দাওয়াত ও তাবলিগ
৮ মে ২০২৫ ১৪:৪৩
ডক্টর মোহাম্মদ ইদ্রিস
তাবলিগ আরবী শব্দ, এর অর্থ হলো পৌঁছে দেওয়া। ইসলামের সুমহান আদর্শ সবার নিকট পৌঁছে দেওয়াকে তাবলিগ বলা হয়। শব্দটির আরেকটি প্রতি শব্দ হলো দাওয়াত। যার আভিধানিক অর্থ আহ্বান, নিমন্ত্রণ, দোয়া, ডাকা, সাহায্য কামনা, প্রচার, অনুরোধ ইত্যাদি। অন্য অর্থে কাউকে কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের দিকে অনুপ্রাণিত করা, উৎসাহিত করা, প্ররোচিত করা প্রভৃতি। এ মর্মে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘সে (ইউসুফ) বলল, ‘হে আমার রব! নারীরা আমাকে যে কাজের প্রতি আহ্বান করছে, তা থেকে কারাগারই আমার নিকট অধিক প্রিয়।’ [সূরা ইউসুফ: ৩৩]। আরবী ভাষায় তাবলিগ-এর বাংলা রূপ হলো ইসলামের আহ্বান মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এ শব্দটির ব্যাপক অর্থ বিদ্যমান। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে তাবলিগ বা দাওয়াত বোঝাতে কিছু পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন: এর অর্থ কোনো কিছু প্রার্থনা করা। এ প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে, ‘আর যখন আমার বান্দাগণ তোমাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে, আমি তো নিশ্চয় নিকটবর্তী। আমি আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দেই, যখন সে আমাকে ডাকে।’ [সূরা আল-বাকারা: ১৮৬]।
তাবলিগ বা দাওয়াহ এর আরেক অর্থ হলো ডাকা, আহ্বান করা। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর আল্লাহ শান্তির আবাসের দিকে আহ্বান করেন এবং যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দেন সরল পথের দিকে।’ [সূরা ইউনুস: ২৫]। পারিভাষিক অর্থে শুধু আহ্বান জানানোকে দাওয়াত বলা হয় না। বরং এর অর্থ আরো ব্যাপক। ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টি কর্তৃক গৃহীত বিজ্ঞানসম্মত ও শিল্প সঞ্জাত উপায়ে নির্দিষ্ট বিষয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করা, মেনে নেওয়া এবং তাদের বাস্তব জীবনে চর্চার ব্যবস্থা করে দেওয়ার পদ্ধতিগত সকল প্রচেষ্টা ও কার্যাদি যার অন্তর্ভুক্ত থাকে, তাই দাওয়াত। সুতরাং বলা যায়, কোনো নির্দিষ্ট পথ, মত ও আদর্শের প্রতি মানুষকে আহ্বান জানানো ও বাস্তব জীবনে তা চর্চার পন্থা দেখিয়ে দেওয়ার ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত সামগ্রিক পদ্ধতি ও কৌশলের নামই হলো দাওয়াত।
তাবলিগ বা দাওয়াত দান পদ্ধতি: মানবজীবনে তাবলিগে দীন বা ইসলামী দাওয়াতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। কারণ এর মাধ্যমেই মানুষকে এ পৃথিবীতে তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত করা হয়। এর মাধ্যমেই সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করার মহান কাজটি সম্পন্ন কার যায়। এর মাধ্যমে সুকৃতির চর্চা হয় এবং দুষ্কৃতি অপসারিত হয়। সুতরাং ইসলামী দাওয়াত মানব জীবনের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত এবং জীবনপ্রবাহে অত্যন্ত গুরুত্বের দাবিদার। এজন্য আল-কুরআন ও