সামন্তবাদী রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ


৩০ অক্টোবর ২০২৫ ১৭:৪৯

॥ হারুন ইবনে শাহাদাত ॥
পুরোনো ধারার সামন্তবাদী রাজনৈতিক বন্দোবস্ত থেকে বের হয়ে আসাই বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। অথচ জুলাই-আগস্ট বিপ্লব হয়েছে কোনো রাজনৈতিক দলের জমিদারি প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, জনগণের রাষ্ট্র জনগণকে ফিরিয়ে দেয়ার প্রত্যয়ে। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর জনগণ চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ঘুষ-দুর্নীতির হাতবদল প্রত্যক্ষ করছে। তারা পরিবর্তন বলতে দেখছে, এক রাজনৈতিক দলের ব্যানার থেকে আরেক ব্যানারের নিচে সমবেত হচ্ছে পুরোনো দুর্বৃত্তরা। এভাবে মুক্তি আসবে না, বরং সংকট আরো বাড়বে। তাই জনগণ রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার চায়। কিন্তু বাধা এখনো অব্যাহত আছে।
রাষ্ট্র সংস্কারে বাধা : পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, দেশ ও জনগণের মুক্তি রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার ছাড়া সম্ভব নয়। কারণ এ সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন ছাড়া রাজনৈতিক ব্যানারে সামন্ত প্রভু সেজে রাস্তাঘাট, পার্ক, সরকারি খাসজমি; এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দখল করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে বন্দোবস্ত দিয়ে চাঁদাবাজি করা, দখল করে ব্যক্তিগত সম্পত্তির পাহাড় গড়ার পুরোনো দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করা সম্ভব নয়।
তাই জেনে-বুঝে পুরোনো ব্যবস্থার ক্ষমতার মধুচক্রের স্বাদ পাওয়া রাজনৈতিক দলে সমবেত নেতা-কর্মী নামের একটি চক্র বার বার সংস্কার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্র করছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। এমন অভিযোগের তীর দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির দিকেই বেশি সূত্রগুলো জানিয়েছে। একটি সূত্রে প্রকাশ, বিএনপি মুখে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের কথা বলছে অথচ স্থানীয় সরকার ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করছে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৈরি জুলাই সনদের আইনগত মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় গণভোটকে বিতর্কিত করতে জাতীয় নির্বাচনের সাথে করার দাবির আড়ালে উপেক্ষার ষড়যন্ত্র করছে।
চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের চাপ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আন্তরিক চেষ্টার কারণেই তা সম্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রেও বাধা এসেছে বিএনপি ও তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের পক্ষ থেকে। কেন বাধা এসেছে, তা ভোটের ফলাফলে প্রমাণ হয়েছে। চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্যানেল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের নির্বাচনের দাবি উপেক্ষা করছে এবং বন্ধের ষড়যন্ত্র করছে।
এদিকে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন, সেই হিসাবে সামনে সময় আছে মাত্র তিন থেকে চার মাস। কিন্তু বিএনপি এখনো শরিকদের সাথে বোঝাপড়া এবং নিজেদের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করতে পারেনি। একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, দেশের বড় বড় চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্রশিবির অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর বিএনপির মধ্যে নিরপেক্ষ নির্বাচনভীতি ভর করেছে। তাই তারা পুরোনো ধারায় বিজয়ী হওয়ার স্ক্রিপ্ট রাইটার খুঁজচ্ছে। ১/১১ স্টাইলে বাক্স ভরতে প্রশাসন সাজাতে ব্যস্ত। সাথে সাথে মঈনুদ্দিন ও ফখরুদ্দিনের মতো কাউকে খুঁজছে বলেও সূত্রটি জানিয়েছে।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, যারা জনগণের স্রোতের বাইরে গিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের সুযোগ বাধাগ্রস্ত যারা করবে, তাদের অবস্থান ইতিহাসের পাতায় বিশ্বাসঘাতক হিসেবে থাকবে। কারণ ২০২৪-এর আগস্ট বিপ্লব হয়েছে রাজনৈতিক সামন্ত প্রথা ভেঙে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। প্রায় দুই হাজার মানুষ জীবন দিয়েছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তয়ান ধ্বংস করে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। এজন্যই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতির নির্বাচন দাবি করছে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল। পুরোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৃত্ত ভাঙতে পিআর পদ্ধতি একটি কার্যকর উদ্যোগ বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। কিন্তু এখানেও বিএনপির আপত্তি। অথচ তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বহুদলীয় জনগণের পুনরুজ্জীবন দিয়েছেন।
জিয়াউর রহমানের আদর্শ
বিএনপির জনপ্রিয়তার অন্যতম প্রধান কারণ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশমুখী রাজনীতি, ভারতের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান, ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা এবং দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষের রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসীদের সাথে ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার নীতি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও এ আদর্শ যথাযথভাবে অনুরসণ করেছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থতার কারণে রাজনীতিতে অনুপস্থিত। তারেক রহমান ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের নির্যাতনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে লন্ডনে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার পর এখনো সেখানেই অবস্থান করছেন। এমন অবস্থায় দলটির নেতৃত্ব যারা দিচ্ছেন, তারা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শ থেকে সরে গেছেন, এমন অভিযোগ অনেক রাজনীতি বিশ্লেষকদের। এ অভিযোগের সত্য-মিথ্যা নির্ণয়ে গবেষণার প্রয়োজন নেই। বর্তমান কার্যক্রম দেখলে যে কেউ বুঝতে পারেন। তবে তারেক রহমানের সম্প্রতি বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বিএনপির কর্মী-সমর্থক ও বাংলাদেশপন্থী জনগণের মধ্যে আশা জাগছে। তারেক রহমান জুলাই বিপ্লবের পর তার দলের অনেক নেতা-কর্মী- যাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, দখলবাজি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ পেয়েছেন, তাদের বহিষ্কারসহ বিভিন্ন শাস্তি দিয়েছেন। তিনি দেশের জাতীয়তাবাদী সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। কয়েকজনকে লন্ডনে ডেকে নিয়ে কথাও বলেছেন।
