সংবাদ শিরোনামঃ

গণতন্ত্র না উন্নয়ন? ** দেশ থেকে মানবতা কি বিদায় নিচ্ছে? ** গণতন্ত্রহীনতায় জনমনে ক্ষোভ বাড়ছে ** মালয়েশিয়াগামী নিখোঁজদের জন্য আহাজারি ** প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমীকরণ ** ৩ মাসে ধর্ষণ ১২৩, গতিহীন তদন্ত ** গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধীদল থাকা বাধ্যতামূলক ** জীবন দিতে হচ্ছে বাংলাদেশীদের ** কবি নজরুলের ভুল! ** কমলগঞ্জে ধলাই নদীর তীরে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস ** ধানের দরপতনে ঋণের টাকা পরিশোধে দিশেহারা কৃষক ** নায়ক শেখ আবুল কাসেম মিঠুনের প্রস্থান **

ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২২, ১০ শাবান ১৪৩৬, ২৯ মে ২০১৫

শেখ আবুল কাসেম মিঠুনের কলম থেকে

আলো জ্বললে অন্ধকার পালাবেই

নায়ক শেখ আবুল কাসেম মিঠুনকে নিয়ে সোনার বাংলার বিশেষ আয়োজন

বাংলাদেশের মানুষ তুলনামূলকভাবে সৎ কিন্তু রাজনৈতিক চরিত্রহীনতা, অনৈতিক শিক্ষা এবং অশ্লীল সাংস্কৃতিক কার্যক্রম প্রচারে আজ অধিকাংশ মানুষ অসৎপ্রবণ হয়ে গেছে। একটা সময় ছিল গ্রামে-গঞ্জে সাধারণ মানুষ দরজা জানালা খোলা রেখেই রাতে ঘুমাত। চুরি-ডাকাতি হতো না তা নয়, থানায় যে মামলা হতো ৭১-এর পরে যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায় তা এখন বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কিন্তু ৭১-এর পূর্বে এই হার বেশ কম ছিল, সেই অপরাধপ্রবণতা হতদরিদ্র গরিবশ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। যখন কোনো অপরাধ ঘটত তখন গ্রামের মাওলানা-মৌলভীরা তার বিচার করতেন। সে বিচারের ফল গ্রামের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাও মেনে নিতেন, তা যদি নিজেদের সন্তান বা ভাইব্রাদারের বিপক্ষেও যেত।

স্বাধীনতালাভের পরে সেইসব মাওলানা-মৌলভীদের প্রভাব প্রতিপত্তি একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়। কে ধংস করেছিল, কিভাবে তারা ক্রমে ক্রমে নিশ্চিহ্ন হলেন বা তাদেরকে নিষ্ক্রিয় করা হলো তা গবেষণার বিষয়। হয়তো গবেষণা হবে, কবে তা জানি না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী সম্প্রতি ধর্মীয় নেতাদেরকে মূল্যায়ন করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তার গবেষণায় হয়তো প্রতীয়মান হয়েছে যে, সব সমাজেই ধর্মীয় নেতাদের একটা প্রভাব থাকেই। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করতেই হবে।

অথচ আমাদের দেশে যেদিন থেকে ধর্মীয় নেতাদেরকে উঁচু পর্যায় হতে অবমূল্যায়ন করা শুরু হয়েছে তারপর থেকেই পরিবারের অভিভাবক থেকে শুরু করে মর্যাদাবান মুরুব্বিশ্রেণী উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদেরকে নৈতিকতা শিক্ষা দেয়া দুঃখজনকভাবে পরিহার করতে আরম্ভ করেছেন। যে কারণে প্রজন্মের মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। বেশিরভাগ শিক্ষক এখন জ্ঞানার্জনের চেয়ে জীবনার্জনের প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করেছে। তারই কালোছায়া ভর করেছে অনিবার্যভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তারা এখন শিক্ষালাভ করে নিজের বিবেকবোধকে স্বার্থান্ধ করে তোলায়। মানুষের জন্য দেশের জন্য কিছু করার মানসিকতা তারা পরিত্যাগ করেছে। কোনো ত্যাগ নয়, মানুষ ও দেশের জন্য ত্যাগ করা যেন পাপ, এই অন্ধকারাচ্ছন্ন মন-মস্তিস্ক গঠনে তারা ব্যস্ত।

