সুন্দরবনে তৎপর শরীফ বাহিনী

জেলেদের পণবন্দি করে মুক্তিপণ আদায়


১৬ অক্টোবর ২০২৫ ১৪:৩৪

কবির হোসেন কিবরিয়া, শরণখোলা: সুন্দরবনে মাছ ধরতে যাওয়া বাগেরহাটের শরণখোলার পাঁচ জেলেকে মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ করে বনদস্যু শরীফ বাহিনী। এদের মধ্যে মুক্তিপণ দিয়ে গত শুক্রবার (৩ অক্টোবর) রাতে বাড়ি ফিরেছেন তিন জেলে। এখনো দুই জেলে পণবন্দি রয়েছেন দস্যুদের হাতে। পণবন্দি দুই জেলের মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করা হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।
মুক্তি পাওয়া জেলেদের সূত্রে জানা যায়, সঠিক সময়ে দাবি করা মুক্তিপনের টাকা দিতে না পারলে পণবন্দিদের ওপর চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। জানা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিকাশের মাধ্যমে মুক্তিপনের টাকা লেনদেন হয়ে থাকে।
দরিদ্র জেলে পরিবারের পক্ষে এতো টাকা জোগাড় করা সম্ভব নয়। যে কারণে তাদের মুক্ত করাও সম্ভব হচ্ছে না। উৎকণ্ঠায় রয়েছেন পণবন্দি জেলেদের স্বজনরা। গত মঙ্গলবার (২৯ সেপ্টেম্বর) পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের তেঁতুলবাড়িয়া ও হয়লাতলা এলাকা থেকে তাদের অপহরণ করে বনদস্যু শরীফ বাহিনী। এসময় জেলেদের আহরিত মাছও লুট করে নিয়ে যায় দস্যুরা।
পণবন্দি থাকা জেলেরা হলেন, শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের সোনাতলা গ্রামের সেলিম মল্লিকের ছেলে সাদ্দাম হোসেন ও আনোয়ার হাওলাদারের ছেলে রাকিব।
মুক্তিপণ দিয়ে ফেরা জেলেরা হলেন, একই গ্রামের লাল মিয়া হাওলাদারের ছেলে রফিকুল ইসলাম, হাসেম হাওলাদারের ছেলে ইসমাইল এবং ছবদার তালুকদারের ছেলে বাদল। এসব জেলেদের পরিবার ও মহাজনরা কেউ ২০ হাজার কেউ ৩০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে সুন্দরবনে নতুন করে দস্যুতা শুরু হওয়ায় আতঙ্কে পড়েছেন বনের বিভিন্ন নদী ও খালে মাছ ধরায় নিয়োজিত জেলেরা। অন্যদিকে কোনো জেলেকে আবার কখন দস্যুরা অপহরণ করে নিয়ে যায়, সারাক্ষণ সেই আতঙ্ক তাড়া করছে ওইসব জেলেদের মহাজন ও পরিবারকে। সুন্দরবনকে আবারও দস্যুমুক্ত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর অভিযান পরিচালনার দাবি জানিয়েছেন তারা।
পণবন্দিদশা থেকে ফিরে আসা জেলে রফিকুল ইসলাম জানান, গত মঙ্গলবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাতে তেঁতুলবাড়িয়া নদীতে মাছ ধরছিলেন। তাদের ৪-৫টি নৌকা কাছাকাছি দূরত্বে থেকে নদীতে জাল ফেলে তারা নৌকায় অবস্থান করছিলেন। রাত ৯টার দিকে বনদস্যু শরীফ বাহিনীর ৮-৯ জন সশস্ত্র দস্যু ইঞ্জিনবিহীন একটি নৌকায় নিঃশব্দে তাদের জেলেবহরে এসে হানা দেয়। তাদের প্রত্যেকের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। এ সময় অস্ত্রের মুখে তিন জেলেকে তাদের নৌকায় তুলে নেয় দস্যুরা। নৌকায় থাকা মাছও তুলে নিয়ে যায়। যাবার সময় নৌকার অন্য জেলেদের কাছে তাদের মোবাইল নম্বর দিয়ে যায় দস্যুরা। মুক্তিপণ পেয়ে দস্যুরা তাদের শুক্রবার রাতে অন্য একটি জেলে নৌকায় তাদের তুলে দেয়।
পণবন্দি জেলে সাদ্দামের মা, মঞ্জু বেগম জানান, দস্যুদের দেওয়া মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন সাদ্দামের বাবা। দস্যুদের কাছে এখন সাদ্দাম ও রাকিব পণবন্দি রয়েছেন। তাদের ছাড়াতে হলে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিতে হবে। তারা গরিব মানুষ, এতো টাকা কোথায় পাবেন। তারপরও ৫০ হাজার টাকা দিতে চেয়েছি, কিন্তু তাতেও রাজি হয়নি দস্যুরা। মুক্তিপণ দিতে না পারলে দুই জেলের ভাগ্যে কী ঘটবে, সেই দুশ্চিন্তায় পড়েছে পরিবার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন মৎস্য ব্যবসায়ী জানান, দীর্ঘদিন সুন্দরবন শান্ত ছিল। বর্তমানে কয়েকটি দস্যু বাহিনী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত জেলেদের অপহরণ করছে। এরই মধ্যে তিন জেলেকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে এনেছেন তারা। এখনো দুই জেলে পণবন্দি রয়েছেন। সুন্দরবনের মধ্যে জেলেরা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। লাখ লাখ টাকা চালান খাটিয়ে মহাজনরাও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। দ্রুত এসব দস্যু বাহিনী নির্মূলে কঠোর অভিযান না করলে আবারও ভয়ংকর হয়ে উঠবে সুন্দরবন।
গোপন সূত্রে জানা যায় যে, মোংলার একসময়ের বনদস্যু জাহাঙ্গীর বাহিনীর সাথে ছিল নান্না হাওলাদার। এখনো তাদের সাথে যোগ সাজস আছে এবং শরীফ বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে জেলেদের পণবন্দিদশা থেকে মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্ত করে আনছে এই নান্না হাওলাদার।
মোংলা কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি সুন্দরবনের বেশ কয়েকটি দস্যু বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছে কোস্টগার্ড। অস্ত্র-গোলাবারুদসহ এসব বাহিনীর কয়েকজন সদস্যকে আটক ও পণবন্দি জেলেদের উদ্ধার করা হয়েছে। দস্যুতাসহ সুন্দরবনের অপরাধ দমনে তাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।