সাহিত্যে নৈতিকতা


২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:০০

॥ মনসুর আহমদ ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
জীবনের সকল বিচিত্রতার রসানুভূতিকে আধ্যাত্ম রসবোধের স্রোতে বিলীন করে দিতে এগিয়ে এলেন পশ্চিমা সাহিত্যে ওয়াল্ট হুইটম্যান, রবার্ট ব্রাউনিং, এডওয়ার্ড কার্পেন্টার, উইলিয়ম ব্লেক প্রমুখ। ব্রাউনিং-এর ধর্ম কাব্যে Feristah’s Fanies ওয়াল্টের Sands at seventy এডওয়ার্ডের Towards Democracy টম্পসনের The Hound of Heaven প্রভৃতি কাব্যে রসবোধের বিকাশ ঘটেছে। এভাবেই সার্থক কবি সাহিত্যিকেরা সমাজের সকল ভাব উৎস থেকে খাদ্য গ্রহণ করে পুষ্টি লাভ করেন এবং তাদের সব অভিব্যক্তির মধ্যে অনির্বচনীয় অবন্দন রূপকে প্রকাশ করে কাব্য রসজ্ঞ ব্যক্তিদের আনন্দ যোগান।
শিল্প সাহিত্যের আলোচনায় দেখা যায় অনেক ধর্মানুরাগীরা জীবনের বিচিত্র রাগ, সৌন্দর্যবোধের রাগ, কল্পনার রাগ, ভাবের রাগ ইত্যাদির মধ্যে কোনো সার্থকতা খুঁজে পান না।
ইসলামের নীতবোধ মানবজীবনের রাগ ও রসকে শুধু স্বীকৃতি প্রদান করে না বরং মানব মনে যে, প্রবৃত্তির ঝড় জাগ্রত হয় তাকে শান্ত করে ভোগের পঙ্কে রাগ ও রসযুক্ত পবিত্র পঙ্কজ ফোটাতে- উৎসাহ যোগায়।
ইসলাম মানবের নৈতিক জীবনে ও প্রকৃতির জগতে একই সঙ্গীত সুর শোনাবার আহ্বান জানায়। যেমন এরশাদ হচ্ছে -‘রিজকান লিল ইবাদে ওয়া আতাইনা বিহী বালদাতাম মাইতান, কাজালিকাল খুরুজ। বান্দাদের জীবিকা স্বরূপ এবং বৃষ্টি দ্বারা অমি মৃত জনপদকে সঞ্জীবিত করি।’ (সূরা কাফ)। তেমনি চিৎ প্রবৃত্তির দাবি স্বীকার করে নিয়ে তাকে সুন্দর ও উপভোগ্য করার পরামর্শ প্রদান করে ইসলাম।
জীবনের রাগ ও রসকে শোষণ করে জীবনে যখন নৈতকতার ফুল ফুটবে, গন্ধ ছুটবে তখনই হবে কবি জীবনের সার্থকতা । তাই রাগ ও বৈরাগ্য, দুর্নীতি নীতির সান্ত্বনা সুধা ও সৌন্দর্যের খবর যারা পায়নি, অন্তরে পালিত ত্যাগ ও ভোগের নীতিবোধের সংস্পর্শে যারা আসেনি তারাই ধর্মকে জীবনের আনন্দ ও সৌন্দর্য ভোগের অন্তরায় মনে করেন। তারা জীবনে প্রতিটি কাজের চালিকাশক্তি হিসেবে ধর্মকে গ্রহণ করতে পারেননি। আজ যদি নিগূঢ় গুহায় আগত ঐশী আলোয় সাহিত্য-শিল্পকে ক্রমাগত ভেতরের দিক থেকে আলোকিত করা যায়- তবেই সাহিত্যের উন্মুক্ত মাঠের অনৈতিকতার মত্ত অশ্বশক্তি, মানবসন্তানকে নিয়ে ছুটবে আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতায় পূর্ণ জীবন সরোবর তীরে।