আজ সারাদেশে প্রায় সকল স্থানেই ‘দেশ দেশ’ একটা রব উঠেছে। কিন্তু দেশপ্রেম কোথায়! আসলে যে মানুষকে ভালোবাসে না সে কখনেই দেশপ্রেমিক হতে পারে না। তখন প্রেমের চিৎকারে তারাই মুখর হয় যাদের মধ্যে সত্যিকার প্রেমের সত্ত্বা থাকে না। যে প্রেমিক সে প্রেম প্রদর্শনে মুখর নয়। প্রেম থাকে তার কথায়, তার কাজে, তার সকল আচার-আচরণে। রাস্তায় কোনো মানুষ অমানবিক ঘটনার শিকার হলে অথবা কোনো মেয়েকে কেউ জোর করে তুলে নিতে চাইলে মানুষের মন উতলা হয় না, মানবিকতা যেন মুখ থুবড়ে থাকে।

মানুষ আজ নিষ্ঠুর হৃদয়হীন হয়ে গেছে। অশ্লীল সংস্কৃতি চর্চায় মানুষ স্বার্থান্ধ হবেই, নিষ্ঠুরও। তাদের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ে। তারা যেন আর ঘরে থাকতে চায় না, বাইরেও বেশিক্ষণ মন বসে না। তাদের মন আর মনের মধ্যে থাকে না। অস্থির হয়ে বিভিন্ন অনৈতিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তারা হরদম কি যেন খুঁজে বেড়ায় তা নিজেরাও জানে না। এর পরিণাম বা ফলাফল কি! আমরা কথায় বলি, যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। কিন্তু যখন আশটুকুও শেষ হয়ে যায় তখন তা ফেলে নতুন জিনিস ক্রয়ে কেউ বিলম্ব করে না। তেমনি আমাদের সমাজের অবস্থা। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। আজ আশটুকু অর্থাৎ বাঙালির মৌল সত্ত্বা অর্থাৎ যুবশ্রেণী এবং নৈতিকতা সম্পন্ন বৌদ্ধিকশ্রেণীর আশটুকুও শেষের পথে। হয়ত নতুন করে একটা সমাজ ক্রয়ের দিন নিকটেই। সময়ের অনিবার্য রূপান্তর আসতেই হবে। একটা সভ্য সমাজ গড়ে তুলবে সে সেই সময় নামক নৈতিকতা সম্পন্ন যুবশ্রেণী এবং বৌদ্ধিকশ্রেণী। তার সংখ্যা যত অল্পই হোক। কারণ অন্ধকার তো ঝাঁকে ঝাঁকে আসে। চাপচাপ অন্ধকার আসে। ছোট্ট একটা লাইট-ই বিপুল বিক্রমে সেই চাপচাপ অন্ধকারকে দূর করে দেয়। অন্ধকার কখনোই সেই লাইটকে, সেই আলোকে ধ্বংস করতে পারে না। আলো জ্বললে সে পালাবেই।

মানুষ যখন ইন্দ্রিয়ের খোরাক পায় তার আত্মা তখন জ্ঞানের দরজা বন্ধ করে দেয়

 

সমাজে অশিক্ষিতশ্রেণী শিক্ষালাভ ব্যতিরেকে আনন্দলাভে নিজেকে মশগুল রাখতে পারে। তারা আনন্দকে ভোগ করে, আনন্দ উপভোগের মানসিক ক্ষমতা তাদের থাকে না। কিন্তু যারা শিক্ষালাভে ব্যস্ত তারা তার মধ্যেই যে চিত্ত বিনোদন খুঁজে পায়, সেটা এইভাবে বলা যেতে পারে যে, শিক্ষিতরা আনন্দকে ভোগ নয় উপভোগ করার ক্ষমতা রাখেন। শিক্ষালাভের মধ্যে যে আনন্দ খুঁজে পায় না, সে হয়ত বড়বড় ডিগ্রি অর্জন করতে পারে কিন্তু আসলে সে শিক্ষিত হয় না। আমি এমন অনেক ডিগ্রিওয়ালা দেখেছি যে একলাইন ইংরেজি লিখতে বেশ কয়েকটা বানান ভুল করে। এমনকি বাংলা লিখতেও বানান ভুল করে। এমন বহু শিক্ষিত ব্যক্তি দেখেছি যে, তাদের শিক্ষা আছে কিন্তু জ্ঞান-বোধ নাই। একজন অশিক্ষিত কুলি বা দিনমজুরের যে মানসিক স্তর সেই একই স্তরের জ্ঞান দেখা যায় উচ্চ শিক্ষিত অনেক ডক্টরেটধারী ব্যক্তির মধ্যে।

