একটি বেহেশতি আবহ
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১২:০৪
॥ নূরুন্নাহার নীরু ॥
এমনো কি হয় কোনো গেট টুগেদার একটি বেহেশতি পরিবেশ নিয়ে আসতে পারে? হ্যাঁ, সে বর্ণনাই টানছি আজ। গত ৩১ জানুয়ারি শুক্রবার ছিল মেডিকেল থানা উত্তরের একটি পারিবারিক মিলনমেলা। তবে এটি শুধুই মিলনমেলা ছিল না। শিশুদের উৎসবও। বলা যায়, মূলত ডাক্তার বা চিকিৎসকরা হচ্ছেন দেশের প্রথম সারির নাগরিক। আর এই ডাক্তাররা যে কতটা চৌকস, তা বিশেষভাবে জানতে পেরেছি সামনে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়ে। একজন চিকিৎসকের স্ত্রী ও দুজন চিকিৎসকের মা হিসেবে এ সুযোগটা আমি প্রতিনিয়তই পেয়ে থাকি।
মেডিকেল থানা উত্তর গেট টুগেদার করে থাকে প্রায় প্রতি বছরই, কিন্তু বিগত সময়গুলো স্বৈরাচারের দাম্ভিকতায় সাধারণ জনগণ সহজ জীবনযাপন করতে পারেনি খুব। সে অবস্থায় স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে এমন হৃদয় খুলে পারিবারিক আনন্দ উপভোগ করার মতো পরিবেশ থেকে বঞ্চিত ছিল সাধারণ জনগণ; বিশেষ করে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনও। অন্যায় কিছু না করলেও সর্বদাই তাদের একটা ভীতি ও আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাতে হতো। ফলে কখনোই সন্তানাদি নিয়ে সহজ-সাবলীলভাবে আনন্দ উপভোগ করা ছিল কঠিন। কিন্তু আল্লাহর অশেষ কৃপায় ২৪-এর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ৩৬ জুলাই গড়ে দিয়ে নিয়ে এসেছে স্বস্তির পরিবেশ। এ অবস্থায় মেডিকেল থানার পক্ষ থেকে এক আনন্দ আয়োজন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল; বিশেষ করে শিশুদের প্রাণবন্ত পরিবেশে কিছু শিক্ষণীয় বিষয়ে চৌকস করে তোলা। উদ্যোগে মেডিকেল থানা উত্তর থাকলেও এর মূল পরিকল্পক ছিলেন স্বয়ং খালিদুজ্জামান; সবার প্রিয় খালেদ ভাই মেডিকেল বিভাগ থানা আমীর। চিকিৎসকদের সন্তানই নয়, উপস্থিত ছিল তাদের নাতি-নাতনি, এমনকি আত্মীয়-পরিজনও। উপভোগ করেছিল একটি সুষ্ঠু-সুস্থ বিনোদন প্রহর। ৩১ জানুয়ারি পরিষ্কার ঝলমলে একটি দিন। ভোর ৬:৪৫-এ গাড়ির জন্য সবাই প্রস্তুত। বিভিন্ন স্পট থেকে ডেলিগেটদের তুলে নিয়ে গাড়ি চলল আপন গতিতে আনন্দ আয়োজন স্থলে। এ গাড়িতে ওঠা নিয়েও ছিল সার্বিক শৃঙ্খলাপূর্ণ সুব্যবস্থা। পূর্ব