জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার ঐক্য সময়ের দাবি
৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৬:৪৭
॥ একেএম রফিকুন্নবী ॥
২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই বাংলাদেশে যে ঐতিহাসিক বিপ্লব সাধিত হয়েছে, তা মহান আল্লাহর একান্ত অনুগ্রহ। ৯২% মুসলমানের দেশ বাংলাদেশের জন্য এটি একটি আল্লাহর অনন্য উপহার। গত সময়ে বিভিন্ন জনপদে এবং যুুুগে বিভিন্ন জাতির পতনের কথা আমরা শুনি, যেমন সামুদ জাতি এবং বাদশাহ আব্রাহার পতন, ফেরাউনের পতন, নবী মুহাম্মদ সা.-এর সময়ের জাতি-গোষ্ঠীর পতন, ইরানে শাহ পাহলভীর পতন, আফগানিস্তানে ব্রিটিশ, রাশিয়া ও আমেরিকার পতন, শ্রীলংকার রাজার পতন, সিরিয়ার স্বৈরশাসকের পতন আর আমাদের স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন একই সূত্রে গাঁথা।
যুগে যুগে মহান আল্লাহ স্বৈরশাসকদের অমানবিক আচরণে তাদের দুনিয়ায়ই জিল্লতি দেন এবং আখিরাতে তো রয়েছে সীমাহীন জাহান্নামের অশান্তি আর জিল্লতি। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের জন্য দেশের ছাত্র-জনতার ওপর সীমাহীন অত্যাচার, জেল, খুন, গুম, আয়নাঘরের নির্যাতনে মহান আল্লাহর সহ্যসীমা ছাড়িয়ে যায়। ফলে হাসিনার ১৬ বছরের কুকর্মের ফল হিসেবে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অস্বাভাবিক জনরোষ গণরোষের দিকে অগ্রসর হতে থাকায় দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীর সাহায্যে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পলায়নের ব্যবস্থা হয়। স্বৈরশাসকের যুগের পতন হয়। প্রায় ২০০০ ছাত্র-জনতার জীবন কেড়ে নেয় হাসিনার বাহিনী। আর আহত ও পঙ্গু হয় প্রায় ত্রিশ হাজার ছাত্র-জনতা।
এ সময়ে দেশের আপামর ছাত্র-জনতা ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের জন্য কাজ করে। এমনকি মায়েরা তাদের ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে মাঠে নামে। মহান আল্লাহ তাঁর দয়ার সাগর বাংলাদেশের প্রতি নাজিল করেন। দেশ একটি সফল বিপ্লবের স্বাদ পায়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। যদি একটি বিপ্লবী সরকার গঠিত হতো, তবে ভালো হতো। যেমন সিরিয়ায় বিপ্লবী সরকার গঠন করে পরবর্তী ৫ বছরের নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা প্রতিবেশী দেশের খপ্পরে পড়ে তাদের দোসরদের পরিকল্পনায় আগের শাসনতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে পড়ে গেছি। স্বৈরশাসক হাসিনার প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে দেশের চালিকাশক্তির সব জায়গায় তাদের দোসররা বসে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পথ এগোতে বাধার সৃষ্টি করছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার লোকদের সহযোগিতা করছে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী ১৪ দল। বিএনপির একটি অংশও তাদের সাথে হাত মিলিয়ে হাসিনার দোসরদের লুট করা টাকা আর ‘র’-এর পরামর্শে দেশকে জুলাই বিপ্লবের ধারায় চলতে দিতে বাধা সৃষ্টি করছে, যা আগামী দিনের চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার দেশের ভালো করার জন্য পরিকল্পনা নিলেও সরকারের ভেতর ও হাসিনার দোসররা সরকারের কাজে বাধার সৃষ্টি করছে। সরকারের গঠিত জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি দেয়ার জন্য সর্বাগ্রে গণভোটের বিরোধিতা করছে, যা জুলাই বিপ্লবের জন্য শুভ লক্ষণ নয়। জুলাই সনদের জন্য গণভোটের দাবি ছাত্র-জনতা চালিয়ে যাচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীসহ ৮ দল একত্রিত হয়ে মাঠে-ময়দানে ভূমিকা রেখে চলেছে। ৮টি বিভাগে ৮ দলীয় জোট ছাত্র-জনতাকে একত্রিত করার জন্য জনসভার আয়োজন করেছে, যা ৩০ নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে। আমরা এ জোটের কাজকে অভিনন্দন জানাই। ছাত্র-জনতা এক থাকলে কোনো বাধাই এ দেশে পাত্তা পাবে না। জুলাই সনদের গণভোট হলেই তার আলোকে জাতীয় নির্বাচন হতে হবে।