শিক্ষিত জ্ঞানী লোকদেরকে চেনা যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। কোন্ কোন্ আইটেম তারা কিভাবে উপভোগ করছে, তাদের ফেসিয়াল রি-অ্যাকশান দেখলে বোঝা যায়, তার শিক্ষা ও জ্ঞান তার রুচিবোধকে কিভাবে পরিচালিত করছে। তার আবেগকে কিভাবে তাড়িত করছে। শরীরের অভ্যন্তরে অবস্থিত নিউক্লিয়াস কি ধরনের আনন্দলাভে কেমিকেল রি-অ্যাকশন করে তার শিরা-উপশিরাকে উত্তেজিত ও কার্যক্ষম করে তুলছে।

বিশেষ করে আমার রচিত চলচ্চিত্রগুলি আমি দর্শকদের সাথে বসে যখন দেখেছি, তখন হয়তো একটা দৃশ্য বা সংলাপ শুনে বিভিন্ন দর্শকের বিভিন্ন রি-অ্যাকশান দেখেছি। আমি সেই সব দর্শকদের মনস্তাত্ত্বিকতা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। এ বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করে পরবর্তী চলচ্চিত্রে পরিবর্তন এনেছি। একই দৃশ্য কিন্তু ভিন্ন আঙ্গিকের উপস্থাপন এবং সংলাপ পরিবেশন করেছি। তখন দেখেছি দর্শকদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রি-অ্যাকশান।

শিক্ষিত দর্শক মানে দামী জামা-কাপড় পরা দর্শক নয়, প্রকৃতই শিক্ষিত (জ্ঞান অন্বেষণকারী), আর অশিক্ষিত দর্শক মানে গরিব তৃতীয়শ্রেণীতে বসা দর্শক নয়, প্রকৃতই অশিক্ষিত (যারা জ্ঞানার্জনকে ফালতু কাজ মনে করে), এই যে বিষয়গুলো এ সম্পর্কে পেশার তাগিদে আমাকে পুরো চলচ্চিত্র জীবনেই গবেষণা করতে হয়েছে। প্রতিদিনই দর্শকদের সাথে আমি মনস্তাত্ত্বিক লেনদেন করেছি। যে কারণে আমার রচিত চলচ্চিত্রগুলো বেশিরভাগই সফল হয়েছে। কোন শ্রেণীর দর্শক কি ধরনের বিনোদন চায়, তাদের রুচি, আবেগ ও মননশীলতা কোন খাতে প্রবাহিত হচ্ছে তা ছিল আমার কাছে স্পষ্ট।

১৯৯০ সাল পর্যন্ত আমরা নির্ভেজাল সামাজিক চলচ্চিত্র, কিছু সামাজিক অ্যাকশন, কিছু ফোক ও কিছু পোশাকি চলচ্চিত্র করেছি। যেসব চলচ্চিত্র পরিবারের সবাই একসঙ্গে দেখতে পারত। এরপর দর্শকের মানসিকতার পরিবর্তন এসেছে। তখন আমরা বিশেষ বিশেষ শ্রেণীকে সামনে রেখে চলচ্চিত্রের কাহিনী সাজিয়েছি। পরিবর্তনটা এসেছে ১৯৯৬-এর পর থেকে। আজ পর্যন্ত তাই চলছে। পরিবর্তনটা কেন হয়েছে, তার ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু এখানে সে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই। শুধু এইটুকু ইঙ্গিত যথেষ্ট যে, রাজনৈতিকভাবে অর্থনীতি ও কর্মবণ্টন এবং যোগ্যতাকে বাদ দিয়ে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে জনগণকে পরিচালনার জন্য যে পদক্ষেপ, সেটাই দর্শকদের মানসিক পরিবর্তনে সহায়ক হয়েছে। আর এসব বিষয়গুলো আত্মিক সাধনাকে এড়িয়ে বস্তুবাদের দিকে মানুষের ঝোঁক বাড়ায়।

