প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
(পূর্ব প্রকাশের পর)
৫. পিতা-মাতার পায়ের নিচে জান্নাত : জাহেমাহ আস-সুলামী (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকটে এলাম জিহাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পরামর্শ করার জন্য। তিনি আমাকে বললেন, তোমার কি পিতা-মাতা আছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, ‘তুমি তাদের নিকটে থাক। কেননা জান্নাত রয়েছে তাদের পায়ের নিচে’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, জাহেমাহ আস-সুলামী রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ডান দিক থেকে ও বাম দিক থেকে দু’বার এসে বলেন, আমি আপনার সাথে জিহাদে যেতে চাই এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাত কামনা করি। জবাবে রাসূল (সা.) বলেন, তোমার মা কি বেঁচে আছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। রাসূল (সা.) বললেন, ‘ফিরে যাও। তার সাথে সদাচরণ কর’। অবশেষে তৃতীয়বার সম্মুখ থেকে এসে একই আবেদন করেন। তখন রাসূল (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করেন তোমার মা কি জীবিত আছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন রাসূল (সা.) বললেন, ‘তোমার ধ্বংস হোক! তার পায়ের কাছে থাক। সেখানেই জান্নাত।’ (ইবনু মাজাহ)।
৬. পিতা-মাতার সেবা জিহাদে গমনের চাইতে উত্তম : আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা.) বলেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর দরবারে এসে বলল, আমি আপনার নিকটে হিজরত ও জিহাদের উপরে বাইয়াত করতে চাই। যার দ্বারা আমি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাত কামনা করি। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন, তোমার পিতা-মাতার কেউ জীবিত আছেন কি? লোকটি বলল, হ্যাঁ। বরং দুজনেই বেঁচে আছেন। আমি তাদের উভয়কে ক্রন্দনরত অবস্থায় ছেড়ে এসেছি। রাসূল (সা.) বললেন, এরপরও তুমি আল্লাহর নিকট পুরস্কার আশা কর? লোকটি বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, ‘তুমি তোমার পিতা-মাতার নিকট ফিরে যাও ও সর্বোত্তম সাহচর্য দান কর এবং তাদের কাছেই জিহাদ কর।’ (মুসলিম শরিফ)। তিনি আরও বলেন, ‘তুমি তাদেরকে হাসাও, যেমন তুমি তাদেরকে কাঁদিয়েছ। অতঃপর তিনি তার বায়য়াত নিতে অস্বীকার করলেন’। পিতা-মাতার সেবা করা সন্তানের জন্য ‘ফরজে ‘আইন’। পক্ষান্তরে জিহাদ করা তার জন্য ‘ফরজে কিফায়াহ’। যা সে না করলেও অন্য কেউ করবে ইসলামী রাষ্ট্রের আমীরের হুকুমে।
আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর নিকট কোন আমল সর্বাধিক প্রিয়? তিনি বললেন, ওয়াক্ত মোতাবেক সালাত আদায় করা। আমি বললাম, তারপর কী? তিনি বললেন, পিতা-মাতার সেবা করা। বললাম, তারপর কী? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা’।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেন, তার নাক ধূলি ধূসরিত হোক (৩ বার)। বলা হলো, তিনি কে হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতা উভয়কে কিংবা একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেল, অথচ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারলো না’।
জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) মিম্বরে আরোহণ করলেন। অতঃপর ১ম সিঁড়িতে পা দিয়ে বললেন, আমীন। ২য় সিঁড়িতে পা দিয়ে বললেন, আমীন। এরপর ৩য় সিঁড়িতে পা দিয়ে বললেন, আমীন। লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনাকে তিন সিঁড়িতে তিনবার আমীন বলতে শুনলাম। তিনি বললেন, আমি যখন ১ম সিঁড়িতে উঠলাম, তখন জিব্রাইল আমাকে এসে বললেন, হে মুহাম্মদ! যে ব্যক্তি রামাযান মাস পেল। অতঃপর মাস শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তাকে ক্ষমা করা হলো না। পরে সে জাহান্নামে প্রবেশ করল। আল্লাহ তাকে স্বীয় রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন। তুমি বল, আমীন। তখন আমি বললাম, আমীন’। ২য় সিঁড়িতে উঠলে জিব্রাইল বললেন, যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতাকে বা তাদের একজনকে পেল। অতঃপর সে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করলো না। ফলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করল। আল্লাহ তাকে স্বীয় রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন। তুমি বল, আমীন। তখন আমি বললাম, আমীন’। অতঃপর ৩য় সিঁড়িতে পা দিলে তিনি বললেন, যার নিকটে তোমার কথা বর্ণনা করা হলো অথচ সে তোমার ওপরে দরূদ পাঠ করলো না। অতঃপর মারা গেল ও জাহান্নামে প্রবেশ করলো। আল্লাহ তাকে স্বীয় রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন। তুমি বল, আমীন। তখন আমি বললাম, আমীন’।
৭. মায়ের সেবার গুরুত্ব সর্বাধিক : আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার সেবা পাওয়ার সর্বাধিক হকদার কে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার পিতা। অতঃপর তোমার রক্ত সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়গণ যে যত নিকটবর্তী’।
অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেন, তুমি তোমার মায়ের সেবা কর। ‘কেননা জান্নাত তার দু’পায়ের নিচে।’ (নাসাঈ)।
৮. পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি : আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পিতার ক্রোধে আল্লাহর ক্রোধ’। আবু দারদা (রা.) হতে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি শামে তার নিকটে এসে বলল, আমার মা, অন্য বর্ণনায় আমার পিতা বা মাতা (রাবীর সন্দেহ) আমাকে বার বার তাগিদ দিয়ে বিয়ে করালেন। এখন তিনি আমাকে আমার স্ত্রীকে তালাক দানের নির্দেশ দিচ্ছেন। এমতাবস্থায় আমি কী করব? জবাবে আবু দারদা বলেন, আমি তোমার স্ত্রীকে ছাড়তেও বলব না, রাখতেও বলব না। আমি কেবল অতটুকু বলব, যতটুকু আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট থেকে শুনেছি। তিনি বলেছেন, ‘পিতা হলেন জান্নাতের মধ্যম দরজা। এক্ষণে তুমি চাইলে তা রেখে দিতে পার অথবা বিনষ্ট করতে পার’।
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, আমার স্ত্রীকে আমি ভালোবাসতাম। কিন্তু আমার পিতা তাকে অপছন্দ করতেন। তিনি তাকে তালাক দিতে বলেন। আমি তাতে অস্বীকার করি। তখন বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলা হলে তিনি বলেন, ‘তুমি তোমার পিতার আনুগত্য কর এবং তাকে তালাক দাও। অতঃপর আমি তাকে তালাক দিলাম’। ঈমানদার ও দূরদর্শী পিতার আদেশ মান্য করা ঈমানদার সন্তানের জন্য অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু পুত্র ও তার স্ত্রী উভয়ে ধার্মিক ও আনুগত্যশীল হলে ফাসেক পিতা-মাতার নির্দেশ এক্ষেত্রে মানা যাবে না।
৯. পিতা-মাতার দোয়া নিঃসন্দেহে কবুল হয় : আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তিনটি দোয়া কবুল হয়। যাতে কোনোরূপ সন্দেহ নেই। পিতার দোয়া, মুসাফিরের দোয়া ও মজলুমের দোয়া।’ (আবু দাউদ)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘পিতা-মাতার দোয়া।’ (আল-আদাবুল মুফরাদ)। আরেক বর্ণনায় এসেছে, ‘পিতার বদদোয়া তার সন্তানের বিরুদ্ধে।’ (তিরমিযী)। এককথায় সন্তানের জন্য বা সন্তানের বিরুদ্ধে পিতা-মাতার যেকোনো দোয়া বা বদদোয়া নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট কবুল হয়ে যায়। অতএব এ ব্যাপারে পিতা-মাতা ও সন্তানদের সর্বদা সাবধান থাকতে হবে। যেন সন্তানের কোনো আচরণে পিতা-মাতার অন্তর থেকে ‘উহ্’ শব্দ বেরিয়ে না আসে। নইলে যেকোনো সময় কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয়ে যাওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা থেকে যাবে।
