আলোকে তিমিরে

হতদরিদ্রের পথে হাঁটছে দেশ


৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৬:৫১

॥ মাহবুবুল হক ॥
দরিদ্র বা দারিদ্র্য- এ শব্দগুলো আমাদের দেশে বহু প্রাচীন ও বহুল আলোচিত শব্দ। সাম্প্রতিককালে এসব শব্দ সংবাদপত্রের পাতায় খুব কম এসেছে। গত ১৭ বছর পূর্বে ‘আলাউদ্দিনের চেরাগ’ নিয়ে যে সরকার এদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তারা এসেই বলেছে, “দারিদ্র্যকে ‘না’ বলুন।” ‘দারিদ্র্যবিমোচনে’ আমাদের সকল লক্ষ্য স্থির হয়ে আছে।’ ‘দারিদ্র্যকে আমরা শূন্যের কোটায় নিয়ে যাব।’ তাদের যারা উৎসাহী মহল, তারা বলেছিলেন, “দারিদ্র্যকে আমরা ‘মিউজিয়ামে’ পাঠাবো।” “দারিদ্র্যের সংখ্যা হবে ‘জিরো’ ইত্যাদি ‘ভবিষ্যতে দারিদ্র্য সম্পর্কে জানতে হলে ‘মিউজিয়ামে’ যেতে হবে।” আগামীর মানুষ টিকিট কেটে ‘দারিদ্র্য’ দেখবে। ‘দারিদ্র্য’ বুঝবে। ‘দারিদ্র্য’ উপলব্ধি করার চেষ্টা করবে।
অবশ্য এর বহু পূর্বে আমাদের জাতীয় কবি দারিদ্র্যকে দারুণভাবে উচ্চকিত ও সমুজ্জ্বল করেছিলেন। দারিদ্র্য কবিতায় তিনি বলেছেন-
‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান,
তুমি মোরে দানিয়াছ খৃষ্টের সম্মান।
দারিদ্র্যকে তিনি ‘খৃষ্টের’ সম্মানে উদ্ভাসিত করেছিলেন।
প্রাসঙ্গিক কি-না, জানি না। গল্পটা কার লেখা, তাও এ বৃদ্ধ বয়সে মনে পড়ছে না। গল্পটা প্রতীকী। সত্য কাহিনী বা কিংবদন্তি নয়। খুব সাদামাটা পশ্চিমবাংলার গল্প। গল্পের ধরন থেকে বোঝা যায়, সনাতন ধর্মের কেউ একজন এটা লিখেছেন। গল্পটা সংক্ষেপে এ ধরনের- “ভগবান দুজন দেবতাকে মর্তে পাঠিয়েছেন এই বলে, ‘আমি তো মানুষ সৃষ্টি করে ভারতে পাঠিয়েছি, তারা এখন কেমন আছে, দেখে এসে রিপোর্ট কর। তো দেবতারা মর্তের পশ্চিমবাংলায় নেমে যাকেই জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কি মানুষ’। জবাব আসে, আমি তো ‘কংগ্রেসি’। জবাব শুনে দেবতারা আবার মানুষ খুঁজতে বের হয়। আবার জবাব আসে, ‘আমি তো তৃণমূল কংগ্রেসি’। দেবতারা আবার হাঁটতে হাঁটতে একজনকে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার পরিচয়? ‘আমি তো বিজেপি।’ আবার দেবতারা রাস্তার অপর পারে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনার পরিচয়? ‘আমি তো কমিউনিস্ট’। আরেকজন বলেন, আমি তো ‘আরএসএস’। কেউ বলেন, ‘মুসলিম লীগ’। এভাবে দেবতারা মানুষ খুঁজে পায় না। সবাই কোনো না কোনো দলের নাম বলে। সে যে মানুষ, সে কথাটাও কেউ স্বীকার করে না। হঠাৎ রাস্তার একপাশে তাদের চোখ পড়ে একটা সাইনবোর্ড। তাতে লেখা, ‘বন মানুষ’। তারা উৎফুল্ল হয়, এই যে মানুষ পাওয়া গেছে। এটা ছিল চিড়িয়াখানা। তারা চিড়িয়াখানায় ঢুকে ‘বন মানুষে’র সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। তারা যা বলে, ‘বন মানুষ’ হাত-পা নাড়ে। তখন তারা অনুধাবন করে, এটাই ‘মানুষ’। তারা দেখে, তার চারপাশে খাবার-দাবার রয়েছে। তার স্বাস্থ্য ভালো আছে। তারা তাদের ভগবানের কাছে রিপোর্ট করে, আমরা কলকাতার কোনো জায়গায় মানুষ খুঁজে পাইনি। অবশেষে কলকাতার চিড়িয়াখানায় একজন মানুষ পেয়েছি। সে ভালো আছে, তার কোনো প্রবলেম নেই। তবে তার নাম ‘বন মানুষ’।”