যাই হোক আপনি কারো খাদ্য, পোশাক চলাফেরা পছন্দ অপছন্দ এর মধ্যে তার রুচিবোধ যাচাই করতে পারবেন। কিন্তু সবচেয়ে সহজে পারবেন তার অবসর সময়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কি কি উপকরণ এবং উপাদান দেখে সে তৃপ্তি পাচ্ছে তা দেখে। সিনেমা দেখার অবসর হলো অফিস থেকে বাসায় ফিরে যে অবসর সেই অবসরে সে কি ধরনের চিত্তবিনোদন করছে। অবসরে সে কি ধরনের বই পড়ছে। ফেইসবুকে কি বিষয়ে সে লাইক দিচ্ছে। বন্ধুত্ব বজায় রাখার জন্য না সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য! তাদের চিন্তাধারার উপর পেশাগত একটা প্রভাব বিস্তার করে, আর পেশার উপর প্রভাব বিস্তার করে রাজনীতি। সব মিলিয়ে মানুষটির আনন্দ কিসে লুকিয়ে আছে এবং একজন মানুষের রুচি আবেগ এবং তার চিন্তা ও মননশীলতা আপনি বিচার করতে পারবেন।

যে আনন্দের মধ্যে শিক্ষা নেই তা মানুষকে শিক্ষালাভের যে মানসিকতা তা থেকে বিমুখ করে। আর যে আনন্দের মধ্যে শিক্ষা আছে তা মানুষকে শিক্ষামুখী করে তোলে। জ্ঞান অপহরণের তৃষ্ণা তৈরি করে।

যে আনন্দ শুধু ইন্দ্রিয়ের খোরাক দেয় আত্মাকে অংশীদার করে না, সে আনন্দই অশ্লীল আনন্দ। আর যে আনন্দ আত্মার খোরাক দেয় সঙ্গে সঙ্গে ইন্দ্রিয়কে আত্মার দাস করে তোলায় ভূমিকা রাখে সেই আনন্দই যথার্থ আনন্দ। সেটাই কল্যাণময় সংস্কৃতি। হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ শ্রী গীতায় একটা শ্লোক আছে, যার অর্থ : ‘মানুষ যখন ইন্দ্রিয়ের খোরাক পায় তার আত্মা তখন জ্ঞানের দরজা বন্ধ করে দেয়।’ (রেডিও তেহরান, বাংলা বিভাগের ওয়েব সাইডে আবুল কাসেম মিঠুনের এ লেখা দুটি প্রকাশিত হয়)

আত্ম-সমালোচনা

আত্ম-সমালোচনা সংস্কৃতিবান হওয়ার অন্যতম শর্ত। প্রত্যেকটা মানুষের নিজের মধ্যে অনেক ত্রুটি থাকে। প্রত্যেক মানুষ নৈমিত্তিক কাজের মধ্যে অসংখ্যা ভুলও করে থাকে। বিশেষ করে যে সমস্ত দোষ-ত্রুটিকে আমরা মানবীয় দোষ-ত্রুটি বলি, যেমন : অহঙ্কার, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ, পরশ্রীকাতরতা, প্রতিহিংসা, পরনিন্দা,  মিথ্যা বলা, সুবিচার না করা, অন্যের উপর প্রভুত্ব করার প্রবণতা, অভিযোগী হওয়া, ক্রোধ, গীবত করা, অন্যের উপর মিথ্যা অপবাদ চাপানো, অন্যকে ছোট করে দেখা, ইত্যাদি। এ সমস্ত দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত হয়ে পর্যায়ক্রমে নিজকে বদলে উন্নততর সাংস্কৃতিবান মানুষ হওয়ার দিকে এগিয়ে যাওয়া সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষের কর্ম। এই সব দোষ-ত্রুটিকে প্রশ্রয় দিলে এক সময় মন আর এই সব দোষ-ত্রুটিকে দোষ-ত্রুটি হিসেবে না দেখে গুন হিসেবে দেখে থাকে। মহানবী (সা.)-এর একটা হাদিস আছে যার অর্থ এইরকম: ‘প্রথমবার অন্যায় করলে যে কোন মানুষের মনে অনুশোচনা হয়। কিন্তু সে যদি তওবা করে তবে তার যন্ত্রণা চলে যায় এবং আত্মার উপর থেকে অন্যায়ের কালিমাও মুছে যায়। কিন্তু সে যদি তওবা না করে এবং আবার অন্যায়টি করে তবে প্রথমবারের মতো ততটা যন্ত্রণা হয় না। তৃতীয়বার যখন সে অন্যায়টি করে তখন সেটিকে আর তার কাছে অন্যায় মনে হয়না বরং ন্যায়ই মনে হয়।”