থেকেই নারী-পুরুষদের পৃথক বাস অথবা দম্পত্তি বা পরিবারের জন্যও পৃথক বাসের ব্যবস্থা হিসেব করে করে পুরুষ ডাক্তারদের পাশাপাশি মহিলা ডাক্তাররাও অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করেছিল। এভাবে সুন্দর-সুচারু একটা পরিবেশ সৃষ্টি করার কৃতিত্ব রক্ষা করেছিলেন তারা। বলাইবাহুল্য গেট টুগেদারে অংশগ্রহণকারী ছিল সব মিলিয়ে ১০০০-এর মতো। তারপরও অত্যন্ত দক্ষতা ও শৃঙ্খলার সাথে গোটা আয়োজনটাই ছিল প্রশংসনীয়।
গাড়ি চলছে শীত শীত সকালের মৃদুবায়ে মাঝারি গতিতে মোটামুটি জ্যামমুক্ত একটা পরিবেশে। লক্ষ্যস্থল গাজীপুরের “কোকোমো সানসেট রিসোর্ট।” প্রায় দেড় ঘণ্টা চলার পর গাড়ি এসে থামলো। ইতোমধ্যে গাড়িতেই হালকা খাবার হিসেবে কেক ও বিস্কিট খাওয়া হয়েছিল সবার। রওনা দেয়ার শুরুতেই দোয়া পাঠ, মোনাজাত। সত্যিই যেন রহমতের ছায়ায় আচ্ছাদিত হয়ে পৌঁছালো সবাই।
গাড়ি পার্কিংয়ের সুন্দর ব্যবস্থা। বাসগুলো একদিকে। মাইক্রো, প্রাইভেট কার চমৎকার সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আমরা সব হুড়হুড় করে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। শুরুতেই বেলুন দিয়ে সাজানো কিডস ফেস্টিবল গেট। ভেতরে ঢুকতেও সেই অসাধারণ শিশুসংবর্ধনা। জায়গায় জায়গায় ওদের জন্যই আকর্ষণীয় সজ্জা। সাথে শিশুকর্ণার। আরো ছিল প্রচুর চকলেট আর আইসক্রিমের ব্যবস্থা। বড়দের জন্য কফি। আমাদের আগেই পৌঁছে যাওয়া শিশুরা অলরেডি মনের আনন্দে ততক্ষণে নিজের বাড়িই যেন করে নিয়েছে স্থানটিকে।
প্লে গ্রাউন্ডের জন্য বিরাট বড় মাঠ প্রস্তুত। একপাশে স্টেজের মতো সাজানো। ওখানেই সংরক্ষিত হচ্ছিল শিশুদের বিভিন্ন বিজ্ঞান প্রজেক্ট, চিত্রকর্ম প্রদর্শনী। ঘুরে ঘুরে দেখে আমি ভীষণ চমৎকৃত হয়ে উঠি। সত্যিই এমন একটা সুযোগ না করে দিলে এ শিশুদের প্রতিভা বিকাশের বাস্তবায়ন আড়ালেই থেকে যেত। পরিকল্পককে মনে মনে দারুণ ধন্যবাদ দিয়ে এগোতে লাগলাম।
ঘোষণা আসছিল; খাবার ঘরে গিয়ে সবাই যেন সকালের নাশতার পর্ব শেষ করে নেয় নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই। ও হ্যাঁ ভুলেই গিয়েছিলাম। পুরো দিবসটাই আজ সময়ের নিগড়ে বেঁধে দেয়া। ফলে অযথা সময় নষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ঢুকে পড়লাম খাবার ঘরে। পুরুষদের একপাশে আর মহিলাদের