যারা বলেছিলেন, দরিদ্র বা দারিদ্র্য খুঁজতে হলে ভবিষ্যতে মিউজিয়ামে খুঁজতে হবে, তাদের জন্য গল্পটা বোধ হয় অনেকটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। যাই হোক, মানুষের জায়গায় যেভাবে ‘বন মানুষ’ পাওয়া গেল, সেভাবে ভবিষ্যতে হয়তো মিউজিয়ামে ‘দরিদ্র মানুষ’ পাওয়া যাবে।
গত সরকার বুঝে বা না বুঝে হঠাৎ আমাদের দেশকে স্বল্পোন্নত দেশ বলে জগৎময় ঘোষণা দিয়েছিল এতে অনুন্নত দেশ হিসেবে যেসব সুযোগ-সুবিধা আমরা উন্নত দেশগুলো থেকে পেতাম, সেসব ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল। ফলে আমরা অনুন্নত দেশের জায়গায় ‘হতদরিদ্র’ দেশে পরিণত হয়ে গেলাম। এর অর্থ হলো আমরা আরো একধাপ নিচে নেমে গেলাম। উন্নত দেশগুলো খুশি হয়ে গেল। অন্তত একটি দেশকে তো আর সাহায্য-সহযোগিতা বা খয়রাত দেয়া লাগছে না। তারা আগের তুলনায় আরো একটু উন্নত হলো। শক্তিশালী হলো। কিন্তু এদিকে তো আমরা স্বল্পোন্নত দেশের জার্সি গায়ে দিয়ে ফেলেছি। জার্সি তো আর চট করে খোলা যায় না। একেক সময় একেক ধরনের জার্সি গায়েও দেয়া যায় না। এভাবেই চলতে লাগল। আমরা ছিলাম জাকাত, সাদাকা ও হাদিয়া খাওয়ার লোক। আমরা পৃথিবীকে জানালাম, ওসব তো আমরা আর গ্রহণ করি না। আমরা পূর্বের তুলনায় সম্পদশালী হয়েছি। আমরা ধীরে ধীরে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নকামী দেশে পরিণত হব। ২০৩০-এর মধ্যে আমরা উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হব এবং ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা বিশ্বের অপরাপর দেশের মতো উন্নত দেশে পরিণত হব। শুধু তাই নয়, আমরা পরাশক্তির জায়গায়ও উন্নীত হতে পারব। শুধু এ পৃথিবী নয়, সৌর পৃথিবীর সকল জায়গায় আমরা অবস্থান গড়তে পারব। দুনিয়ার প্রায় সব উন্নত দেশ সেক্যুলারিজমে বিশ্বাস করে। সে কারণে আমরাও আমাদের দেশকে সেক্যুলার দেশ হিসেবে প্রতিপণ্য করেছি। রাষ্ট্রশাসিত ধর্ম বা ধর্মশাসিত রাষ্ট্র সবকিছু আমরা রাষ্ট্র থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছি। এখন আমরা স্বল্পোন্নত দেশে অবস্থান করছি। তারপরও আমরা মহাকাশে ‘স্যাটেলাইট’ পাঠিয়েছি। পুরো স্যাটেলাইটে আমাদের অবস্থান দৃঢ় করার জন্য এখন তো তিনটি স্তর রয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা দেশকে ডিজিটালাইজ করেছি। সামনের দিকে আমাদের স্বপ্ন রয়েছে স্মার্ট দেশে পরিণত হওয়া।
একদিকে স্বপ্ন; আরেকদিকে কঠিন বাস্তবতা। বিশ্বের মানুষকে আমাদের স্বপ্নগুলো দেখানোর জন্য আমরা নিরন্তর কাজ করেছি। আমরা সারা দেশের সরকারি জমি-জমার ওপর দিয়ে রাস্তা, হাইওয়ে তৈরি করেছি। ব্রিজ, ওভারব্রিজ, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, টানেল, এক্সপ্রেসওয়ে, বন্দর, করিডোর রাস্তা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে লাখ লাখ হতদরিদ্র মানুষ উৎখাত করেছি, নির্মূল করেছি। তারা উপায়ন্তর না দেখে ভিক্ষাবৃত্তিকে ধারণ করেছে। খেয়ে না খেয়ে জীবন অতিবাহিত করছে। এসব জমিতে তারা ছাপড়াঘর করে কোনোরকম বসবাস করত। ফসল ও তরিতরকারি উৎপাদন করত। আশপাশের