ওয়াল্টার পেটার বলেছেন যে, আর্ট ও কবিতর আস্বাদন অলোচনার মাধ্যেমে করা সম্ভব নয়। টমাস এ কেম্পিয়াসের ‘খ্রিষ্টের অনুকরণ’ গ্রন্থে সকল বাহ্য সৌন্দর্যকে ভক্তি সাদরে অন্তরায়বরে কল্পনা করেছেন। এভাবেই অনেকেই ধর্ম ও নৈতিকতাবোধকে সাহিত্যের বিরোধী মনে করেন। মনে করার যথেষ্ট কারণও আছে। কারণ তারা পরিচিত এমন ধর্মের সাথে যার অধিকাংশই নিবৃত্তির পথে বেশি চলে। জ্ঞানে-কর্মে ভোগে প্রকৃতির স্বাভাবিক চাহিদাকে অস্বীকার করে বিধায় ওগুলোকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না। এ ব্যাপারে ‘ইসলাম’ মানষের প্রকৃতি (ফিৎরত)কে স্বীকার করে নিয়ে নৈতিকার সুষমামণ্ডিত কলির আবরণে নিয়ন্ত্রণ করে, ধীর ধীরে মঙ্গলময় রূপ নিয়ে বুকে- পবিত্র খোশবুর হিল্লোলে ওগুলোকে প্রস্ফুটিত করতে সহায়তা করে। তাই সাহিত্যকে বাস্তবতার নামে অলঙ্কার বাদ দিয়ে আবরণ মোচন করা, নৈতিকার শুভ্র আচ্ছাদন ত্যাগ করে উলঙ্গ কলামূর্তি নয়, ধর্মীয় চেতনাবোধে মানবজীবনের রাগ ও সৌন্দকে পাতিত করে তার বিশুদ্ধ রূপটি নিয়ে সাহিত্য গড়ে তুললেই মানুষ সেদিকে ছুটে চলবে, চরিত্র সুন্দর হবে ও অন্তরাত্মা তৃপ্তি পাবে।
রবীন্দ্রনাথ তার পরিণত জীবনের সাহিত্যে সৌন্দর্যকে রুচির সাথে এক করে দেখেছেন, কীটস দেখেছেন সত্যের সাথে অভিন্নভাবে, বলেছেন-Truth is beauty, beauty is truth.
সৌন্দর্যের অন্যতম লক্ষণ আনন্দ এটা ধরে নিয়ে আনন্দবাদীরা শিল্পের একটা পরিচয় খুঁজছে- আনন্দের মধ্যে। আবার হেগেল Absolute বা চূড়ান্তের মধ্যে সৌন্দর্যের সাক্ষাত পেয়ে বলেছেন, শিল্প হচ্ছে এই চূড়ান্তেরই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিকাশ। কুমার স্বমীর নন্দন তত্ত্বের একটি পরিচয় ছিল বিশুদ্ধ চৈতন্যের সাধনা। তিনি তাঁর The mirror of Gesture বইতে লিখেছেন, ‘নন্দন তাত্ত্বিক অনুনুভূতির প্রকৃত পরিচয় হচ্ছে ব্রহ্মসাধনা ( আধ্যাত্মিক মিলনের ) তুল্য এক ধরনের কালহীন বিমল আনন্দ।’
আল্লামা ইকবালের কবিতায় কাব্য সৌন্দর্য যতটা ফুটে উঠেছে তার চেয়ে অধিকতর ফুটে উঠছে নৈতিকা ও সর্বজনীন আদর্শবোধের বৈচিত্র্যময় ছবি। তিনি তাঁর কাব্যে ধর্মীয় ও নৈতিক গুণাবলির দিকে বিশেষ নজর দিয়ে লিখেছেন-
নাহ বিনি খায়রে আজাঁ র্মদে ফরুদস্ত,
কেহ বরমান তোহমাতে শায়রু সোখন বস্ত।
অর্থাৎ তুমি দেখতে পাবে না মঙ্গলজনক কিছু ঐ অজ্ঞ লোকের কথায় যে আমার ওপর কবি হওয়ার অপবাদ করে।
শিল্প সাধকে ও আধ্যাত্মিক সাধকে অনেক প্রভেদ । শিল্প সাধকের কাছে তার বিশেষ রূপটাই বড়, বিশ্ব যেন তাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে, সে বিশ্বের জন্য নয়। কিন্তু আধ্যাত্মিক সাধক বিশ্বের জন্য, বিশ্ব তার জন্য নয়। এ কারণেই রূপের সাধনা ও আধ্যাত্ম সাধনায় এত প্রভেদ। এ প্রভেদ সব কালে ছিল। মধ্যযুগে ইউরোপে, বৌদ্ধযুগে ভারতবর্ষে, চীনে, জাপানে যেখান শিল্প ধর্মের সেবা করেছে সেখানে শিল্প সাধনা ও আধ্যাত্ম সাধনা এক হয়ে যায় নাই। তবে মধ্যযুগ ও আধুনিক পূর্বযুগে দেখ যায় জীবনকে এক অখণ্ড রূপ ধরে নিয়ে শিল্প সাধনা ও আধ্যাত্ম সাধনাকে এক করে তুলে ধরে- বিশ্ব সাহিত্যে তাদের স্থান পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন অনেকেই। যেমন ফারসী কবি দাকিকীর কবিতায় নিসর্গ প্রীতি, প্রেম বিরহ ও আধ্যাত্মিকতা কাব্য ধর্মে বাক্সময় হয়ে উঠেছে। সানাই-র ‘তরিকুত তাহকীক’, নিজামীর ‘মাখজানুল আসরার’, আত্তারের ‘মান্তেকুত তায়ের’, ‘রিয়াজুল আরেফিন’ রুমীর ‘মসনবী’, সাদীর ‘গুলিস্তাঁ’, ‘বোস্তাঁ’ হাফিজের ‘দেওয়ান’ ইত্যাদি কাব্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কিভাবে আধ্যাত্মিকা ও নৈতিকতার আবেশে সাহিত্য-কলা অপরূপ রূপে ‘কালের কপোল তলে’ উজ্জ্বল ও স্থায়ী আসন করে নেয়। আধ্যাত্মিক সাধনা সমৃদ্ধ ফারসি সাহিত্য সম্পর্কে একটি কথা আছে যে, যতদিন পৃথিবী আছে ততদিন ফেরদৌসির ‘শাহনামা’, নিজামীর ‘পাঞ্চ গঞ্জ’, জামীর ‘হপ্ত আওরঙ্গ’ এবং রুমীর ‘মসনবী’ মহাকালের ঘর্ষণেও মুছে যাবার নয়।
কিন্তু একালে শিল্প সাধনা ও আধ্যাত্ম সাধনায় প্রচুর ভেদ দাঁড়িয়ে গেছে। সবরকমের অধিবিদ্যা মূলক চিন্তাকে প্রত্যাখ্যান করে সহিত্যে এসে প্রবেশ করেছে প্রকৃতিবাদ, প্রকৃতিবাদীরা মানুষের মধ্যে প্রত্যক্ষ করলেন প্রকৃতির অংশ, আবার সাহিত্যে প্রতিফলিত হলো ইমপ্রেসনিজম-এর ছাপ। এই নতুন ধরনের সাহিত্য সৃষ্টি করে যারা খ্যাতিমান হয়েছেন তাদের মধ্যে ফরাসি কবি বোদলেয়ার অন্যতম। তিনি নীতিবোধ ত্যাগ করে অবাধ ইন্দ্রিয়ত্ব ভোগ ও তীক্ষè অশৃক্সক্ষলিত জীবন অনুভূতির মধ্য দিয়ে চাইলেন সব বাধা-নিষেধ বঞ্চনাকে পেরিয়ে অক্ষত ও নিত্য স্বরূপ টিকে থাকা সুন্দরকে। আবার প্রকৃতিবাদীদের মতো এক্সপ্রেসনিস্টরাও দাঁড়িয়ে আছেন জীবন যুদ্ধের মাঝখানে। তাদের সাহিত্য সংগ্রামমুখী ও আক্রমণাত্মক। অসুস্থ ও বিকৃত রুচির সাহিত্য সৃষ্টি তাদের মধ্যে প্রায়শই লক্ষ করা যায়।
এভাবে শিল্প-সাহিত্যে নৈতিকার প্রভাব না থাকায় সাহিত্য জীবনের শৈশবের লঘু চাপল্য ও যৌবনের উদ্যমতা অতি তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গিয়ে- আজ স্থবির বার্ধক্য ও মৃত্যুর গুরু গাম্ভীর্যে চেপে বসেছে। এই একই কারনে প্লেটো তার একাডেমী থেকে কবিকে বের করে ছিলেন মূল্য বিচারেই। কবি কল্পনার আলোকে অভিজ্ঞতাকে পরিবেশন করেন বলেই বাস্তবতা পরিবর্তিত হয় অবাস্তবতায়। এমনকি কবি জগৎকে আমূল পাল্টে দেন। ফলে নৈতিক সত্য এতে যেমন অবিকল থাকে না, তেমনি সামাজিক প্রয়োজনও সেখানে প্রেক্ষিত বদলে ফেলে।
সময় ও সমাজের প্রেক্ষাপটে নৈতিকতায় কোনো পরিবর্তন আসে না। মানব ইতিহাসের দিকে তাকালেইে দেখা যায় যে, সৃষ্টি কর্তাকে সংলগ্ন করে অর্থাৎ ধর্ম প্রসঙ্গ- কেন্দ্র করে যে নৈতিকতা গড়ে উঠেছে তাই মানুষের নৈতিক কর্মাণ্ডকে যথাযথ করেছে। আবার নৈতিকা শুধুমাত্র নৈতিক কাজের মধ্যেই নয়, বরং অনৈতিকতা থেকে মুক্ত হয়ে সৎভাবে বেঁচে থাকার মধ্যে নিহিত। অর্থাৎ মা’রুফের প্রতিষ্ঠা ও মুনকার-এর উৎখাতের মধ্য দিয়ে যে জীবনবোধ গড়ে ওঠে তা-ই নৈতিকতার অপর নাম। এই সৎ ও অসতের দ্বন্দ্বে সত্যের বিজয়কে ফুটিয়ে তোলাই সাহিত্যে নৈতিকতার দাবি।