পৃথক আরেক পাশে। বিরাট বড় হলরুমে গোল গোলটেবিলে সাজানো বসার ব্যবস্থা। তবে খাবার নিতে হবে নিজ হাতে নিজের পছন্দমতো। অনেকটা বুফে সিস্টেম। খিচুড়ির ম ম গন্ধ, সাথে ডিমভাজা, সালাদ আর আচার! আচার দেখে অনেকেরই ভুল হয়ে যাবার মতো হচ্ছিল সেটি কি আসলে গোশত? এতই চমৎকার করে তৈরি। আরো বেশি অবাক হওয়ার বিষয় ছিল, আচার ছিল সাতকড়ার, যা অনেকেরই বোধগম্যের বাইরে। এত মজার জিনিসটার কদরতো শুধু সিলেটিরাই জানেন যেহেতু ওটি একচেটিয়া সিলেট অঞ্চলের ফল। বাবার চাকরির সুবাদে জেলায় জেলায় ঘুরাতে আর বিশেষ করে হলো জীবন কাটাতে আমার কাছে তো বিষয়টা যেমনি পরিষ্কার তেমনি আকর্ষণীয় মজাদার। আমি নিজেই এর আচার বানাই। কিন্তু সেদিনেরটা সত্যিই ছিল দারুণ মজাদার। আমি হার মেনেছি। খিচুড়ি কম করে খেলেও আচার খেয়েছি দ্বিগুণ! এখানেও মনে মনে শুধু ধন্যবাদই দিচ্ছিলাম সৌখিন সেই খাদ্য ব্যবস্থাপককে। যিনি খাদ্য বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। কী চমৎকার রুচিশীল।
মাইকের ঘোষণানুযায়ী আমরা সব মহিলাও গিয়ে বসলাম বিশাল মাঠের একপ্রান্তে। যদিও আমাদের জন্য পৃথক মাঠে পৃথক সুশোভিত পেন্ডেল অপেক্ষমাণ ছিল। কিন্তু ঐ মুহূর্তে ঘোষণা এলো উদ্বোধন হতে যাচ্ছেÑ ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা ছোট্ট ড্রোন আকাশময় ঘুরে বেড়াচ্ছে, যা শিশুদের দৃষ্টি সীমার মধ্যে। আর এক বিশাল বেলুনের ঝাড় এখন ওড়ার জন্য প্রস্তুত। “সত্যিই আজ শিশুমেলায় শিশুপযোগী সব আয়োজন ওদের চেতনাকে রাঙিয়ে তুলুক, জাগিয়ে রাখুক স্মৃতিপটে এই বিশেষ দিন।” প্রথমে আল কুরআন থেকে পাঠ অবশেষে আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে উড্ডীয়মান বেলুনের গতি যেন স্পষ্টই মনে করিয়ে দিচ্ছিল, আজ যে যেভাবেই থাকি না কেন, একদিন এভাবেই ফিরে যেতে হবে স্বীয় প্রভুর কাছে! তবে তা কতটা বর্ণাঢ্য হবে? কতটা সাদরে গৃহীত হবে?
উপস্থিত সকল ডেলিগেট অর্থাৎ শিশু-যুবা-বুড়া-কিশোরী-মহিলা সবাইকে মেডিকেল থানার পক্ষ থেকে গিফট প্রদান করা হলোÑ পুরুষদের জন্য সবুজ গেঞ্জি আর মহিলাদের জন্য পারপেল দোপাট্টা। অসাধারণ এক আবহ। একই রঙের সবাইকে লাগছিল যেন বেহেশত থেকে নেমে আসা মানবপরী। ভিড়ের মাঝেও কোনোভাবে আমার হাসবেন্ডকে একটু খুঁজে দেখলামÑ বাহ্ দারুণ লাগছে। দশ বছর কমে গেল যেন!
