অতীন্দ্রিয় লোকের বিমর্ষ চেতনার পতন
৮ মে ২০২৫ ১৪:৩৯
॥ শামসুজ্জামান মতীন ॥
আমি আমার জেলার সর্বশ্রেষ্ঠ ভার্সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রফেসর। কন্যাহীন তিন সন্তানের জনক। সর্বোচ্চ ধুমধামে বিয়ে করিয়েছি তাদের। বিয়াই সাহেব সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, বিয়াইন সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রী। একমাত্র কন্যার আদুরেপনার সিক্সের ছাত্রী কোলে চড়ে থাকতো- বলা যায়, মার দায়িত্ব ও দাবিগুলো তেমন একটা গুরুত্ব পেত না। কন্যার যত বায়না তার বাপকে ঘিরে। আমি একজন ছোট-খাটো লেখক নিজেকে এবং পরিবারকে মেলে ধরি আমার লেখায়। গ্রন্থ প্রকাশ সহ জাতীয় পর্যায়ের পত্রিকায় লেখালেখি করি। ইসলামী আদর্শ আর মিথ ছিল সে ধারায়। কন্যাসন্তান না থাকার একটা গুপ্ত বেদনা ছিল গুপ্তস্থানে। তবে তা আমাদের দুজনের মধ্যেই বিষহীন ফুঁস ফুঁস করে আনন্দ-বেদনায় সৃষ্টি করতো।
বড় বৌমা বাংলা ভাষা সাহিত্যের ২য় শ্রেণি মেধাক্রমে ২য়তম (অনার্স), এমএ উভয়তে ২য় শ্রেণি। আমার মরহুম আব্বা মনে করতেন, ঘরের মেয়েরা ঘরেই চাকরিজীবী হবে। এতে পারিবারিক, আত্মীক সম্পর্কের থৈল্যিতা অজান্তে জেঁকে বসতে পারে।
এ প্রসঙ্গে পারিবারিক একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া দরকার।
১ম সন্তান (৪৫) এমএ, কর্মক্ষেত্র (বেসরকারি হাসপাতালের ডিরেক্টর জেনারেল), স্ত্রী (৩২) গৃহিণী। (১) পুত্রসন্তান মাহিম (২৭) অসুস্থ অটিস্টিক, (২) কন্যা নূহা (১২) (লেখাপড়া), (৩) পুত্রসন্তান উজায়ির (৮) (লেখাপড়া)। ২য় সন্তান এম. কম (৩৮) কর্মক্ষেত্র (ব্যবসা),
স্ত্রী এম এস সি (৩০) গৃহিণী। (১) পুত্রসন্তান নূরীন (৯)। পুত্রসন্তান হামজা (৭)।
৩য় সন্তান বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার (৩৫)। স্ত্রী দাখিল (মাদরাসা) (২৮) গৃহিণী। কন্যাসন্তান নাফিসা (৮) লেখাপড়া। কন্যাসন্তান সুমাইয়া (৬) লেখাপড়া। কন্যাসন্তান (২) শিশু।
ছাদ বাদে তিন তলা, টাইল্স দিয়ে পরিপাটি সাজানো। শীতের দিনে ৮ জন নাতি-নাতনি গৃহকর্তা-কর্ত্রী ভিটামিন ডি গ্রহণে ঘণ্টাধিক, সবাই কাটাই- টইটুম্বুর নির্মল বিশুদ্ধ আনন্দ মুহূর্ত ঘিরে আছড়ে পড়ে। এই ৮ জন ফুলের মেলায় মাহিম হচ্ছে ফুলপ্রধান ভাবের ভাষায় টকটকে লাল গোলাপ। সিঁড়ি বেয়ে একাই উঠতে পারে, নিরাপত্তার কারণে পাশের জন আগলে রেখে মাহিম ধপাধপ উঠে আসে ৪র্থ তলার ছাদে।