ন্যায়ের বিপরীত কাজকে আমরা অন্যায় বলে থাকি। একব্যক্তির একটা বিষয়ে ন্যায় কাজ করা উচিত ছিল কিন্তু সে করেনি, এটা তখন অন্যায় হয়ে গেল। আবার কোনো ব্যক্তি অন্যের গাছের একটা ডাল বা শাখা তাকে না জানিয়ে কেটে নিল, সেটাও অন্যায় হয়ে গেল। এটা যে দেখলো সে কিছুই বললো না, তার পক্ষেও কাজটা অন্যায় হলো। অন্যায় কাজগুলো এমন যে তাতে অন্যায়ের শিকার ব্যক্তিটির অপূরণীয় ক্ষতি হয় না এবং তার ক্রিয়া ব্যক্তি পর্যায়ে পরিলক্ষিত হয়। অতএব যে অন্যায় করলো তাকে আমরা অপরাধী বলতে পারি না। সে অন্যায়কারী। এর সংশোধন সম্ভব। মহান আল্লাহ বলেছেন,‘ তোমরা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করো এবং অন্যায়ের প্রতিরোধ করো।’ স্বাধীনতা লাভের পূর্বে আমাদের সমাজেই অন্যায়ের প্রতিরোধ করতেন সমাজের মুরুব্বিশ্রেণী এবং কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া যুব শ্রেণী। তখন বেশিরভাগ গ্রামে লোকজন রাতে দরজা বন্ধ না করেই ঘুমাতো, কারণ চোরের ভয় ছিল না। প্রায় গ্রামেই দেখা যেতো সেখানকার অধিবাসীরা কখনই পছন্দ করতেন না যে তাদের গ্রামে পুলিশ প্রবেশ করুক। পুলিশ এলে তাদের সম্মানে বাধতো। নিজেদের কাছেই তারা ছোট হয়ে যেতেন। তাই তারা গ্রামের মানুষকে অন্যায়মুক্ত রাখার সকল প্রকার চেষ্টা করতেন। বিশেষ করে ধর্মীয় অনুষ্ঠান বেশি বেশি করতেন।  কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পরই অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সমাজ থেকে এই কাজটি উধাও হয়ে যায়।  ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও ধর্মীয় বিধানের পরিবর্তে বক্তারা বুজুর্গ ও মহাপুরুষদের অলৌকিক কাহিনী বেশি বর্ণনা করা শুরু করেন। যা আজো বর্তমান। তাতে সাধারণ মানুষ কোনো পথ-নির্দেশনা পায়না। বরং বক্তারা বুজুর্গ ব্যক্তিদের প্রতি মানুষের মনকে পূজা করার দিকে বেশি ধাবিত করান। এইভাবে অন্যায়ের প্রতিরোধ এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা উঠে যাওয়ার কারণে আজ আমাদের সমাজ অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়েছে। প্রতিটি মানব সমাজ চরম অরাজকতার শিকার হয় যদি তারা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা না করে এবং অন্যায়ের প্রতিরোধ না করে। অন্যায় হচ্ছে অপরাধের ভিত্তি। অন্যায়কারী পর্যায়ক্রমে অপরাধী হয়ে ওঠে।  অন্যায়কারী বাধাগ্রস্ত না হলে সে অন্তরে অন্যায়কে লালন করতে অভ্যস্ত হয় এবং পরিণতিতে অপরাধী হয়ে ওঠে। অপরাধের শিকার এক বা একাধিক ব্যক্তি হতে পারে, এবং সেখানে অপূরণীয় ক্ষতি হয়। যেমন এক ব্যক্তি দুই হাজার টাকা ঘুষ খেয়ে একজনের একটি কাজ করে দিল। আপাতঃ দৃষ্টিতে কাজটির সঙ্গে দু’জন ব্যক্তি জড়িত থাকলেও পরোক্ষভাবে সমাজ এবং পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রটিই এর ক্ষতির শিকার হয়ে ওঠে। তাই এটা অপরাধ হিসেবে গণ্য। পূর্বের উদাহরণ টেনে বলা যায় লোকটি একটি গাছের শাখা বা ডাল শুধু নয় পুরো গাছটিই তার মালিককে না জানিয়ে কেটে ফেললো। তখন বিষয়টি অন্যায়ের সীমা ছাড়িয়ে অপরাধের সীমায় প্রবেশ করে। আমারা অপরাধকে দুইভাবে দেখতে পারি। একটা হলো : পরিস্থিতির শিকারজনিত অপরাধ। দ্বিতীয়টা হলো : স্বভাব অপরাধী।

