॥ মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
কুরআনে ‘পানি’ অর্থে ‘মাউন’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৬৩ বার। পানি থেকে সব প্রাণীর সৃষ্টি। (২১:৩০, ২৪:৪৫, আল ফুরকান : ৫৪)। তারা কি লক্ষ করে না (আওয়ালাম ইয়ারাও) আমি উশর ভূমির ওপর পানি প্রবাহিত করি। তার সাহায্যে উদগত করি শস্য (যারয়ান), যা থেকে আহার্য গ্রহণ করে তাদের আনআম এবং তারাও? তারা কি তবুও লক্ষ করবে না? (৩২:২৭)। এবং প্রাণবন সবকিছু সৃষ্টি করলাম পানি থেকে (বিজ্ঞান), তবুও কি তারা ঈমান আনবে না (ধর্ম)? (২১:৩০)। অতঃপর তিনি তার (আদম আ.) বংশ উৎপন্ন করেন তুচ্ছ তরল পদার্থের নির্যাস/পানি থেকে।(৩২:৮, ৮৬:৬)। আমি কি তোমাদের তুচ্ছ পানি থেকে সৃষ্টি করিনি? (৭৭:২০)। এগুলো দুনিয়াবী সংক্রান্ত (বিজ্ঞান/সৎকর্ম) এবং প্রশ্ন করে সৃজনশীল চিন্তার আহ্বানও রয়েছে এখানে। মুত্তাকিদের যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে (ধর্ম) তার দৃষ্টান্ত তাতে আছে নির্মল পানির নহর (ধর্ম)।(৪৭:১৫)। সদা প্রবহমান পানি। (৫৬:৩১)। আর জাহান্নামিদের পান করতে দেওয়া হবে ফুটন্ত পানি, যা তাদের নাড়ি-ভুঁড়ি ছিন্নভিন্ন করে দেবে। (৪৭:১৫)। এগুলো আখিরাত (ধর্ম ও তাকওয়া) সংক্রান্ত এবং এখানে মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণের শ্রেষ্ঠ পথ ও পাথেয়ের পদ্ধতি বর্ণিত রয়েছে।
এভাবে প্রতিটি শব্দে দুনিয়া (বিজ্ঞান/সৎকর্ম) এবং আখিরাত (ধর্ম ও তাকওয়া) বিদ্যমান। মসজিদে সালাতের পর ঈমান ও আমলের যে দাওয়াত দানের কথা প্রকাশ পায়, তা কখনোই যথার্থ নয়। ক্ষুদ্র চিন্তা থেকে তার উৎপত্তি। এ কথিত আমলের মধ্যে মানবতার কোনো কল্যাণ আছে তা প্রকাশ পায় না। এমনিভাবে ওয়াজ-মাহফিল ও দীন প্রচারে সৎকর্মের (আবিষ্কার, মানব সেবা) কোনো তালিকা প্রকাশ না পেয়ে, বেশি প্রচার করা হয়েছে মৃত্যু আর মৃত্যু পরবর্তী জীবন তথা আখিরাত, জান্নাত-জাহান্নাম, কবর, হাশর-নাশর, পরকাল ইত্যাদি সম্পর্কে। ফলে তা শুধুমাত্র ধর্মীয গ্রন্থ হিসেবেই পৃথিবীবাসীর কাছে সমাদৃত, দুনিয়ার (বিজ্ঞান ও সৎকর্মের) সাথে তাই কুরআনের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে খুবই ক্ষীণকারে। এ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত গ্রহণই আজ বিশ্বে মুসলমানদের অধঃপতনের মূল কারণ।
সৎকর্ম ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানোর জন্য কুরআনে করা প্রশ্নসমূহের উত্তর জানা সম্ভব হলেও, বিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রশ্নের কোনো উত্তর জানা যায় না। যেমনÑ উনজুরু ইলা ছামারিহি, ইযা আছমারা ওয়া ইয়ানয়িহি/কুল, উনজুরু মাযা ফিস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ’। ‘ফানজুর ইলা আছারি রাহমাতিল্লাহি কাইফা ইউহি বায়দা মাওতিহা’। (৬ : ৯৯/১০ : ১০১/সূরা রূম : ৫০)। এখানে দুটিতে প্রশ্নবোধক চিহ্ন (কাইফা/মাযা) ব্যবহৃত হয়েছে, অন্য একটিতে হয়নি। আয়াতত্রয়ে ব্যবহৃত আরবী শব্দ ‘উনজুর’ শব্দের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ (ধর্ম) এবং বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা করার আদেশ বেশ সুস্পষ্ট। উপরোক্ত আয়াতত্রয়ে ‘উনজুরু’ ক্রিয়া শব্দের মূল ‘নজর’ শব্দটি কুরআনে মোট আছে ১২৯ বার। এর অন্য দুটি অর্থ অবকাশ/অপেক্ষা ছাড়াও বহু শব্দ চিন্তা-গবেষণার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। এর সাধারণ অর্থ নজর দেওয়া/দেখা হলেও কুরআনের দৃষ্টিতে এর গভীর তাৎপর্য বিদ্যমান। এখানে শুধু বৃক্ষ ও পাকা ফলের প্রতি লক্ষ করে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়া বা দু চোখ ভরে বিশাল আকাশমণ্ডলো-কোটি কোটি তারকারাজি আর পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ অনুভব করার কথা বলা হয়নি। বরং বৃক্ষের (শাজারুন) জন্ম ও বিকশিত হয়ে ওঠার রহস্য উন্মোচনের কথাই এখানে প্রকাশ পায়, যা বর্তমান বিজ্ঞান গবেষণায় দৃশ্যমান। বিজ্ঞানের পরিভাষা-জাইলেম, ফ্লোয়েম, ক্যাম্বিয়াম, করটেক্স, এপিডার্মিস, কিউটিকল, স্টোমেটা, সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া (সিনথিসিস), প্লাস্টিড, ক্লোরোপ্লাস্ট (সবুজ রং), ক্রোমোপ্লাস্ট (রঙিন/নানা রং) লিউকোপ্লাস্ট, ক্লোরোফিল, গ্লুকোজ, ফাইটোপ্লাংটন, লিমনোলজি-উদ্ভিদ, প্রাণী এবং অণুজীবের জন্ম ও বিকশিত হওয়া রহস্যের সাথে জড়িত। মূল, মূলরোম, মূলটুপি, প্রস্বেদন, কাণ্ড, পাতা, ফুল-ফল, বর্ণ এবং স্বাদের বৈচিত্র্য (আলওয়ানুন মুখতালিফুন) ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এবং কেন/কীভাবে তা টিকে আছে এবং কীভাবে বৃক্ষে ফল ধরে ও পাকে, পরাগায়ণ ঘটে, একই পানি (বি মাইন ওয়াহিদিন-১৩:৪), মাটি, তাপ, বায়ু, অথচ তার বিভিন্ন স্বাদ-সেটি কীভাবে সম্ভব? কোন্ জীবাণু/ভাইরাস/কীট/কোষ এখানে সক্রিয় থেকে তার বৃদ্ধি এবং ধ্বংস (পচন) ঘটায় তা নিয়ে গভীরভাবে গবেষণার মাধ্যমে আল্লাহর পরিচয় উদ্ঘাটনের কথাই বলা হয়েছে এখানে। বলা হয়েছে, ‘আমি তাদের জন্য আমার নিদর্শনাবলি (দৃশ্য এবং অদৃশ্য বস্তু) ব্যক্ত করব, বিশ্বজগতে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে, ফলে তাদের নিকটে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, তাই-ই (কুরআন) সত্য। এটা কি তোমার প্রতিপালক সম্পর্কে যথেষ্ট নয় যে, তিনি সর্ববিষয়ে অবহিত? (৫৩)। ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে বহু নিদর্শন (দৃশ্য এবং অদৃশ্য বস্তু) রয়েছে, তারা এসব প্রত্যক্ষ করে (চর্ম চোখে), কিন্তু তারা এ সবের প্রতি উদাসীন (গবেষণায় লিপ্ত হয় না)। তাদের অধিকাংশ আল্লাহতে বিশ্বাস করে, কিন্তু তারা শরিক করে। তবে কি আল্লাহর সর্বগ্রাসী শাস্তি থেকে অথবা তাদের অজ্ঞাতসারে কিয়ামতের আকস্মিক উপস্থিতি থেকে তারা নিরাপদ?’ (১০৫-১০৭)। এ আয়তসমূহ এতদিন সিন্দুকেই আটকানো ছিল। এরূপ বহু আয়াত এখনো সিন্দুকে আটকানো। কুরআন নিয়ে গবেষণা করলে তার বহু প্রমাণ স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