ছাদের মাঠে কেউ রান্নাবান্না, কেউ কাটাছাঁটা, বাছাবাছি আর সবচেয়ে ছোট আয়িশা মনি খড়গোসের আর ফড়িংয়ের মতো তিড়িং বিড়িং লাফায় আর ফিলটার জড়ানো ছড়ানো আনন্দ উজাড় করে।
এভাবেই চলছিল। ক্রমে পাল্টাতে থাকে অতীন্দ্রিয় আবেশে।
এসব আসা-যাওয়ায় অতি ধীরে মাহিমও একটু একটু করে ভেতরে ভেতরে বদলাতে থাকে।
মাহিমের আম্মা ধর্মীয় আদর্শবাদী সংগঠনে ধীর বলে জেলাপ্রধান হয়ে ওঠেন। নিজ বাসায় সময় দিতে পারেন না। নিজ ঘরে প্রধান সম্পদ মাহিম এবং আম্মা দুজনেই বদলাতে থাকে নিজ মস্তিষ্কের আঙ্গিনায়।
পৃথিবীর আঙিনায় এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যা শ্রুতিসুখ্য এবং পরাবাস্তব: There happens more things in heaven and earth, Horatio, then are reported in your newspaper.
আমার রাত্রিযাপন পর্যায়ক্রমে একতলা, দুতলা, তেতলায়। আজকের সকাল, বিকেল, সন্ধ্যা কেমন যেন ভিন্নতর প্রবাহে বহমান হচ্ছে, ঘুঘু কোকিলের তান থেকে রাতের বাদুড়, চামচিকার মধ্যে স্নিগ্ধ পরিবেশ ছিন্নের কুহক কুকুরের ঘেউ ঘেউ আর কুহক কুকুরের কহুতান।
কবরের শাওতায় আমার এই ছোট্ট শব্দহীন পৃথিবী।
আমরা তেতলায়-মা-মাহিমরা নিচতলায়। অকস্মাৎ আছাড় পড়ার তাণ্ডবতা। অন্যান্য দিন মাহিম খুব রেগে গেলে কাছে যে থাকে তার হাত শক্ত করে ধরে নিজ গালে চাপড়াতে বলে। আর গোঁ গোঁ শব্দ করে নিজে কখনো কাউকেই আঘাত করে- আঘাত করার উদ্যমতার আত্মীক শক্তি তার নেই।
আজ ঘুরে গেছে তার সেই ভীতসন্ত্রস্ত মনোভাব। আপাদমস্তক জেগে উঠেছে মূর্ছিত মাহিম।
আমরা দুজন, দাদা দাদু অজানিত ভীতকর তার সঙ্গে দ্রুত দৌড়ে নেমে এলাম।
আমাদের দেখেই ক্ষীপ্ততা আরো ক্ষীপ্ততর বহুগুণে বৃদ্ধি পেল। ইতোমধ্যে পরিবারের সকল সদস্য নিচতলা ভরে উঠলো।
মাহিম আবেগের প্রচণ্ডতায় থর থর করে কাঁপছে। করিডোরের জায়গাটা মাহিমের দৌড়ে সিডর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। পৃথিবী ধসে ফেলার ভূকম্পন সর্বোচ্চ স্কেলে ক্রমে উঠেছে। ভেতরের যে কয়টা জানালা-দরজা হাতের নাগালে পাচ্ছে, হযরত আলী (রা.) ঐশীশক্তি ভেঙে চুরে ছারখার করে দিচ্ছে। এতো শক্তি, যা ক্রমে সঞ্চিত হয়ে উঠেছে- তা মাহিমের কব্জিতে উপচে পড়ছে। মাহিমের প্যান্ট-শার্ট সম্পূর্ণ ছেঁড়া এবড়ো থেবড়ো। সবগুলো থায়োগ্লাস ঝুর ঝুরে মলমূত্রে সারা অঙ্গ স্নাত। ওর আম্মা আব্বার ধমকের ভয় কোনো কাজেই লাগছে না। রাগে ক্ষোভে মাহিমের আব্বার হাতে কুরবানিতে ব্যবহৃত