আল-হাদীসের আলোকে ইসলামী দাওয়াতের সঠিক পদ্ধতি জানা একান্ত জরুরি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আল-কুরআনের সূরা আন্ নাহলে তাবলিগে দীন বা ইসলামী দাওয়াতের বাস্তবসম্মত পদ্ধতি মুমিনদের জানিয়ে এরশাদ করেন, ‘হিকমাত (বিজ্ঞতা-বুদ্ধিমত্তা-বিচক্ষণতা) অবলম্বন করে ও নসিহতপূর্ণ সুন্দর বক্তব্যের মাধ্যমে লোকদের তোমার রবের পথের দিকে ডাক। আর তাদের সাথে বাক্যবিনিময় কর সর্বোত্তম যুক্তি-প্রদর্শন করে। অবশ্যই তোমার রব বেশি জানেন কে তাঁর পথচ্যুত হয়েছে এবং তিনি বেশি জানেন কে আছে সঠিক পথে।’ [সূরা আন-নহল: ১২৫]। সূরা আন নাহল-এর এ আয়াতে কারীমায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় দাওয়াত দানের তিনটি পদ্ধতি তুলে ধরেছেন। তিনি দাঈ ইলাল্লাহকে (ক) হিকমত অবলম্বন, (খ) নসিহতপূর্ণ সুন্দর বক্তব্য উপস্থাপন এবং (গ) সর্বোত্তম যুক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে দাওয়াত প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন।
(ক) হিকমত অবলম্বন: ‘আল-হিকমত’ শব্দটির বহুবিধ অর্থ রয়েছে। এখানে শব্দটি বিজ্ঞতা-বুদ্ধিমত্তা-বিচক্ষণতা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আদ্ দাওয়াতু ইলাল্লাহ যেন তেন ভাবে করার কাজ নয়। এটি বিজ্ঞতা-বুদ্ধিমত্তা-বিচক্ষণতা দাবি করে। ‘দাঈ ইলাল্লাহকে পরিবেশ-পরিস্থিতির দিকে লক্ষ রাখতে হবে। ব্যক্তি মানসিকভাবে কী অবস্থায় আছেন, তা আঁচ করতে হবে। ব্যক্তির সময়ের অবস্থা কী, তাও জানতে হবে। আলাপ-আলোচনাকালে নিজে কিছু বলতে হবে, তাঁকেও বলতে দিতে হবে। আলাপচারিতার ভেতর দিয়েই ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে হবে। যেই বিষয়ে তাঁর চিন্তায় বিভ্রান্তি রয়েছে, সেই বিষয়ে আল-কুরআন ও আল-হাদীসের বক্তব্য তাঁর সামনে তুলে ধরতে হবে। আলাপ-আলোচনায় ভদ্রতা-শালীনতা বজায় রাখতে হবে। কোনো অবস্থাতেই রেগে যাওয়া যাবে না। বক্তব্য শুনে শ্রোতার মনে যেন এ ধারণা সৃষ্টি না হয় যে, ভদ্রলোক আমাকে নির্বোধ মনে করছেন। বক্তব্য শুনে শ্রোতার মনে যেন এ ধারণা সৃষ্টি না হয় যে, ভদ্রলোক আমাকে অবজ্ঞা করছেন। হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা শুরু হওয়া প্রয়োজন এবং হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশেই তা শেষ হওয়া প্রয়োজন। আত-তাবারীর মতে, হিকমত হলো, কথা ও কাজের যথার্থতা ও সঠিক হওয়া।’ [জামিউল বায়ান]।
ইমাম রাযী (র.)-এর মতে, প্রত্যেকটি বিষয় বা বস্তুকে যথাযথ স্থানে রাখাকে হিকমত বলা হয়। [তাফসীরুল কাবীর]। আল্লামা আলুসী (র.)-এর মতে, হিকমত একটা জ্যোতিবিশেষ, যা দ্বারা শয়তানের প্ররোচনা ও আল্লাহর ইলহামের মধ্যে পার্থক্য করা যায়। [রূহুল মা’আনী]। ইমাম মালেক (র.) বলেন, হিকমতের অর্থ আমার অন্তরে যা আসে, তা হলো, এটা আল্লাহর দীন সম্পর্কে পাণ্ডিত্য। আর এটা এমন একটা বিষয়, যা আল্লাহ স্বীয় দয়া, করুণায় মানুষের অন্তরে ঢেলে দেন। [ইবনে কাছীর]। লিসানুল আরব প্রণেতা ইবনে মনযুর বলেন, সর্বোত্তম বিদ্যার মাধ্যমে সর্বোত্তম বিষয়সমূহ জানার নাম হিকমত। তাফসীরে মারেফুল কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, হিকমত বলতে সেই অন্তর্দৃষ্টিকে বোঝানো হয়েছে, যার সাহায্যে মানুষ অবস্থার তাগিদ জেনে নিয়ে তদনুযায়ী কথা বলে। এমন সময় ও সুযোগ খুজে নেয় যে, প্রতিপক্ষের ওপর বোঝা হয় না। নম্রতার স্থলে নম্রতা এবং কঠোরতার স্থলে কঠোরতা অবলম্বন করে। যেখানে মনে করে যে, স্পষ্টভাবে বললে প্রতিপক্ষ লজ্জিত হবে, সেখানে ইঙ্গিতে কথা বলে কিংবা এমন ভঙ্গিতে কথা বলা যদ্দরুন প্রতিপক্ষ লজ্জার সম্মুখীন হয় না এবং তার মনে একগুঁয়েমি ভাবও সৃষ্টি হয় না। এখানে হিকমত দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে যাদের সামনে দাওয়াত পেশ করা হবে তাদের অবস্থা ও পরিস্থিতির প্রতি লক্ষ রাখা। কতটুকু বক্তব্য তাদের সামনে উপস্থাপন করলে তারা বিরক্ত হবে না সে দিকে লক্ষ রেখে বক্তব্য পেশ করা। মানসিক প্রস্তুতির পূর্বেই তাদেরকে কোনো ধর্মীয় বিধান পালনে বাধ্য না করা। কোন পদ্ধতিতে বক্তব্য পেশ করলে অধিক ফলপ্রসূ হবে, সেদিকে খেয়াল করা। সবরকম লোকদের নিকট একই ধরনের বক্তব্য উপস্থাপন না করা। সর্বোপরি শ্রোতাদের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বক্তব্যের ধরন-ধারণের বৈচিত্র্য আনয়ন করা। সাথে সাথে এটাও লক্ষ রাখতে হবে যে, বক্তব্যের মাধ্যমে যেন অহেতুক উত্তেজনা, অনাকাক্সিক্ষত চাঞ্চল্য এবং ধর্মীয় উগ্রতা ও উন্মাদনা সৃষ্টি না হয়। অন্যথায় দাওয়াত ও তাবলিগের আসল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হতে পারে, যা হিকমত ও বিচক্ষণতার পরিপন্থি। [তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন]। আসলে দাওয়াতের ক্ষেত্রে হিকমত অর্থ হলো, নির্বোধের মতো চোখ বন্ধ করে দাওয়াত প্রচার করবে না। বরং বুদ্ধি খাটিয়ে যাকে দাওয়াত দেয়া হচ্ছে তার মন-মানস, যোগ্যতা ও অবস্থার প্রতি নজর রেখে এবং এ সঙ্গে পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে কথা বলতে হবে।
(খ) নসিহতপূর্ণ সুন্দর বক্তব্য উপস্থাপন: ‘আল-মাওইযা’-এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কোনো শুভেচ্ছামূলক কথা এমনভাবে বলা, যাতে প্রতিপক্ষের মন তা কবুল করার জন্য নরম হয়ে যায়। আর হাসানার অর্থ হলো, বর্ণনা ও শিরোনাম এমন হওয়া যে, প্রতিপক্ষের অন্তর নিশ্চিত হয়ে, সন্দেহ দূর হয়ে যায় এবং অনুভব করে যে, এতে দাঈর কোনো স্বার্থ নেইÑ শুধু তার শুভেচ্ছার খাতিরে বলা হচ্ছে। এখানে শুধু ‘আল-মাওইযা’ শব্দ দ্বারাই শুভেচ্ছামূলক কথা কার্যকরী ভঙ্গিতে বলার বিষয়টি ফুটে উঠেছিল। কিন্তু শুভেচ্ছামূলক কথা মাঝে মাঝে মর্মবিদারক ভঙ্গিতে কিংবা এমনভাবে বলা হয় যে, প্রতিপক্ষ অপমানবোধ করে। তাই এ পন্থা পরিত্যাগ করার জন্য হাসানা শব্দটি সংযুক্ত করা হয়েছে। বক্তব্য হতে হবে সঠিক, বক্তব্য হতে হবে সোজা-সুস্পষ্ট, কোনো ধোঁয়াশা ভাব থাকবে না। এতে কোনো গোঁজামিল থাকবে না। বক্তব্যের ভাষা হতে হবে প্রাঞ্জল। বক্তব্য হতে হবে হৃদয়গ্রাহী। বক্তব্য হতে হবে এমন, যা একদিকে শ্রোতার আবেগ, অন্যদিকে শ্রোতার বুদ্ধিবৃত্তিকে নাড়া দেবে। বক্তব্য এমন হওয়া চাই, যা শ্রোতার মনে এমন আলোচনা আরো শোনার আগ্রহ সৃষ্টি করবে।