অবশেষে ঘোষণানুযায়ী আমরা চলে গেলাম যথাস্থানে। শিশুদের খেলার প্রস্তুতি। আমাদের চৌকস লেডি ডাক্তাররা কেউ ভলান্টিয়ার, কেউ বিচারক, কেউ ঘোষক হিসেবে দারুণ নৈপুণ্যতার স্বাক্ষর রাখলেন। মনেই হচ্ছিল না এরাই করে রোগীর সেবা আন্তরিকতা আর ভালোবাসা দিয়ে।
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী সন্তানের সাফল্যে ‘গাজা: মোরা গড়ি; স্বপ্নের নগরী’ শিরোনামে লেখা একজন বাবার অনুভূতি তুল ধরা হলো, ‘আলহামদুলিল্লাহ, চ্যাম্পিয়ন হলো রাহনুমা আহসান; আমাদের আদরের কন্যা। ও কেবল সাড়ে এগারোতে পা রাখলো। আলহামদুলিল্লাহ, পঞ্চম-এ প্রথম হয়ে ক্লাস সিক্সে উঠেছে। কিন্তু মনটা খারাপ; এখনো পুরস্কার পায়নি। হয়তো পাবে। কিন্তু তাৎক্ষণিকের গুরুত্বই আলাদা। শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে গিফট সাইকোলজিটি আমরা অনেকেই ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে বুঝতে চাই না। শৈশবে গিফট হিসেবে কম্পাস পেয়ে কীভাবে গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এবং খেলনা হেলিকপ্টার পেয়ে বিমান আবিষ্কারক রাইটব্রাদার্স হলেন, তা তাদের জীবনীতেই গুরুত্ব দিয়ে লেখা আছে। যাহোক ওর নানা ডা. আব্দুল আজিজ ডাক্তারদের নেতা হওয়ার সুবাদে রাহনুমা গত শুক্রবার ৩১ জানুয়ারি ডাক্তারদের পারিবারিক মিলনমেলায় দাওয়াত পায়। সেখানে ছিলো ওদের জন্য কিডস কমপিটিশন ‘থ্রি-ডি প্রেজেন্টেশন’। রাহনুমা কিন্তু এবার সিরিয়াস; যে কোনো মূল্যে সেরা হতে চায়। প্রথমে কী প্রজেক্ট করবেÑ এ নিয়ে ভাই-মা-বাবা সবার সাথে বিস্তর পরামর্শ করে থিম ঠিক করলো। ওর থিম ছিলো বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিন এলাকা গাজাকে নিয়ে। থিমের টাইটেলটা এমন, ‘গাজা: মোরা গড়ি; স্বপ্নের নগরী’। এরপর আমার হাতে ধরিয়ে দিলো বিশাল এক ফর্দ। আমাকে সাথে নিয়ে দোকান থেকে কিনে আনলো নানারকম কাগজসহ প্রায় পাঁচশত টাকার জিনিস। এরপর থিমের আলোকে সে একটি ডামি প্রজেক্ট সাজালো। পরিশেষে তিনদিন টানা প্রায় ৩০ ঘণ্টা কাটাকাটি ও সাঁটাসাঁটি করে তার প্রজেক্ট শেষ করলো। ওর চোখ ঢুলুঢুলু; যখন কাজ শেষ হলো, তখন রাত প্রায় ২টা। ওদিকে ওর নানু বলে দিয়েছেন, ভোর ৫টায় উঠে রেডি থাকতে।
দুপুরে খাওয়ার পর আমি কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন। রাহনুমার আম্মুর চিৎকারে জেগে উঠলাম। সে আপ্লুত হয়ে বলছে, আলহামদুলিল্লাহ ডাক্তার-পরিবারের শতাধিক জিনিয়াস সন্তান-নাতিদের ভেতর আমাদের কন্যা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। আমীরে জামায়াত নিজহাতে পুরস্কার দিয়েছেন। আমি বললাম, আমার তো মনে হয় তুমিই চ্যাম্পিয়ন হয়েছো।
