ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও সাফল্যের প্রত্যাশা
৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৭:০৩
‘দুর্গমগিরি, কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার/লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিতে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার।’- জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার পঙক্তিমালা বার বার প্রাসঙ্গিক হয়ে ফিরে আসে জাতীয় জীবনে। দেশের বর্তমান অবস্থা; বিশেষ করে ২০২৪-এর ৩৬ জুলাই বিপ্লবের পর জাতীয় নেতাদের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে করেন; দেশের রাজনীতি বিশ্লেষকরা। কারণ ১৭ বছরের ফ্যাসিস্ট হাসিনার দুঃশাসনের পর জনগণের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব এখন তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্লেষকরা বার বার স্মরণ দিয়ে দিচ্ছেন, ‘স্বাধীনতা (সাফল্য) অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা বেশি কঠিন।’
৩৬ জুলাইয়ে সাফল্য এসেছে প্রায় দুই হাজার মানুষের জীবনের বিনিময়ে। ত্যাগ-তিতিক্ষা ও জেল-জুলুমের শিকারের তালিকা আরো অনেক লম্বা। যার জীবন্ত সাক্ষী এ প্রতিবেদনের প্রত্যেক পাঠক। তাই সেই ফিরিস্তি উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন। এ ত্যাগের বিনিময়ে জনগণের প্রত্যাশা রাজনীতির নামে জমিদারি, অর্থাৎ চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত একটি আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্র। তারা চায় যার যার যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুসারে মর্যাদা এবং বৈষম্যমুক্ত সমাজ ও দেশ। ইনসাফের পাল্লায় অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি। এ প্রত্যাশা পূরণে অতীতের পুরনো বোতল বদলে অন্য রঙের পানীয় পান করে প্রতারণার ফাঁদে জনগণ আর পা দিতে চায় না। বিশেষ করে ৩৬ জুলাই বিপ্লবের পর যারা রাজনীতির মুখোশে নতুন উদ্যমে চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও দুর্নীতির মাধ্যমে আবার দেশটাকে নিজেদের জমিদারি কিংবা বাপের তালুক ভাবতে শুরু করেছে, তাদের থেকে জনগণ মুক্তি চায়। জনগণের মুখে মুখে এখন নতুন স্লোগান ‘এক ফ্যাসিস্টের বদলে আরেক ফ্যাসিস্ট’ আমরা চাই না। তাহলে তারা কাকে চায়, সে কথাও ধ্বনিত্ব হচ্ছে দেশের আকাশে-বাতাসে, ‘নৌকা, ধানের শীষ ও লাঙল দেখেছি, এবার আমরা দাঁড়িপাল্লায় ভোট দিয়ে ইনসাফপূর্ণ এক কল্যাণরাষ্ট্র গঠন করতে চাই। তাদের এ প্রত্যাশা পূরণের সিপাহসালার হিসেবে তারা যাকে দেখে ‘দুর্গমগিরি, কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার’ পাড়ি দেবার সাহস পাচ্ছে- তিনি শুভ্রসফেদ শুশ্রু ভরা নূরানী মুখের ষাটোর্ধ্ব এক যুবক। তার নাম ডা. শফিকুর রহমান। পর্যবেক্ষকদের পর্যবেক্ষণ এ কথাই বলছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দিকেই আশায় বুক বেঁধে তাকিয়ে আছে এদেশের নির্যাতিত, বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার কোটি কোটি মানুষ।
শহীদের রক্তে আরো শতগুণ জেগে ওঠেছে
শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট দুঃশাসনের এক নম্বর টাগের্ট ছিলো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নাম-নিশানা মুছে ফেলা। তাই তো ভিত্তিহীন মিথ্যে অপবাদ দিয়ে জামায়াতের শীর্ষনেতাদের হত্যা করেছে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী নিঃশেষ নয়, শহীদের রক্তে আরো শত গুণ বেগে জেগে উঠেছে। শহীদের শূন্য স্থানে এসেছেন শাহাদাতের তামান্নাভরা বুকে পুণ্যবান নতুন নতুন মুখ। জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত করেছেন তাদের নতুন নেতা নতুন আমীরে জামায়াত। ডা. শফিকুর রহমান প্রথম আমীরে জাময়াত হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এক চ্যালেঞ্জিং সময়ে। ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীর রুকনগণের (সদস্য) প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে আমীর নির্বাচিত হন এবং ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর ২০২০-২২ কার্যকালের জন্য তিনি আমীরে জামায়াত হিসেবে প্রথমবারের মতো শপথ গ্রহণ করেন। ২০২২ সালের ৩১ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামীর রুকনগণের (সদস্য) প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে দ্বিতীয়বারের মতো পুনরায় আমীর নির্বাচিত হন এবং ২০২২ সালের ১৮ নভেম্বর ২০২৩-২৫ কার্যকালের জন্য তিনি আমীরে জামায়াত হিসেবে দ্বিতীয় বারের মতো শপথ গ্রহণ করেন এবং গত ২৮ নভেম্বর তৃতীয়বার নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। জাতিকে সাথে নিয়ে তিনি ফ্যাসিস্ট হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে তার সাহসী নেতৃত্বে ইতিহাসে অর্জিত হয়েছে এক সোনালি অধ্যায়। হাসিনা যেদিন পালিয়েছে, সেদিন সঙ্কট উত্তরণের জাতীয় নেতৃত্বের সভায় তার নামই সবার আগে উচ্চারিত হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্ব জেনেছে আগামীর বাংলাদেশ গড়ার এক দুঃসাহসী মহান নেতার নাম। মিত্র বাড়িয়েছে সহযোগিতার হাত, শত্রুরাও বসেছে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা আঁকতে। তবে কোনো ষড়যন্ত্রই টলাতে পারেনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদের। তারা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর হিসেবে তৃতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচিত করেছেন তাদের প্রিয় নেতা ডা. শফিকুর রহমানকে। গত শুক্রবার (২৮ নভেম্বর) রাজধানীর মগবাজারের আল-ফালাহ মিলনায়তনে দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও অভ্যন্তরীণ নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার মাওলানা এটিএম মা’ছুম তাকে শপথবাক্য পাঠ করান। শপথ গ্রহণের সময় আবেগাপ্লুত হয়ে অঝোরে কাঁদতে দেখা যায় ডা. শফিকুর রহমানকে। শপথের আগে এটিএম মা’ছুম জানান, এবারের আমীর নির্বাচনে মোট ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৯২ জন নারী ও পুরুষ সদস্য ভোট দিয়েছেন। ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে ঘিরে প্রতিদিন জনগণের প্রত্যাশা বাড়ছে। সাথে সাথে বাড়ছে প্রতিপক্ষের অপপ্রচার এবং ষড়যন্ত্র।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, জামায়াতের পক্ষে জনসমর্থন বেড়ে যাওয়ায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভীতি সৃষ্টি ও ভোট বিভ্রান্তির চেষ্টা করছে। দাঁড়িপাল্লার পক্ষে ব্যাপক জোয়ার দেখে অনেক রাজনৈতিক নেতার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, সকলের মধ্যেই জামায়াতের পক্ষে ভোট দেওয়ার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বের ওপর দেশি-বিদেশি আস্থা ও সমর্থন দেখে আমাদের প্রতিপক্ষদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। তাদের দলের নেতারা এমনভাবে কথা বলতে শুরু করেছে, কথা শুনে তাদের সুস্থ মনে হয় না। তারা সকালে এককথা বলে, বিকেলে আরেক কথা বলে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের এ বক্তব্যের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে সম্প্রতি করা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার জরিপেও।
কী বলছে জরিপ
সর্বশেষ আমেরিকান প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) ওয়েবসাইটে একটি জরিপ প্রকাশ করা হয়েছে। গত ২ ডিসেম্বর মঙ্গলবার এ জরিপ বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় আংশিক এবং জামায়াতে ইসলামীর বিষয়টি এড়িয়ে অধিকাংশ পত্রিকা প্রকাশ করেছে। এতে দেখাচ্ছে, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের কাছে পছন্দে এগিয়ে আছে জামায়াতে ইসলামী। এ দলটির কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্নে ৫৩ শতাংশ মানুষ পছন্দের কথা বলেছেন। বিএনপিকে নিয়ে প্রশ্নে দলটিকে পছন্দের কথা বলেছেন ৫১ শতাংশ মানুষ। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কার্যক্রম পছন্দ করেছেন ৩৮ শতাংশ মানুষ। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতি নিজেদের পছন্দের কথা জানিয়েছেন ৩৩ শতাংশ। গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ অক্টোবর পরিচালিত ওই জরিপে অংশ নেয়া বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি (৬৯ শতাংশ) উত্তরদাতা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভালো কাজ করছেন। জরিপে অংশ নেয়া ৭০ শতাংশ মানুষ অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমের প্রশংসা করেছেন। তারা খোলাসা করেই বলেছেন, দেশের বেশিরভাগ মানুষ ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছেন।
বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি)-এর জরিপের ফল দেখাচ্ছে, “বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী খুব কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে। বিএনপি সামান্য ৩ পয়েন্টে এগিয়ে (বিএনপি ২০ শতাংশ, জামায়াত ১৭ শতাংশ) রয়েছে। তবে জরিপে সবসময় কিছুটা ভুলের আশঙ্কা থাকে, যাকে ‘মার্জিন অব এরর’ বলা হয়। এখানে বিএনপি ও জামায়াতের সমর্থনের মধ্যে যে ৩ শতাংশের পার্থক্য দেখা যাচ্ছে, সেই পার্থক্য খুব ছোট। এ প্রসঙ্গে পর্যবেক্ষকরা মন্তব্য কেেরছন, ‘মার্জিন অব এরর’ বা সম্ভাব্য ভুলের সীমা হিসাব করলে এই ছোট পার্থক্যটি আসলে মুছেও যেতে পারে। জরিপে বিএনপিকে এগিয়ে থাকতে দেখা গেলেও প্রকৃত চিত্রে তারা সমান অবস্থানে থাকতে পারে।”
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রতি জনগণের এ সমর্থন বাড়ার নেপথ্যে বর্তমান নেতৃত্বের উদার কর্মনীতি- এতে কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমান নেতৃত্ব দেশের কল্যাণে সবাইকে সাথে নিয়ে ইসলামের সুমহান আদর্শের আলোকে একটি জনকল্যাণমূলক আধিপত্যবাদমুক্ত আধুনিক রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলছে। দেশের আধুনিক শিক্ষিত তরুণরা তাই দলে দলে জামায়াতে ইসলামীর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। এতে যেমন আছে মাদরাসা শিক্ষিত তরুণ, তেমনি আছে ইংরেজি মাধ্যমের আধুনিক শিক্ষিতরা। আছে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। তারা সবাই মনে করেন, একটি নিরাপদ, ইনসাফপূর্ণ বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়তে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বিকল্প নেই। তাই জামায়াতে ইসলামীর প্রতি এ জনপ্রিয়তার কারণে দেশ-বিদেশে বাড়ছে শত্রু। চর্যাপদে কবি ভুসুকুর এ পঙক্তি ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’ প্রাসঙ্গিকতার কথাই মনে পড়ে যায় তাদের প্রতি শক্রতার নানা ধরন দেখে। তাই পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমানের সংগ্রামী জীবনের এ পর্বেও আছে অনেক চ্যালেঞ্জ।
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ডা. শফিকুর রহমান
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সামনে চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে আমীরে জামায়াত বলেন, ‘আমাদের যার যার নিজেদের কাজ বুঝে নিয়ে দৃঢ়তার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে। সব ধরনের পরিস্থিতিতে আল্লাহর ওপরই ভরসা করতে হবে। আমরা যত বেশি তাওয়াক্কুল করব, তত বেশি আল্লাহর সাহায্য আসবে। আল্লাহর ওপর ভরসা না করে পারিপার্শ্বিক অন্য কিছুর ওপর নির্ভর করা চিন্তার ত্রুটি।’
রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, আল্লাহর ওপর এমন তাওয়াক্কুলসম্পন্ন নেতৃত্বের অধীনে পরিচালিত দলের কর্মীদের বিজয় ঠেকানোর সাধ্য দুনিয়ার কোনো শক্তির নেই। তাই তৃতীয় মেয়াদেও ডা. শফিকুর রহমান নেতৃত্বে সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট তার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।