পরিস্থিতির শিকার :  পরিস্থিতি বাধ্য করে অপরাধ করতে। ব্যক্তিটি কখনোই সেই ধরনের অপরাধের চিন্তাও করেনি। এবং সঙ্গে সঙ্গেই তিনি অনুতপ্ত হন প্রতিজ্ঞা করেন আর সেই ধরনের অপরাধ না করার। আর সত্যিকারভাবে তিনি আর সেই ধরনের অপরাধ করেন না। এই ব্যক্তিরাই আত্মসমালোচনা করেন বলে অপরাধ কারার চিন্তা করেন না এবং পরিস্থিতি বাধ্য করলে সাথে সাথেই অনুশোচনার তীর তাকে বিদ্ধ করে। তিনি আল্লাহর কাছে তওবা করেন, কান্না-কাটি করেন। এই ধরনের লোকদের কারণেই সমাজের শৃঙ্খলা ও শান্তি রক্ষিত হয়।

স্বভাব অপরাধী : একজন মানুষ হঠাৎ করে অপরাধ করতে পারে না। কারণ যে কোনো কাজ করতে গেলে হাত, পা এবং শরীরের অন্যন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দিতে হয়। এই শক্তি তৈরি হয় শরীরের ভিতর থেকে। ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন করার সময়ে শরীরের অভ্যন্তরে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে। এই রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে দুইভাবে। একটা হচ্ছে শক্তির যোগান দেয়া এবং আর একটি হচ্ছে শক্তির যোগান না দেয়। মানুষ যদি আত্মসমালোচনা না করে এবং অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় তবে আত্মার মধ্যে অন্যায় লালিত হতে থাকে। শরীরের অভ্যন্তরে রাসায়নিক বিক্রিয়া তখন থেকেই তার কাজ শুরু করে দেয় এবং তার হাত, পা এবং অন্যান্য অঙ্গগুলোকে প্রস্তুত করতে থাকে। এইভাবে সে অপরাধী হয়ে ওঠে। অপরাধের প্রকাশ বিভিন্নভাবে ঘটতে পারে। শারিরিকভাবে অপরাধে লিপ্ত হতে পারে আবার বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেও লিপ্ত হতে পারে। আসলে যারা পরিণাম চিন্তা করে না তারাই মূর্খ। হতে পারে তারা বাহ্যিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষিত। এরা আসলে অপরাধী মস্তিস্কজাত। পরিণাম বলতে ‘জবাবদিহিতা’। মৃত্যুর পরে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার ভয়ই যে বুদ্ধিকে শাণিত করে তাই-ই জ্ঞান। আত্মসমালোচনার ফল স্বরূপ যে তওবা তাই হচ্ছে রুহুর অন্যতম খোরাক।