সাহিত্যে নৈতিকতার উদাহরণ প্রচুর। দেশে দেশে তাদের নিজস্ব সভ্যতা সংস্কৃতিকে সামনে রেখে নৈতিকতাপূর্ণ সাহিত্য সাধনা এগিয়ে চলছে। বিভিন্ন ধর্মীয় পুস্তকে নীতিনৈতিকতার উপদেশ সরাসরি এসেছে। কিন্তু কুরআন ভিন্ন আঙ্গিকে সাহিত্য রসেই মানুষের সামনে পেশ করেছে নৈতিকতার শিক্ষা। কুরঅনের সূরা ইউসূফকে উত্তম কাহিনী ‘আহসানুল কাসাস’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। কারণ মানবীয় রাগ-অনুরাগ কীভাবে ব্যক্তি জীবনের অনুুভূতিকে নাড়া দিয়ে তাকে ধ্বংসের পথে আহ্বান করে- কিন্তু নৈতিকতাবোধ তার নিজস্ব শক্তি বলে মানুষকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে তা বিধৃত হয়েছে এ কাহিনীতে। নৈতিকাবোধকে সাহিত্য রসে সিক্ত করে কীভাবে পেশ করতে হয় তার উদাহরণ দেশি-বিদেশি সাহিত্যে প্রচুর রয়েছে। যেমন- জার্মান কবি হাইনরিশ হাইনে তার বিখ্যত কবিতা ‘লেরেলাই’তে নৈতিকতার বিজয় ও অনৈতিকতায় ধ্বংসের একটি ছবি এঁকেছেন, যা সাহিত্য সেবীদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে। কবিতাটির বিষয়বস্তু হল- ‘এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে শান্ত নদী রাইন। মৃদুমন্দ বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে তীরের বৃক্ষরাজি। একটি বাঁকের মুখে অনুচ্চ পর্বত চূড়ায় অস্তগামী সূর্যের স্বর্ণচ্ছটায় এক রমণী কেশগুচ্ছ সংযত করতে করতে গান করছে, তার স্বর্ণালঙ্কার স্বর্ণচ্ছটায় আরও দ্যুতিময় হয়ে উঠছে। ঐ সঙ্গীতে মুগ্ধ এক নাবিক লক্ষ করল না যে, জলের তলায় পাহাড় জেগে আছে। সেই পাহাড়ে লেগে তরী হল জলমগ্ন। বিমুগ্ধ নাবিকেরও হল জীবনাবসান। (৯) হইনরিশের কবিতায় উদ্দীপন বিভাবের যে ছবি ফুটে উঠেছে তার মাঝে নৈতিকতার ছাপ সুস্পষ্ট।
মানুষ কতটুকু করতে পারে তা নয় বরং কী করতে চায়, সেটাই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। তাই কবি সাহিত্যিকদের শুধু রিয়ালিজম ন্যাচারিলিজম এর মধ্যে আবদ্ধ থেকে নয়, বরং সাহিত্যে শিল্পে নিজেকে আড়াল করে তার মহৎ উদ্দেশ্যকে আধ্যাত্মিকায় সিক্ত ও নৈতিকতার অলোকে উদ্ভাসিত করে প্রকাশ করার দৃঢ় ইচ্ছা লেখাতে ফুটিয়ে তোলা উচিত।
তথ্য সূত্র
১. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম- নন্দনতত্ত্ব
২. নরেন বিশ্বাস- ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব
৩. ঐ
৪. ঐ
৫. অজিতকুমার চক্রবর্তী- রবীন্দ্রনাথ ও কাব্যপরিক্রমা
৬. আলী যা আলী এজত বেগোবিচ- Morality : Islam between East & west
৭. সুখরঞ্জন রায়- রবীন্দ্র কথা কাব্যের শিল্পসূত্র
৮. ঐ
৯. প্রণবেন্দ্রনাথ ঘোষ- শতাব্দীর জার্মানি : সাহিত্য ও সংস্কৃতি।
(সমাপ্ত)