কুরআনে এ ধরনের শত শত আয়াত ছাড়াও শব্দভিত্তিক ইলমুন (৭৭৭ বার), ইয়াতাদাব্বারুন (৪ বার), ইয়াতাফাক্কারুন (১৮ বার), ইয়াকিলুন (৪৯ বার), তুবসিরুন, ইকরা, দারসুন-ইত্যাদি গবেষণাসমৃদ্ধ, চিন্তার উৎসযুক্ত বহু শব্দ, চিহ্ন এবং প্রশ্নবিহীন বহু আয়াতের ব্যবহার বিদ্যমান। প্রশ্নের চিহ্নবিহীন চিন্তার উৎসযুক্ত কয়েকটি আয়াত। যেমন-আর তার নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে মৃত্তিকা থেকে মানুষের সৃষ্টি এবং বিকাশ, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দয়া ভালোবাসা, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য, রাতে এবং দিবাভাগে মানুষের নিদ্রা এবং রিজিক অনুসন্ধান, ভয় (দুর্ঘটনা) ও ভরসা (শিল্প কলকারখানা স্থাপন) হিসেবে বিদ্যুৎ, বৃষ্টি, মৃত্যুর পর ভূমিকে পুনরুজ্জীবিতকরণ-ইত্যাদি। এতে জ্ঞানীদের (বিজ্ঞানী যারা) জন্য বহু নিদর্শন রয়েছে। (৩০:২০, ১২, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ৩০:৪৮, ৩১:১০-কুরআন দ্রষ্টব্য)। এ ৮টি আয়াতের মধ্যে (৩০:২২) নং আয়াতে এবং (৩৫:২৮) নং আয়াতে ‘আলিম/ওলামা’ কারা? তার সুস্পষ্ট পরিচয় রয়েছে।
এ নিদর্শনগুলো (৩০:২০, ১২, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ৩০:৪৮, ৩১:১০-ও অন্যান্য বহু আয়াতে বর্ণিত নিদর্শনসমূহ) নিয়ে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু গবেষণা পরিচালিত এবং প্রকাশিত হলেও উপমহাদেশে শত শত বছর ধরে প্রচলিত ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার কোনো ছোঁয়া বা নজির নেই। উল্লেখ্য যে, সেখানে বহু মুসলিম বিজ্ঞানী আছেন এবং তাদের মধ্যে ধর্ম পালন ও খোদাভীতিও বিদ্যমান। কিন্তু পৃথিবীতে আলিম হিসেবে তাদের স্বীকৃতি নেই। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শুধু ধর্ম নিয়েই বাহ্যিকভাবে আংশিক চর্চা হলেও সেখানে বিজ্ঞান/সৎকর্মের চর্চা পরিপূর্ণরূপেই অনুপস্থিত। বিজ্ঞানের এ জ্ঞানকে/আবিষ্কারকে কখনোই শুধুমাত্র দুনিয়াবী জ্ঞানের সাথে মিশ্রিত করে, তা ইহুদি-খ্রিস্টান বা পাশ্চাত্যের আমদানি করা জ্ঞানের সাথে তুলনা করা সমীচীন নয়। এ ধরনের চিন্তা করার অর্থই হলো অজ্ঞাতসারে নিজেদেরই হীনদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা। কুরআনের ভাষায়, ‘তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তাদ্বারা তারা উপলব্ধি করে না, চক্ষু আছে কিন্তু দেখে না, কর্ণ আছে কিন্তু শ্রবণ করে না। এরা পশুর ন্যায়, বরং তারা অধিক পথভ্রষ্ট। এরাই গাফিল।’ (৭:১৭৯)। অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান? (১৩:১৬)। দল দুটির (মুমিন এবং সৎকর্মশীলরা) উপমা অন্ধ ও বধিরের এবং চক্ষুষ্মান ও শ্রবণ শক্তি সম্পন্নের ন্যায়, তুলনায় এ দুই কি সমান? তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না? (১১:২৪)।