খালে, বিলে, হাওরে, নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। তাদের সেই জীবিকা নানাভাবে ব্যাহত হয়ে গেছে। ভারতের সাথে আমাদের যে বন্ধুত্ব, সেই বন্ধুত্ব কখনো পানিবণ্টনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান থাকেনি। এক্ষেত্রে সবসময় ভারত একতরফা স্বার্থপরতা দেখিয়েছে। আমাদের যখন পানির দরকার নেই, তখন তারা পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করেছে। আর যখন পর্যাপ্ত পানির দরকার, তখন তারা বাঁধগুলো বন্ধ রেখেছে। ৫৮ নদীর মুখে যে স্লুইসগেট তৈরি করেছে, প্রয়োজনের সময় সেগুলো বন্ধ রাখছে। এসবের মাধ্যমে আমাদের দারিদ্র্যের হার ক্রমাগতভাবে বেড়েছে। ভারত থেকে পানির উজান সৃষ্টি করায় নদীর ভাঙনে নানারকমভাবে গত প্রায় ১৭ বছর ধরে মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উন্নয়নের ছবি দৃষ্টিগোচর করার জন্য শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের দ্বারা জেলায় জেলায় বড় বড় মল তৈরি করা হয়েছে। যেসব মল সর্বস্তরের মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় বাজার, শৃঙ্খলার সাথে সৃষ্টি করে হতদরিদ্র মানুষের ছোট ছোট ব্যবসা ওলোট-পালোট করে দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমাদের দেশের মানুষ; বিশেষ করে কৃষিজীবী মানুষ অবসর সময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায় নিয়োজিত থাকত। তারা মুড়ি, চিড়া, হলুদ, মরিচ থেকে হস্তশিল্প, কুটির শিল্প, পাট-বেত-পাটিপাতা-বাঁশশিল্প, লুঙ্গি, গামছা, শাড়ি, ওড়না, স্কুলের খাতা, জায়নামাজ, কাঁথা তৈরি, কামার, কুমার, চুড়ি-ফিতা কসমেটিকস, টুপি, স্যান্ডেল, খড়ম, রবাবের জুতা, ফার্নিচার, পিঠা, দুধ, ঘি, ছানা, মাখন, খেলনা, পুতুল, খেলাধুলা সামগ্রীসহ নানাবিধ নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী নিজেরা ঘরে তৈরি করত এবং কেনাবেচা করত। জেলেরা মাছ ধরত, মাছ চাষ করত, মাছের নানাবিধ পণ্য তৈরি করে বিক্রি করত। সামগ্রিক অর্থে পরিবারের সবাই এসব উৎপাদনে সাহায্য-সহযোগিতা করত এবং সবাই কিছু না কিছু আয়ের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। হতদরিদ্র, দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পর্যন্ত আপন পেশার বাইরে নানারকম উৎপাদন ও বিপণনের সাথে লাখ লাখ মানুষ জড়িত ছিল। ক্যাপিটালিজমের ছোঁয়ায় বা ক্যাপিটাল মার্কেটের সংযুক্তিতে নিম্নশ্রেণির মানুষ নির্দিষ্ট আয়ের পথ থেকে ছিটকে পড়েছে। যার ফলে দারিদ্র্যের হার দিন দিন বেড়েছে। সেক্যুলার ও পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মানুষ গত ১৭ বছরে অন্তত ৫০ বছর পিছিয়ে গেছে।
একসময় আমাদের দেশের নাম ছিল কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষির ওপরই আমাদের নির্ভরতা ছিল শতভাগ। সেই কৃষিকে আমরা পুঁজিবাদী ব্যবসার কারণে উপেক্ষা করেছি, অবহেলা করেছি। প্রতিবেশী দেশে ডিম, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, গম, ভুট্টা, চাল, ডাল, হলুদ, মরিচ প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয় বলে সেসব ব্যবসা থেকে আমরা অনেকটা হাত গুটিয়ে