যখন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে রাহনুমার নাম ঘোষণা হলো, ওর ছোট নানু খুশিতে চিৎকার করে উঠলো। উপস্থিত মহিলারা তো অবাক; জিজ্ঞেস করলো, আপনার কী হয়? তিনি বললেন, আমার নাতনি। রাহনুমার সাথে ছিলো তার নানা, ২ নানু, মামি ও মামাতো ভাই নার্সারি পড়ুয়া রাইয়ান। সুতরাং ওকে আর কে আটকায়। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকে এ জমানার জয়নাব আল গাজালি, মারিয়াম জামিলা ও হাফিজা আসমার মতো দীনের জন্য কবুল করুন। আমীন।’ উল্লেখ্য, এ শিশুটির বাবার নাম ডা. আহসান হাবীব ইমরোজ।
অনুষ্ঠানে ফুলের মতো সুন্দর শিশুরা প্রাণখুলে খেললো, গাইলো, বিজয়ী হলো। নারীরা নিরাপদ ও নিতান্তই নিজের মতো করে চলার স্বাধীনতা পেয়ে উপভোগ করলো নির্ধারিত খেলাধুলা। আজ সবাই খেলোয়াড়। ওদিকে পুরুষ মহলেও একই চিত্র। আজ সবাই ভুলেই গেছে স্টেথো আর বিপি মেশিন হাতে সাদা এপ্রোনে কোনো কেউ নয় যেন এরা। এরই মধ্যে পুরস্কার বিতরণীও শেষ হলো। আমি অবাক হলাম এত দামি, সুন্দর সুন্দর পুরস্কার সত্যিই রুচির পরিচয় বহন করে। আরো মনে হলোÑ আসলে পরিকল্পনামতো বাজেট করে যথাযথভাবে খরচাদি রাখলে এমনি সুফল সর্বত্রই সম্ভব। উল্লেখ্য, ডেলিগেট ফি এ বাজার অনুপাতে খুব বেশি ছিল না। যেখানে আমি আরো অনেক সংগঠন প্রতিষ্ঠানের সাথে পিকনিকের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি একজন লেখক-সাহিত্যিক হওয়ার সুবাদে। দেখেছি তাদেরকেও। হৃদয়ে এক দৃঢ় প্রত্যয়ী সুর অনুরণিত হচ্ছিল, আজ চাই সৎ-যোগ্য-খোদাভীরু প্রতিনিধি সমাজের সকল স্তরে। আর এরাই যেন তার পথিকৃৎ।
শৃঙ্খলা রক্ষার্থে পুরুষদের জোহরের জামাত চলাকালীন সময়ের মধ্যেই মহিলাদের খাবার ব্যবস্থা করা ছিল। আমরা বসে পড়লাম আবার সেই খাবার হলরুমে-বুফে। পোলাও, রেজালা, রোস্ট, সালাদ, পায়েস, ড্রিংকসÑ মাশাআল্লাহ! তেমন গুরুপাক নয় অথচ মজাদার। সবাই খাওয়া শেষে রিসোর্টের কটেজে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে জোহর আদায় করলাম। এরপর শুরু হলো বোটিং। সারি সারি কটেজগুলোর নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝোরা বা লেক। পাশেই উঁচু মনোরোম একটি ব্রিজ দিয়ে এপার-ওপার বেঁধে দেয়া। এটি পার হয়ে গিয়েই বোটে উঠতে হয়। কোনো মাঝি নেই। নিজেকেই নিজের বোট চালাতে হবে। দেখা গেল বুড়ো বলে কেউ পিছিয়ে রইল না। এখানেও উপভোগ্য দৃশ্য।
নীরবে বয়ে যাওয়া ঝরা। চারদিকে নানারকম গাছগাছালি। চালতা, কামরাঙ্গা, হরীতকী আরো কত কী। আর ওপারে হরিণের আবাস। শিশুদের আনন্দের সীমা নেই। ওরা কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়েই উপভোগ করছিল হরিণ শাবকদের গতিবিধি। আর আমার স্মৃতিতে ভেসে উঠছিল, মানুষের সৃষ্টিই যদি এত সুন্দর হয়! তাহলে না জানি তার স্রষ্টার সৃষ্টি কত অপরূপ। যা আল্লাহ আল-কুরআনে বলছেন, “তোমাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবো যার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হবে ঝর্ণা ধারা। আরো থাকবে স্থায়ী জান্নাতে চমৎকার আবাস। এটাই মহাসাফল্য।” সুবহানাল্লাহ!