এখানেও প্রশ্নবোধক চিহ্ন (আওয়ালাম/কাআইয়েম) রয়েছে এবং জীবন-জগৎ ও বিজ্ঞান/সৎকর্ম সংক্রান্ত গবেষণা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নির্দেশনা জারী করা হলেও তা বর্তমান মুসলিম চিন্তাবিদদের নিকটে উপেক্ষিত। পঞ্চস্তম্ভ যুক্ত আয়াতসমূহে তেমন কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত না হলেও, তা অনুসরণে/পালনে জীবন-মরণ যে অস্থিরতা লক্ষ করা যায়, কুরআনে ঘোষিত মর্মস্পর্শীযুক্ত এ আয়াতসমূহে করা প্রশ্ন নিয়ে কোনো চিন্তাবিদ ধর্মতাত্ত্বিক/মুসলমানের হৃদয় অস্থির হয়ে ওঠে, আল্লাহর শত শত সৃষ্টি রহস্য নিয়ে জানার আগ্রহ বাড়ে (বিজ্ঞান), হৃদয়ে জাহান্নাম, আখিরাতের চিত্র (ধর্ম) ভেসে ওঠে, তা কখনোই অনুধাবন করা যায় না। ফলে এ গবেষণা কর্মের সাথে শিরক জড়িত হয়ে পড়ে। (১২:১০৬)। আল্লাহ প্রদত্ত অসংখ্য নিয়ামত নিয়ে কিয়ামতের দিন দুনিয়ার জীবনে করা এ প্রশ্ন সম্পর্কে মুমিনরা জিজ্ঞাসিত হলে (সূরা ইউনুস : ৮), সেদিন তার কোনো সদুত্তর দেওয়া সম্ভব হবে না। তাই আগেই সতর্কবাণী জানিয়ে দেওয়া হয়। গবেষণার জন্য এই হুকুম সর্বসাধারণের জন্য হলেও তা বিশেষভাবে জ্ঞানীদের জন্য। কারণ অন্যত্রে রয়েছে, কুরআন চিন্তাশীল-জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবীদের জন্য। মানুষের প্রতি করা কুরআনের এই যে, শত শত প্রশ্ন, তার সবগুলোর উত্তর/ফলাফল কিন্তু কুরআনে পাওয়া যায় না। গবেষণায় দেখা যায় যে, মক্কায় অবতীর্ণ প্রশ্নচিহ্নযুক্ত আয়াতের উত্তর তথা মানবিক মূল্যবোধ জাগরণ সম্পর্কিত প্রশ্নগুলোরই শুধু উত্তর/ফলাফল জানা যায়। যেমন- আরা-আইতাল্লাযি ইউকাযযিবুবিদ্দিন? (সূরা মাউন : ১)। অর্থাৎ তুমি কি দেখেছো তাকে, যে দীনকে (কর্মফল দিবস) অস্বীকার করে? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য বাকি ২ থকে ৭ নম্বর আয়াত দ্রষ্টব্য। যেখানে বলা হয়েছে- সে তো সেই যে, এতিমকে রূঢ়ভাবে তাড়িয়ে দেয় এবং অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদানে উৎসাহ দেয় না। সুতরাং দুর্ভোগ সেই সালাত আদায়কারীদের, যারা তাদের সালাত আদায় সম্বন্ধে উদাসীন (কুরআনের হুকুম অনুসরণ সম্বন্ধে উদাসীন), যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে এবং গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় ছোট-খাটো সাহায্য দানে বিরত থাকে।’ (১০৭:২-৭)। ‘অমা আদরাকা মাল আকাবাবহ? তুমি কি জান বন্ধুর গিরিপথ কি? তা হলো-দাসমুক্তি (দাসপ্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা), দুর্ভিক্ষে আহার্যদান, ইয়াতিম, আত্মীয়, দারিদ্র্য-নিষ্পেষিত নিঃস্বকে দান করা, মুমিন হয়ে পরস্পরকে ধৈর্যধারণ ও দয়া দাক্ষিণ্যের উপদেশ প্রদান-এরাই সৌভাগ্যবান। (৯০:১২-১৮)।