সরকার ইতোমধ্যেই জুলাই সনদের গেজেট প্রকাশ করেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের বড় সাফল্য বিডিআর হত্যা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। যা এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে আঘাত হেনেছিল। নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে গণভোট আর জাতীয় নির্বাচন একই দিনে করা নিয়ে। দেশের অধিকাংশ দল ও মতের লোকেরা গণভোট আগে করার দাবি করে আসছে। এ নির্বাচন কমিশনের যেহেতু নির্বাচনের কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তাই আমরা মনে করি, দুটি নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ একসাথে না নিয়ে গণভোট আগে করলে জনগণের মধ্যে ভোটের আমেজ আসবে এবং নির্বাচনের অভিজ্ঞতাও নির্বাচন কমিশন অর্জন করতে পারবে। সব জায়গায়ই নতুন লোক নিয়োগ করতে হচ্ছে। যদিও আগের স্বৈরাচারের দোসররা অনেক জায়গায় বসে রয়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশের জন্য দেশের ছাত্র-জনতার ত্যাগ-কুরবানির কথা স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার আলোকে জুলাই সনদ আগামী ১০০ বছরের দিকনির্দেশনা পাবে। তাই জুলাই সনদের জন্য বিলম্ব না করে এ মাসেই গণভোট করার জোর দাবি করছি।
দেশ ও দেশের মানুষের জন্যই বাজেট ও অর্থ ব্যয়। বিগত দিনে আমাদের অনেক অপচয় হয়েছে, গণভোটের জন্য টাকা পাওয়ার কোনো অসুবিধা হবে না। দরকার দৃঢ় পদক্ষেপ। ইতোমধ্যেই ইউনূস সরকার অনেক ভালো পদক্ষেপ নিয়েছেন। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করার কাজ করছেন। চুরি, লুট অনেকাংশে রোধ করা গেছে। লুট করা টাকা ফেরত আনার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। দেশদরদি ছাত্র-জনতা এবং সরকারের ভেতরে আমলারা দেশে-বিদেশে ভালো ভূমিকা রাখছে। তাদের প্রণোদনা দিয়ে দেশের বর্তমান উন্নয়ন ও অগ্রগতির পক্ষে কাজ করানোর উদ্যোগ আরো বাড়াতে হবে।
দেশের মধ্যে ছাত্র-জনতার আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ইতোমধ্যেই প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নির্বাচনে দেশদরদিদের বিজয়ে দেশের ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের মনোনীত সৎ, যোগ্য, চাঁদাবাজহীন নেতা বানিয়ে দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ডাকসু, জাকসু, চাকসু ও রাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির মনোনীত প্যানেল নিরঙ্কুশ বিজয়ে দেশের মানুষ আশান্বিত হয়েছে। আগামী নির্বাচনেও দেশের ছাত্র-জনতার সৎ, যোগ্য, দুর্নীতিমুক্ত নেতা বানিয়ে দেশকে একটি আদর্শ জনবান্ধব সরকার গঠন করতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশকে একটি পরিপূর্ণ সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গঠনের জন্য জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির জনগণের মধ্যে কাজ করে যাচ্ছে, যা ইতোমধ্যেই জনগণ বুঝে ফেলেছে। জুলাই ৩৬-এর জন্য জামায়াত-শিবিরের ত্যাগ ও কুরবানি দেশের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা বুঝে উঠতে সক্ষম হয়েছে। ডাকসু, জাকসু, চাকসু ও রাকসু নির্বাচনে ছাত্র-ছাত্রীরা শিবির সমর্থিত প্যানেলকে ভোট দিয়ে প্রমাণ করেছে দেশদরদি ছাত্র-ছাত্রীরা সৎ, যোগ্য, চাঁদাবাজহীন নেতাকে নির্বাচিত করতে হবে।