১০. সন্তান হলো পিতা-মাতার পবিত্রতম উপার্জন : ‘আমর বিন শুয়াইব তার পিতা হতে, তিনি তার দাদা আমর ইবনুল আস (রা.) হতে বর্ণনা করেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর নিকটে এসে বলল, আমার সম্পদ আছে। আর আমার পিতা আমার সম্পদের মুখাপেক্ষী। তখন রাসূল (সা.) বললেন, ‘তুমি ও তোমার সম্পদ তোমার পিতার জন্য। নিশ্চয়ই তোমাদের সন্তানগণ তোমাদের পবিত্রতম উপার্জনের অন্তর্ভুক্ত। অতএব তোমরা তোমাদের সন্তানদের উপার্জন থেকে ভক্ষণ কর’। আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত অন্য হাদীসে রাসূল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই সবচেয়ে পবিত্র খাদ্য হলো যা তোমরা নিজেরা উপার্জন কর। আর তোমাদের সন্তানগণ তোমাদের উপার্জনের অংশ।’ (তিরমিযী)।
নেককার সন্তানের সকল নেক আমলের সাওয়াব তার পিতা-মাতা পাবেন। যদি তারা কাফির-মুশরিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ না করেন। পক্ষান্তরে তাদের পাপের অংশ পিতা-মাতা না পেলেও দুনিয়ায় তারা সন্তানের কারণে বদনামগ্রস্ত হবেন। যেভাবে নূহ (আ.)-এর অবাধ্য পুত্র জগদ্বাসীর নিকটে চিহ্নিত হয়ে আছে এবং ছেলেকে বাঁচানোর জন্য প্রার্থনা করে নবী নূহ (আ.) আল্লাহর নিকট ধমক খেয়েছিলেন। (সূরা হূদ : ৪৫-৪৬)। অতএব সন্তানদের অবশ্যই পিতা-মাতা ও বংশের সম্মান ও সুনামের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে।
১১. পিতা-মাতার সেবা বিপদমুক্তির উসিলা : আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, পূর্ব কালে তিন জন ব্যক্তি সফরে বের হয়। পথিমধ্যে তারা মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে পতিত হয়। তখন তিন জনে একটি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেয়। হঠাৎ গুহা মুখে একটি বড় পাথর ধসে পড়ে। তাতে গুহার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। তিন জনে সাধ্যমতো চেষ্টা করেও তা সরাতে ব্যর্থ হয়। তখন তারা পরস্পরে বলতে থাকে যে, এ বিপদ থেকে রক্ষার কেউ নেই আল্লাহ ব্যতীত। অতএব তোমরা আল্লাহকে খুশি করার উদ্দেশ্যে জীবনে কোনো সৎকর্ম করে থাকলে সেটি সঠিকভাবে বল এবং তার দোহাই দিয়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা কর। আশা করি, তিনি আমাদের এ বিপদ থেকে রক্ষা করবেন। তখন একজন বলল, আমার বৃদ্ধ পিতা-মাতা ছিলেন এবং আমার ছোট ছোট কয়েকটি শিশু সন্তান ছিল। যাদের আমি প্রতিপালন করতাম। আমি প্রতিদিন মেষপাল চরিয়ে যখন ফিরে আসতাম, তখন সন্তানদের পূর্বে পিতা-মাতাকে দুধ পান করাতাম। একদিন আমার ফিরতে রাত হয়ে যায়। অতঃপর আমি দুগ্ধ দোহন করি। ইতোমধ্যে পিতা-মাতা ঘুমিয়ে যান। তখন আমি তাদের মাথার নিকট দুধের পাত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, যতক্ষণ না তারা জেগে ওঠেন। এ সময় ক্ষুধায় আমার বাচ্চারা আমার পায়ের নিকট কেঁদে গড়াগড়ি যায়। কিন্তু আমি পিতা-মাতার পূর্বে তাদেরকে পান করাতে চাইনি। এভাবে ফজর হয়ে যায়। অতঃপর তারা ঘুম থেকে ওঠেন ও দুধ পান করেন। তারপর আমি বাচ্চাদের পান করাই। ‘হে আল্লাহ! যদি আমি এটা তোমার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি, তাহলে তুমি আমাদের থেকে এ পাথর সরিয়ে নাও’! তখন পাথর কিছুটা সরে গেল এবং তারা আকাশ দেখতে পেল। (চলবে)
এ পাতার অন্যান্য খবর
এ বিভাগ বা পাতায় আর কোন সংবাদ, কবিতা বা অন্যকোন ধরণের লেখা পাওয়া যায়নি।