ডাক এলো সবাইকে এবার অডিটোরিয়ামে গিয়ে বসতে হবে। এখানেও চমৎকার আয়োজনে মহিলা-পুরুষের পৃথক অবস্থান। নারীরা সুস্থির হয়ে বসলো। বেজে উঠলো আমীরে জামায়াতের আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম। ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ছড়িয়ে পড়লো হলময়। এ ছিল এক মাহেন্দ্রক্ষণ। শিশুরা প্রতীক্ষমাণÑবড়রা উদ্বেলিত!’ মোহতারাম আমীরের সুমধুর কণ্ঠে জীবনের দিকনির্দেশিকামূলক কিছু উপদেশ পাথেয় হিসেবে সঞ্চয় করে নিতে। শ্রদ্ধেয় আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমানের আগমন অনুষ্ঠানকে মোহিত করে তুললো। ডাক্তার হিসেবে যিনি নিজেও একজন প্রথম সারির নাগরিক বটে, তবে তার আরো বড় পরিচয় তিনি একটি আদর্শবাহী রাজনৈতিক দলের কর্ণধার। বলাইবাহুল্য দলটি এমনি এক শক্তিশালী জজবায় উজ্জীবিত যে, যার জন্মলগ্ন থেকেই বিরোধিতা আর বিরোধিতা। তথাপিও ফ্যাসিবাদের সময়ে অন্যায় অহেতুক মিথ্যা অপবাদে অভিযুক্ত হয়ে বেশকিছু শার্দুলকে হারিয়েও আজো চলছে তুর্কি ঘোড়ার মতো ক্লান্তিহীনভাবে। দেশের সব কটি ইসলামী দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনায়, আধুনিক মানসিকতায়, বৈজ্ঞানিক ধারায় সবার আগে এগিয়ে আছে যে দলটি “বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর” বর্তমান আমীরে জামায়াত তিনি ডা. শফিকুর রহমান।
শিশু পরিবেষ্টিত আমীরে জামায়াত শিশু ও পুরুষদের মধ্যে স্বহস্তে তুলে দিলেন সকল পুরস্কার, ক্রেস্ট এবং শেষাবধি ধীরস্থির আবেগী কণ্ঠে তিনি বললেন, “পরিবারের প্রতি বেশি সময় দেয়ায় অভ্যস্ত হতে। এ শিশুরাই আগামীর পথিকৃৎ। দীন কায়েমের তামান্নায় গড়ে তুলতে হবে এদের। উজ্জীবিত করতে হবে শহীদি জজবায় এখন থেকেই। এমন অন্তরঙ্গ মধুময় পরিবেশ যেন আমরা বেহেশতেও পাই, পাই এর চেয়েও অফুরন্ত নিয়ামতে ভরপুর হয়ে। আমাদের শহীদরা যেন আল্লাহর প্রতিশ্রুত নিয়ামতে ভূষিত হতে পারে। থাকতে পারে তাদের রক্তের বিনিময়ে এদেশের মাটি স্বাধীন-স্বার্বভৌম।” আমিন। এবার ফেরার পালা। সূর্য ডোবার আগে আগেই এক হাজার মানুষের এ জনস্রোত ডুবদিল যার যার গাড়িতে ওঠে। কিন্তু খালি হাতে নয় একদিকে আগের মতোই কুপন সিস্টেমের মাধ্যমে বিকেলের নাশতা! অন্যদিকে প্রাণপ্রিয় খালেদ ভাইয়ের (স্বয়ং তার) পক্ষ থেকে চিকেন ফ্রাইর বক্স নিয়ে। এই মানুষটা মানুষকে খাওয়াতে যে কত ভালোবাসেন তারই স্বাক্ষর নিয়ে আমরা চললাম পেছনের “কোকোমো সানসেট রিসোর্টকে” বিদায় জানিয়ে। সত্যিই সূর্য তার রক্তিমাভা ছড়িয়ে দিয়ে বিদায় সম্ভাষণে যেন বলছিল, “তোমরাই জড়ো হবে আবারো কোনো বেহেশতি আবহে। হোক আখিরাতেও।” আমিন।