সাধারণতঃ আজ সমাজের অনেক অন্যায় কাজ ও কথাকে আমাদের কাছে ন্যায়ই মনে হয়।  কিন্তু যারা রুহুর খোরাক দান করেন বা যিনি অল্লাহর  একান্ত বাধ্য বা বাধ্য থাকার নিরন্তর চেষ্টা সাধনা করে থাকেন তার কাছেই ন্যায়-অন্যায় যথার্থরূপে ধরা পড়ে। আর তাই সকল দেশে সকল সমাজে সেই সব লোকদের একটা পৃথক মর্যাদা আছে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের সমাজ থেকে সেটা উঠে যাচ্ছে। যে সমাজ এইরকম সে সমাজ বেশিদিন টেকে না। সোভিয়েট রাশিয়া এবং তার অনুসারী দেশগুলোর  সমাজ-ব্যবস্থা ৭০ বছরের বেশি টেকেনি। অথচ আমাদের অনেকেই সেই সময়ের সোভিয়েট রাশিয়াকে অনুসরণ করছে।

প্রত্যেক ব্যক্তিকে ভালোর সাধনা করা দরকার, নিজেকে বদলাবার চেষ্টা করা উচিত। আর এই বদলটা পৃথিবীর কোনো শক্তিই করে দিতে পারে না। এ বদলটা নিজের মধ্যে নিজেই করতে হয়। আর তার উপায় হচ্ছে, সারা দিনের কাজ শেষে কিছুটা বিশ্রাম শেষে গভীর রাতে অন্তত: আধাঘণ্টা একা হয়ে যাওয়া। পর্যায়ক্রমে এই সময়সীমা বাড়াতে হবে। অদৃশ্য স্রষ্টার সামনে হিসাব দিতে হবে। সারাদিনের সমস্ত কাজের হিসাব। দোষ-ত্রুটি যুক্ত কাজগুলো আর করবো না বলে প্রতিজ্ঞা করা। বারবার প্রতিজ্ঞা করা। অনুতপ্ত হওয়া। যাকে মহান আল্লাহ তাহাজ্জুদ-এর সালাত হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এই সালাতে নিজের রূহুকে আল্লাহর কাছে সকল ভালো কাজের জন্য দোয়া করতে শিখানো। কারণ দোয়া স্রষ্টার কাছে আত্মার অহঙ্কারের বীজ ধ্বংস করে দেয়। আর অহঙ্কার হচ্ছে সকল দোষের জননী। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘জুতার ফিতা বাঁধার সময়ও আল্লাহর কাছে দোয়া করো।’  অবশ্যই অল্লাহর অপছন্দনীয় কাজগুলোকে ঘৃণা করতে অভ্যস্ত হতে হবে। যদি প্রতিজ্ঞা কোনো কারণে ভঙ্গ হয়ে যায় সুবিধামত কাফফরা হিসেবে তিনদিন রোজা পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটা বিষয়ে আলোকপাত করাটা সঙ্গত যে,  ‘পঞ্চ ইন্দ্রিয় তাদের ইচ্ছামাফিক খোরাক পেলে আত্মা তখন জ্ঞানের দরজা বন্ধ করে দেয।’  অতএব নফসকে সংযত রাখতে পারলেই প্রতিজ্ঞা করা এবং রক্ষা করা দুটোই সম্ভব হয়ে ওঠে।

পরদিন সকালবেলা থেকে ঐসব দোষ-ত্রুটি মুক্ত একজন নতুন সাংস্কৃতিবান, প্রেমময় এবং উন্নত আধুনিক মনের মানুষ হিসেবে কাজ শুরু করতে গিয়ে নিজের কাছে নিজেকে ভীষণ ভালোলাগবে। তখনই ব্যক্তিটি এমন আত্মতৃপ্তি ও আত্মিক আনন্দ পাবে যা কোটি কোটি টাকা দিয়েও কোথাও কিনতে পাওয়া যায় না। তার সংস্পর্শে যারা আসবে তারাও আনন্দিত হতে বাধ্য। তিনি অন্যের উপর তার সকল ভালোর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হবেন। এই ধরনের কিছু সংখ্যক মানুষ সংঘবদ্ধ হলেই একটা উন্নত পরিবেশ গড়ে ওঠে। আর সংখ্যা বাড়াতে পারলে একটা উন্নত আদর্শবান সমাজ গড়ে ওঠে। উন্নত সমাজ ব্যবস্থা থেকেই তো উন্নত এবং সভ্য রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠে ও তার বিকাশ হতে থাকে। স্বৈরাচারী ঘৃণিত শাসকরা যে অন্যায়ের প্রচলন ঘটিয়ে সমাজকে কলুষিত করে সেই সমাজের ভিতর থেকেই প্রকৃত আল্লাহর খাঁটি বান্দাদের একটি দল যখন সকল রোগের প্রতিষেধক হিসেবে আবির্ভূত হয় তখন স্বৈরাচার নামক মরণ ব্যাধির মৃত্যু ঘটে।