তারেক রহমান জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে অনলাইনে গত ২৭ অক্টোবর সোমবার থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। কোনো আসনে একজনকে সবুজ সংকেত দিয়েছেন। তারপরও একই আসনে একাধিক প্রার্থী এখনো তৎপর। দলটির বিদ্রোহী প্রার্থী কালচার কারো অজানা নয়। তাই অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটিয়ে এত অল্প সময়ে সঠিক প্রার্থী যাচাই বড় চ্যালেঞ্জ।
বিদ্রোহ ও সন্ত্রাস বড় চ্যালেঞ্জ
শুধু বিদ্রোহী প্রার্থী নয়, নিজ দলের প্রতিদ্বন্দ্বীকে মাঠ থেকে সরাতে সংঘর্ষ ও হত্যার মতো ঘটনাও ঘটে। গত সোমবার বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বাকলিয়ায় যুবদলের দুই গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষে মো. সাজ্জাদ (২৫) নামে এক যুবদলকর্মী নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় যুবদল ও ছাত্রদলের অন্তত আটজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। সোমবার রাত পৌনে ১টার দিকে নগরীর বাকলিয়া থানার এক্সেস রোডে যুবদলের বহিষ্কৃত নেতা এমদাদুল হক বাদশাহ ও নগর ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক গাজী সিরাজ উল্লাহর অনুসারীদের মধ্যে এ ঘটনা ঘটে। কিন্তু এখন যুবদলের কমিটি নেই। যুবদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে টানানো ব্যানার খুলে ফেলা নিয়ে এ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছে কয়েকটি সূত্র। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে, বাংলাদেশে জানুয়ারি থেকে জুনÑ এ ছয় মাসে রাজনৈতিক সংঘাতে ৬৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এ সময়ে আহত হয়েছেন দুই হাজার ৭৭০ জন। আর সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে ২৭০টি। এর মধ্যে শুধু বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংঘাতে নিহত হয়েছেন ২৬ জন। তবে বিএনপি ও তার সহযোগী এবং অঙ্গ সংগঠনের মধ্যে সংঘাতের হিসেব করলে নিহত হয়েছেন ৪৩ জন। দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ সংঘাত আর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনের মধ্যে সহিংসতার ঘটনায়। আর বাকি সংঘাতগুলোর অধিকাংশেই প্রতিপক্ষ হিসেবে বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো জড়িত।
এসব ঘটনায় অবশ্য দলের পক্ষ থেকে বহিষ্কারের মতো পদক্ষেপসহ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিএনপির দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, ৫ আগস্টের পর থেকে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনায় বিএনপির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের তিন হাজার ২০০ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপির এক হাজার ৮০০ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে দলটি। এদের ৮০০ জনকে বহিষ্কার, ৫০ জনের পদ স্থগিত, কমপক্ষে ৭০০ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ, ১০০ জনকে সতর্ক এবং ১৫০ জনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের নোটিশ দেয়া হয়েছে। ছাত্রদল এখন পর্যন্ত ৪০০ জনকে বহিষ্কার ও ৬০০-এর বেশি নেতা-কর্মীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক দলের কমপক্ষে ১০০ জনকে বহিষ্কার ও ১৫০ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া যুবদলের শতাধিক নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এদিকে যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়, তাদের অনেকের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা পরে প্রত্যাহার করা হয়েছে- এমন ঘটনাও কম নয় বলে একটি বিদেশি বার্তা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযোগে আরো বলা হয়েছে, বহিষ্কারাদেশ নিয়েও অনেকে নিয়মিত দলীয় কার্যক্রমে অংশ নেয় বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘‘যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ নাই এবং তদন্তে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয়নি, তাদের আমরা আবার দলে ফিরিয়ে নেই। তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম। এ পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আমরা কাউকে ছাড় দিই না। আমরা তো অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে বলেছি। পুলিশ কেন গ্রেপ্তার করে না। সরকারের কি দায় নেই? সরকার কেন মব সৃষ্টির সুযোগ দেয়।’
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘শুধু দল থেকে বহিষ্কার করেই দায় এড়াতে পারে না কোনো রাজনৈতিক দল। তাদের এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে যাতে অপরাধে কেউ জড়াতে সাহস না পায়। যদি এমন হয় বহিষ্কার করার পরও আবার দলে ফেরার সুযোগ থাকে, তাহলে তো পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।’
রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা গণতান্ত্রিক রাজনীতির সৌন্দর্য। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে জনগণের ভোটে বিভিন্ন দল ক্ষমতায় আসবে। এ পালাবদল মেনে নিতে পারে না ফ্যাসিস্টরা। বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের কাজে বাধা দেয়া ফ্যাসিস্ট চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। যা প্রতিনিয়তই প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। বিএনপির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, গণঅধিকার পরিষদ, এনসিপিসহ বিভিন্ন দলের সভা-সমাবেশে হামলার অভিযোগ প্রমাণিত বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দল জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের অঙ্গীকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এমন ফ্যাসিস্ট আচরণ অব্যাহত রাখলে দেশ সামন্তবাদী রাজনৈতিক বন্দোবস্ত থেকে বের হতে পারবে না বলে মনে করেন বিশ্লেকরা।