জামায়াতের নেতৃত্বে ইতোমধ্যেই ৮ দলের ঐক্য করে জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারীদের ঐক্যের ডাক দিয়েছে। ৮টি বিভাগে তারা জনসভা করে জুলাই সনদের ওপর গণভোটসহ ৫ দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। গত কয়েকদিনে রাজশাহী, খুলনা, রংপুর ও বরিশালে জনতার ঢল নেমেছিল ৮ দলের জনসভায়। জনসভাগুলোয় জামায়াতের আমীরসহ সবাই দুর্নীতিমুক্ত ও চাঁদাবাজহীন দেশ গঠনের ব্যাপারে জোরালো বক্তব্য দিয়েছেন, যা জনগণ হাত নেড়ে সমর্থন দিয়েছেন। এ দেশের মানুষ এখন অনেক সচেতন, তারা ভারতীয় আধিপত্য এবং রাম-বামদের সাথে নেই। শুধু তাই নয়, বিএনপির যারা চাঁদাবাজি করছে গ্রাম থেকে শহরের বাসস্ট্যান্ড, বাজারঘাট, তা মানুষ জেনে ফেলেছে যে, এসব চাঁদাবাজকে ভোট দিয়ে নেতা বানানো যাবে না। আপনি একজন সাধারণ রিকশাওয়ালা, পানের দোকানদার, সেলুনে বসে খোঁজ নেন তারা সৎ ও যোগ্য লোকদেরই এবার ভোট দেবে।
জামায়াতে ইসলামী এবার ৩০০ আসনে দীর্ঘদিন পূর্বেই এলাকার সৎ, যোগ্য, দুর্নীতিমুক্ত লোকদের সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন দিয়ে সব দলকে ছাড়িয়ে একধাপ এগিয়ে গেছে। জামায়াতের লোকেরা ঘরে ঘরে সৎ লোকের শাসনের ব্যাপারে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। জনগণের বিপুল সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। উল্লেখ্য থাকে যে, জামায়াতের লোক দ্বারা পরিচালিত প্রত্যেক জেলায় একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সফলভাবে চালিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, তারা দেশও ভালোভাবে চালাতে পারবে।
অন্যদিকে কথিত বড় দল ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতেই সক্ষম হয়নি। যাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষরা মিছিল-মিটিং করছে। মারামারি করে মরার খবরও মিডিয়ায় আসছে। অন্যদিকে ছাত্রদের একাংশের যারা জুলাই বিপ্লবের অংশীদার ছিল, তারা রাজনৈতিক দল করে খুব একটা ভালো করতে পারছে না। দুইজন উপদেষ্টা হয়ে তারা জনগণের নেতা হিসেবে প্রমাণ রাখতে পারছে না। বরং কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে আগামী নির্বাচনে ভালো করতে পারবে না বলে প্রচারে এসেছে। অন্যদিকে সাদিক কায়েমরা জুলাই বিপ্লবের অগ্রভাগে থেকে যেমন ছাত্র-জনতার ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে আবার ডাকসু নির্বাচনে বিপুল ভোট পেয়ে ছাত্র-জনতার প্রশংসায় ভাসছে। ছাত্র-জনতা তাদের নেতা বানাতে সততা, দুর্নীতিমুক্ত লোকদেরই বাছাই করতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে, ইনশাআল্লাহ। দেশে-বিদেশে সবার সাথে আমরা ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেই চলতে চায়। কারো প্রভুত্ব মানতে নারাজ।
ছাত্রদের দ্বারা গঠিত এনসিপি এখনো কীভাবে জাতীয় নির্বাচন করবে, তা নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়নি। নিজেরা একা বা জামায়াতের ৮ দল অথবা বিএনপির সাথে জোট করবে, তা ঠিক করতে পারেনি। অন্যান্য দল বা ব্যক্তিরাও আগামী দিনের জাতীয় নির্বাচনে ভালো ভূমিকা রাখার কোনো দিকনির্দেশনা বাস্তবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। মানুষ যেহেতু আগের তুলনায় অনেক সচেতন, তাই ব্যক্তি ও দলের ভূমিকার ওপরই জনগণ তাদের নেতা বাছাই করবে। এনসিপি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে আগামী নির্বাচনে মোটেই ভালো করতে পারবে না। বিএনপির সাথে জোট করলে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া সম্ভব হবে না। বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা তাদের ভালোভাবে গ্রহণ করবে না।
অন্যদিকে তারা যদি জামায়াতসহ ৮ দলের সাথে ঐক্য করে, তাহলে হয়তো তারা তুলনামূলকভাবে ভালো ফল পেতে পারে। তাই তাদের ব্যক্তির লোভ-লালসা ক্ষমতার স্বাদের চেয়েও আগামী দিনে জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারীদের ঐক্য বজায় রাখার দিকে নজর রাখতে হবে। স্বৈরাচার ও তার দোসররা বসে নেই। দেশীয় ও বিদেশি ষড়যন্ত্র এখনো কার্যকর। তাই আসুন, আমরা যারা জুলাই বিপ্লবের অংশীদার, তারা একত্রিত হয়ে বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ার কাজে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখি।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।