বদলে দীনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
৩. মুশরিক পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ :  (ক) আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার মুশরিক মা আমার কাছে এসেছে। আমি কি তার সাথে সদ্ব্যবহার করব? তিনি বললেন, হ্যাঁ। সদ্ব্যবহার কর’। [৩] ইবনে হাজার (রহ.) বলেন, ঘটনাটি ছিল হুদায়বিয়া সন্ধি থেকে মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত সময়কার। যখন তিনি তার মুশরিক স্বামী হারেছ বিন মুদরিক আল-মাখযূমীর সাথে ছিলেন। (ফাতহুল বারী)।
 (খ) আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমার মা ছিলেন মুশরিক। একদিন আমি তার নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিলে তিনি আমাকে রাসূল (সা.) সম্পর্কে এমন কিছু কথা বলেন, যা আমার নিকট খুবই অপছন্দনীয় ছিল। তখন আমি রাসূল (সা.)-এর নিকট গিয়ে কাঁদতে লাগলাম এবং তার হেদায়াতের জন্য দোয়া করতে বললাম। অতঃপর তিনি দোয়া করলেন। এরপর আমি বাড়িতে ফিরে এসে দরজা নাড়লে ভেতর থেকে মা বলেন, তুমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। তারপর তিনি গোসল সেরে পোশাক পরে দরজা খুলে দেন এবং কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করে তার ইসলাম ঘোষণা করেন।
৪. পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ কেন করবে? : আল্লাহ বলেন, ‘(আল্লাহ বলেন,) আর আমরা মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছরে। অতএব তুমি আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। (মনে রেখ, তোমার) প্রত্যাবর্তনস্থল আমার কাছেই।’ (লুকমান : ১৪)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করার জন্য। তার মা তাকে গর্ভে ধারণ করেছে কষ্টের সাথে এবং প্রসব করেছে কষ্টের সাথে। তাকে গর্ভে ধারণ ও দুধ পান ছাড়াতে লাগে ত্রিশ মাস।’ (আহকাফ : ১৫)। এর দ্বারা বোঝা যায় যে, গর্ভ ধারণের সর্বনিম্ন মেয়াদ ছয় মাস। (কুরতুবী)। কেননা বাচ্চাকে দু’বছর যাবত বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে মায়েদের প্রতি নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘জন্মদানকারিণী মায়েরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দু’বছর দুধ পান করাবে, যদি তারা দুধ পানের মেয়াদ পূর্ণ করতে চায়।’ (বাকারা : ২৩৩)।
মানুষ তার পিতা-মাতার মাধ্যমেই দুনিয়ায় এসেছে। অতএব তারাই সর্বাধিক সদাচরণ পাওয়ার যোগ্য। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই মানুষের ওপর যুগের এমন একটি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে, যখন সে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না’। ‘আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি (পিতা-মাতার) মিলিত শুক্রবিন্দু হতে তাকে পরীক্ষা করার জন্য। অতঃপর আমরা তাকে করেছি শ্রবণশক্তিসম্পন্ন ও দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন।’ (দাহর : ১-২)।  
(চলবে)

এ পাতার অন্যান্য খবর

এ বিভাগ বা পাতায় আর কোন সংবাদ, কবিতা বা অন্যকোন ধরণের লেখা পাওয়া যায়নি।

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।