ফেলেছি। আমদানি-রফতানির নামে ফড়িয়া ও দালাল সৃষ্টি করেছি। যে ফড়িয়া-দালাল, কমিশন হান্টাররা অর্থলোলুপতার কারণে দেশপ্রেম থেকে বহু পূর্বেই বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এর সাথে রাজনীতি, আঞ্চলিক বাণিজ্য, ভূ-বাণিজ্য ইত্যাদি জড়িত হয়ে একদিকে আমরা যেমন প্রয়োজনে অতিরিক্ত দামে খাদ্যসহ সবকিছু আমদানি করছি; অন্যদিকে রফতানির ক্ষেত্রে তেমন উল্লেখযোগ্য অবদান সৃষ্টি করতে পারিনি। যেমন একসময় ছিল রফতানির ক্ষেত্রে পাট, চা, চামড়াসহ বহু কিছু রফতানি করতাম। পাট ও চামড়ার সঙ্গে ভূ-রাজনীতি সংযুক্ত হওয়ায় বিষয়টি আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেল। স্বাধীনতার পর আমাদের পাটকলগুলোয় একের পর এক আগুন জ¦লতে লাগল। অপরদিকে প্রতিবেশী দেশের সীমান্তে পাটকল প্রতিষ্ঠিত হতে লাগল। আমাদের কৃষকরা পাটকল মিল মালিকদের কাছ থেকে দেশবাসী হওয়ায় যে সুযোগ-সুবিধা পেত, ধীরে ধীরে তাও বন্ধ হয়ে গেল। কাঁচা পাট উৎপাদনে উৎসাহ কমে গেল। এভাবেই সেই যে পাট উৎপাদন, মিলে পাট প্রেরণ, পাটশিল্প ও পাটপণ্য ব্যাহত হলো, তা আর উজ্জীবিত হলো না। আমাদের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক মরহুম আবুল মনসুর আহমদ ও বরেণ্য সাংবাদিক খন্দকার আবদুল হামিদ পাটশিল্পকে ধরে রাখার জন্য লেখার মাধ্যমে যে জিহাদ সৃষ্টি করেছিলেন, প্রতিবেশী বন্ধুর কারণে সে জিহাদ সফলতা লাভ করেনি। আমরা একদিকে সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ করেছি; অপরদিকে প্রাইভেট ক্ষেত্রে পাটকল স্থাপনে প্রেরণা জুগিয়েছি। যার ফল এখনো তেমনভাবে আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। পাটকলগুলোয় আমাদের শ্রমিক সংখ্যা ছিল মওসুম হিসেবে চার থেকে পাঁচ লাখ। এখন সে সংখ্যা তলানিতে নেমেছে।
চা-শিল্প কোনোভাবে টিকে আছে। সেখানেও আশাব্যঞ্জকভাবে শ্রমিকের সংখ্যা বাড়েনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চা-শ্রমিকরাও সনাতন পদ্ধতির কারণে মানবেতর জীবনযাপন করে আসছে।
চামড়ার বিষয়টি এতই ন্যঙ্কারজনক যে, এ বিষয়টি লিখতে বা বলতে সীমাহীন দুঃখের সাগরে সাঁতার দিতে হয়। একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশে এতবড় চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র টিকে থাকার কথা নয়। কিন্তু ‘র’ ও ‘মোসাদ’ বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জিং হিসেবে নিয়ে অনেকটা ধ্বংসের কিনারে নিয়ে গেছে। একসময় এ শিল্প ছিল আমাদের হাতে গড়া। আমরা সারা বিশ্বে চামড়া প্রসেস করে রফতানি করতাম। চামড়ার কোনো অভাব আমাদের ছিল না। এদেশের মানুষ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সারা বছর গরু, ভেড়া, ছাগল, মহিষের গোশত খেতে অভ্যস্ত ছিল। কুরবানি ঈদের সময় লাখ লাখ পশু কুরবানি করত। এখন খাওয়ার অভ্যস্ততা অনেকটা কমেছে, কিন্তু কুরবানির সংখ্যা মোটামুটিভাবে ৩ গুণ বেড়েছে। কিন্তু সে চামড়া সময়মতো ক্রয়-বিক্রয় ও প্রসেসের মধ্যে ‘র’ ও ‘মোসাদ’ ঢুকেছে। যার ফলে বেশ কয়েক বছর ধরে চামড়া আর প্রসেস মিলে সময়মতো পৌঁছাতে পারছে না। চামড়ার ক্রেতা ও