সৎকর্ম ও মানবতার কল্যাণ সম্পর্কিত অন্যান্য কুরআনের আয়াতেও এরূপ বহু প্রশ্নের উত্তর/ফলাফল পাওয়া যায়। কিন্তু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এ পথ অনুসৃত হয়নি। এটা যেন কুরআন নিয়ে মুসলিম গবেষকদের/পাঠকদেরই গুরুদায়িত্ব- এরূপ ইঙ্গিতই পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমান যুগের মুসলমানরা এক্ষেত্রে বহু পিছিয়ে, অন্যরা (অমুসলিম বিজ্ঞানীরা) যখন বহু দূর এগিয়ে। মানবিক মূল্যবোধ উন্নয়ন এবং বিকাশের ক্ষেত্রেও তাদের মধ্যে যে চর্চা পরিলক্ষিত হয়, বর্তমান মুসলিম সমাজও তা থেকে বহু দূর পিছিয়ে। আধুনিক যুগে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সকল নিদর্শন (দৃশ্য অদৃশ্য বস্তু) নিয়ে প্রচুর গবেষণা পরিচালিত হয়। কিন্তু এ গবেষণার সাথে ওহির কোনো সম্পর্ক না থাকায় তা শিরক মিশ্রিত হয়ে পড়ে। কুরআনের ভাষায় তা একটি অক্ষমাযোগ্য অপরাধ। (৪:৪৮)। তাই সাময়িক উপকারিতা প্রকাশ পেলেও আশানুরূপ ফল লাভ করা যায় না। বরং ক্ষতির-ই (দুর্নীতি) প্রভাব বেশি পরিলক্ষিত হয়। কুরআনেও তার সমর্থন পাওয়া যায়। ‘ঈমান গ্রহণ, সৎকর্মের ব্যাপক প্রসার-প্রচলন, পরস্পরকে সত্য এবং ধৈর্যের উপদেশ প্রদান করা ব্যক্তি ছাড়া আর সব মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত’। (আসর : ২-৩)। এটি কুরআন নাজিলের প্রথম দিকের একটি সূরা, মক্কী সূরা। প্রাথমিকভাবে ঈমান আনা এবং সৎকর্মের ব্যাপক অনুশীলনের মাধ্যমে সহনশীল পরিবার, সমাজ গঠনের কথাই এখানে বেশি প্রচারিত। একটি উত্তপ্ত পরিবেশ, কুস্বভাব, বিশৃঙ্খলা, স্বাধীনচেতা মনোভাব, নিত্যনৈমিত্তিক লুণ্ঠন, ডাকাতি, খুন/হত্যা ইত্যাদি দোষে দোষান্বিত আরব চরিত্র মুহূর্তের মধ্যে এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিশ্বজয়ী হওয়ার মতো চরিত্র গঠনে সক্ষম হয়। এ এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ঘটনাক্রমে কুরআনে নিদর্শন হিসেবে উল্লেখিত অধিকাংশ আয়াত/প্রাকৃতিক ঘটনাই বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত প্রকৃতির, যে কারণে এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, ইলম বা জ্ঞান অন্য কোনোভাবে বিশেষিত না হলে তা বিজ্ঞানেরই প্রতীক।
ইসলামের প্রথম যুগে মুসলমানগণ আল-কুরআন থেকেই জ্ঞান অর্জনের প্রেরণা লাভ করতেন। জ্ঞানকে তারা পূর্ণাঙ্গ অর্থেই নিতেন এবং মানবিক ও বিজ্ঞান বিষয়সমূহ তারা সমন্বিতভাবেই অধ্যয়ন করতেন। জ্ঞানানুসন্ধানের কারণেই মুসলমানরা ক্ষমতা ও সম্মান লাভে সক্ষম হয়েছিলেন, যা দ্বারা তাঁরা হাজার হাজার বছর ধরে বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করেন। এ গৌরব পরবর্তীকালে নষ্ট হয়ে যায় বেশ কয়েকটি কারণে। তার মধ্যে প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ কারণ সব জ্ঞানের আধার কুরআনকে ত্যাগ করে, ইসলামের আবশ্যিক বিষয়ে জ্ঞানার্জনকে (ধর্ম এবং বিজ্ঞানের পাশাপাশি অধ্যয়ন) শুধুমাত্র ফাযায়েল সিরিজ প্রবর্তন, ফিকাহী ফতোয়া, নাভীর ওপরে-নিচে হাত বাঁধা, বিয়ে-শাদী, সালাত-সিয়াম, তারাবী, জানাযা ও কিয়াম-কুরবানি মাসলার মধ্যে সীমিতকরণ প্রচেষ্টা। (চলবে)
লেখক: বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা), সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মাউশি, ঢাকা।