চকচকে ধারালো দা। তা দেখে মাহিম আরো হিংস্র আর ক্ষীপ্ত হয়ে ওঠে। মাহিমের আব্বা-আম্মা খুবই শান্ত আর মোলায়েম প্রকৃতির মাহিমের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছে আর বলছে, ‘‘আজ তো কুপিয়ে মেরেই ফেলবো’’, দুজনেই পড়ে গেলো হাতে পায়ে রক্ত মলমূত্র। দায়ের একটা কোপ মাহিমের আর ও আব্বার হাতে লেগে রক্তে মেঝে লাল হয়ে উঠলো। মাহিম গোঁ গোঁ করছে মেঝেতে পড়ে গোঙাচ্ছে। ওর আব্বাকে আমি প্রচণ্ড ধমক দিলাম, ‘‘তুই কি পাগল হয়ে গেলি? ও আমার দিকে তাকিয়ে চোখের একটু ইশারা দিল। আমি বুঝে গেলাম ওর উদ্র ক্ষীপ্ততা। মাহিম তখন মেঝেতে পড়ে গোঁ গোঁ গোঙানি করছে চোখ ঠিকরে বেরোচ্ছে। মাহিমের চোখ ক্রমে বন্ধ হয়ে আসছে। খুলছে না, জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। মাহিমের আব্বা-আম্মাসহ আমরা সবাই আমি শুদ্ধ বাসার সবাই হাউমাউ করে উচ্চৈঃস্বরে কান্নায় ভেঙে পড়ছি। মলের দুর্গন্ধ, এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করছে ওর দাদু আর মা কী হলোর, কী হলোর, এ আমার কি হলো আল্লাহ, সবার চোখ ভেসে যাচ্ছে- মনে হয় আছে, মনে হয় নাই। ওর আব্বা-আম্মা শিশুসন্তানের অঝরে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদছে। বুকের বাঁ পাশে তাকিয়ে মনে হলো দম আসছে আল্লাহ তুমি ভিক্ষা দাও- আমার বদলে ওকে ভিক্ষা দাও আল্লাহ। মুদ্রিত চোখ আর খুলছে না —-।
মাহিমের আব্বা, প্রাইভেট এক হাসপাতালের ডাইরেক্টর জেনারেল (ডিজি ছোট-খাটো) ডাক্তার। মাহিমের নার্ভস্পন্দন ক্ষীণ।
অতিদ্রুত নিজের হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে অনবরত স্যালাইন চলছে। পরিবারের সবাই উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারণ আল্লাহ ভিক্ষা দাও, আল্লাহ ভিক্ষা দাও —-। শেষ রাতের দিকে একটু একটু করে তাকাতে থাকলো। ওর আব্বা-আম্মাসহ আমরা সবাই হাত উঁচিয়ে অনবরত কাঁদছি। আব্বাকে দেখেই মাহিম চিৎকার করে উঠলো : দাদু —- ব্যা —— ব্যা উঃ আহ্, উঃ আমাকে মাইরা ফালাইলো —— মাইরা ফালাইলো —- বা —- বা —- দাদু দাদা আমাকে বাঁচাও —- গভীর গোঙরানির অভ্রভেদী অন্তভেদী চিৎকারে পুরো হাসপাতাল কেঁপে কেঁপে উঠছে। সারাক্ষণ পাশে বসা প্রফেসর ডা. রাশেদুল হাসান, ডা. নীলু শারমিন বসে আছেন। বলছেন ডিজি সাহেব বড় গোছের একটা মানত করুন। আল্লাহ ভিক্ষা কবুল করেছেন।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, কবি ও কথা সাহিত্যিক।