বিক্রেতা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চামড়ার কারখানা মূলত ছিল বুড়িগঙ্গার পাশে। বলতে গেলে আবাসিক এলাকার মাঝে। পাকিস্তান আমল থেকেই রাজধানী ঢাকার পরিবেশ স্বাভাবিক রাখার জন্য চামড়া সংক্রান্ত মিল-কারখানাগুলো সাভারে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধসহ নানা রাজনৈতিক কারণে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সাভারে সমস্ত মিল-কারখানা স্থানান্তর প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লেগেছে প্রায় ৫৫ বছর। এ ঢিমেতালের কারণে হাজার হাজার লোক এ শিল্প থেকে সরে পড়তে বাধ্য হয়। সময়োপযোগী উদ্যোগ না থাকার কারণে চামড়াশিল্পকে আমরা সমুজ্জ্বল করতে পারছি না।
কৃষির বিষয় আমরা আলাপ করার সুযোগ পেলাম না। এটা একটা বড় ধরনের গবেষণার বিষয়। হয় আমাদের পুনরায় আরো অতিরিক্ত কৃষিক্ষেত্রে ফিরে যেতে হবে, আর না হয় সিঙ্গাপুরের মতো শিল্প ব্যবসায় মনোযোগ দিতে হবে। কৃষিকে কখনোই একদম বাদ দেওয়া যাবে না। তবে কত পারসেন্ট আমরা কৃষিতে থাকব, আর কত পারসেন্ট শিল্প-কারখানা ও ব্যবসায় থাকব, সে বিষয়টি নির্ধারণ করা খুব সহজ নয়। কোনো সরকারই এ প্রধান বিষয়টিকে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেনি। কৃষি ও কৃষককে একীভূত করতে হবে। কৃষক বাঁচলে কৃষি বাঁচবে। কৃষক ঋণগ্রস্ত হলে কৃষি বাঁচাবে না। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা ব্যাংক ঋণসহ সরকারি ও বেসরকারি যে সুযোগ-সুবিধা পায়। কৃষক ও কৃষি তার অর্ধেকও পায় না। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা ব্যাংক লোপাট করতে পারে। কিন্তু কৃষকরা ব্যাংকের ভেতরে বেঞ্চে বসার জায়গাও পায় না। হাজার টাকা ঋণের দায়ে কৃষকের ঘরের টিনের চাল, গরু-ছাগল বা সামান্য ভিটেমাটি ব্যাংকাররা জোর করে কেড়ে নিয়ে নিঃস্ব করে দেয়।
এ অবস্থার মধ্যে দারিদ্র্য তো বাড়বেই। বাড়ছেও। কেউ ঠেকাতে পারছে না। ক্রীতদাস হই আর যাই হই, চাকরির জন্য বিদেশে আমাদের অবশ্যই যেতে হবে। ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে অন্তত ২৫ শতাংশ প্রফেশনাল ও নন-প্রফেশনাল লোককে বিদেশে পাঠাতে হবে। যেখানে এখন আছে মাত্র দেড় কোটি। বর্তমান সরকার হোক বা নির্বাচিত সরকার হোক- যারাই ক্ষমতায় আসুক, তাদের অন্তত আগামী ৫ বছরের মধ্যে তিন কোটি লোকের বিদেশে চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। রেমিট্যান্স ছাড়া আমাদের কোনো গত্যন্তর নেই।
এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড গার্মেন্টস ব্যবসায় আমরা আল্লাহর রহমতে ভালো করেছি এবং করছি। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির কারণে এ ব্যবসায় সবসময় টানাপড়েন থাকবে। এখানে প্রতিযোগিতা নয়, এখানে রয়েছে হিংসা, লোভ, মোহ। প্রতিবেশীরা সবসময় এ বিষয়ে শ্যেনদৃষ্টি রাখবে। সেসবকে মূল্যায়ন করে এ পথেও আমাদের দূরদৃষ্টি রাখতে হবে। এখানে প্রয়োজন নির্জলা দেশপ্রেমিকতা। তাহলেই আমরা দারিদ্র্যবিমোচন, দারিদ্র্য দূরীকরণ, জিরো দারিদ্র্য, শূন্য দারিদ্র্য যাই বলি না কেন- সেটা অর্জন করতে খুব বেশি সময় লাগবে না, ইনশাআল্লাহ।