মনে রাখা দরকার, দশ হাজার বছর আগেও খাদ্যের জন্য, বাসস্থানের জন্য মানুষ সংগ্রাম করেছে। আজো করছে। এই ধারাবাহিক সংগ্রামের নাম উন্নয়ন। মানুষ এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বৈষয়িক সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটিয়েছে। এই উন্নয়ন ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় চলতেই থাকবে। এই উন্নয়নের জন্য বিশেষ কোনো গোষ্ঠী বা বিশেষ কোনো সংগঠনের অবদান স্বীকৃত নয়, এই উন্নয়ন সম্মিলিতভাবে মানবগোষ্ঠীই করে থাকে। এই উন্নয়নকে যারা সভ্যতা বলতে চান তারা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখেন না, মানুষকে দাস অথবা পশুশ্রেণীর ঊর্ধ্বে ভাবতে পারেন না। কারণ খাদ্য বাসস্থান দিয়েই মানুষ পশুকে বা দাসকে বশিভূত করে রাখে। আসলে মানুষকে তারা দাসের মতো বশিভূত করে রাখতে চান। আর এটাই স্বৈরাচারীদের মুখ্য উদ্দেশ্য।

মানুষ চায় সভ্য হতে। সভ্যতা তার সাধনা। সভ্যতাই তার স্বাধীন সত্ত্বার বিকাশ ঘটায়। তার সৃজনশীলতার স্ফূরণ ঘটায়। তাই সে উন্নয়নের সাগরে ভেসেও সংগ্রাম করে। সে সংগ্রাম করে মানুষের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য। তাই তার প্রয়োজন সবকিছুর আগে মানুষের পরিচয়। সেই পরিচয়ের জন্য দরকার নৈতিক চর্চা। যেসব মানবীয় গুণের কথা প্রথমে উল্লেখ করেছি সেই সব গুণ মানুষের সহজাত কাম্য। সেই ক্ষেত্রটা মানুষ যখন তৈরি করে তখন রাষ্ট্রকে তার সহযোগী হতে হয়। রাষ্ট্র যদি সেই সব গুণকে দোষ হিসেবে এবং দোষকে গুণের মর্যাদা দেয় তবে  ধংসের হাতছানি দেখে আত্মসমালোচনাকারীদের ভয় পাওয়া উচিত নয়। রোগ যত কঠিন হোক না কেন সঠিক অসুধ সেই রোগকে দূর করবেই। মহানবী (সা.)-এর সময় মক্কার কুরাইশরা তাকেই বীর এবং সাহসী খেতাব দিতো যারা সফলতার সাথে মরুভূমিতে যাতায়াতরত ব্যবসায়ী কাফেলা লুট করতে পারতো। তাকেই আত্ম-মর্যাদাশীল বলতো যে ব্যক্তি তার কন্যাকে জীবিত কবর দিতে পারতো। আর সেই ব্যক্তিই তাদের কাছে ছিল অপরাধী যিনি সেই ধংস থেকে তাদেরকে উদ্ধার করার জন্য আল্লাহর শান্তি প্রদানকারী অসুধ প্রয়োগ করতে এলেন। তাই ঝড়ের তাণ্ডবে দিশেহারা সেই হবে যে আত্মসমালোচনা করে না। কিন্তু আত্মসমালোচনাকারী মোটেই দিশেহারা হবে না। কারণ তার রুহ একটি তওবাকারী অনুশোচনাকারী আল্লাহর প্রিয় রুহ।  (সূত্র : ফেসবুক স্ট্যাটাস)

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।