আলোচ্য আয়াতে ‘আল-মাওইযাতুল হাসানা’ এর দুটি অর্থ হতে পারে। একটি এই যে, যাদের কাছে দাওয়াতি কাজ করা হবে, তাদের কেবল যুক্তি ও দলিল দ্বারাই বোঝানোর চেষ্টা করা উচিৎ নয়, বরং তাদের আবেগ-উচ্ছ্বাস ও মানসিক ভাবধারাকেও উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করতে হবে। দোষ-ত্রুটি ও বিভ্রান্তিসমূহের শুধু বুদ্ধিগত দিক দিয়েই প্রতিবাদ করা যথেষ্ট নয়; বরং মানুষের প্রকৃতির গভীরে এর প্রতি যে ঘৃণা রয়েছে, তাকে তীব্রতর করে তোলার চেষ্টা করতে হবে। এর মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কেও তাদেরকে ভীত ও শঙ্কিত করে তুলতে হবে। হিদায়াত ও নেক আমলের শুদ্ধতা এবং সৌন্দর্য বৈশিষ্ট্যকে কেবল বুদ্ধিগত দিকে দিয়ে প্রমাণিত করাই যথেষ্ট নয়; বরং এর প্রতি ঐকান্তিক আগ্রহ-উৎসাহ ও কৌতূহলও জাগিয়ে তুলতে হবে। এর দ্বিতীয় অর্থ এই যে, উপদেশ দিতে হবে এমনভাবে, যেন তাতে অকৃত্রিম দরদ ও কল্যাণ কামনার আকুল আবেগ ফুটে ওঠে। শ্রোতা যেন মনে না করে যে, উপদেশদানকারী বা দাঈ তাদের হীন ও নগণ্য মনে করে। বরং তারা যেন অনুভব করে যে, উপদেশ দানকারী বা দাঈর হৃদয়ে তাদের সংশোধন করার জন্য একটি বেদনা রয়েছে এবং আসলেই সে তাদের কল্যাণকামী। [তাফহীমূল কুরআন]।
(গ) সর্বোত্তম যুক্তি প্রদর্শন: সুন্দর সুন্দর উদাহরণ ও যুক্তি উপস্থাপন করে বক্তব্যকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে। আলোচনাকে বিতর্ক অনুষ্ঠানে পরিণত করা যাবে না। বুদ্ধির লড়াইয়ে অন্যকে হারিয়ে দেওয়া লক্ষ্য হবে না। গলাবাজি করা যাবে না। যুক্তি প্রদর্শনকালে মধুর বাক্য ব্যবহার করতে হবে। কূট-তর্কে জড়িয়ে পড়া যাবে না। আলোচনা উত্তেজনার দিকে এগিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে আলোচনার ইতি টানতে হবে। হাসিমাখা মুখে হাত মিলিয়ে শান্তভাবে বিদায় গ্রহণ করতে হবে। আলোচ্য আয়াতের শেষাংশে কোনো লোকের হিদায়াত প্রাপ্তি সম্পর্কে আরেকটি মহাসত্য ব্যক্ত করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘অবশ্যই তোমার রব ভালো করেই জানেন, কে তাঁর পথচ্যুত এবং তিনি ভালো করেই জানেন, কারা সঠিক পথের পথিক।’ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর চাচা আবু তালিবকে মুসলিম বানাবার জন্য বার বার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি। এ পরিপ্রেক্ষিতে সূরা আল-কাসাস-এর ৫৬ নাম্বার আয়াত নাজিল করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘তুমি যাকে চাও তাকেই হিদায়াত করতে পার না। আল্লাহ যাকে চান তাকে হিদায়াত দান করেন। আর তিনি ভালো করেই জানেন কারা হিদায়াতের পথের পথিক।’
হিদায়াতপ্রাপ্তি সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন আল-কুরআনে বিভিন্ন বক্তব্য রেখেছেন। এসব বক্তব্যের সারকথা হচ্ছে, যেই ব্যক্তি আল্লাহর দিকে এগিয়ে আসতে চায় আল্লাহ তাকে তাঁর কাছে টেনে নেন। কিন্তু যেই ব্যক্তি তাঁর দিকে আসতেই চায় না, তার পেছনে দৌড়ানো আল্লাহর কাজ নয়। অর্থাৎ হিদায়াত প্রাপ্তি একদিকে ব্যক্তির আগ্রহ অন্যদিকে আল্লাহর অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল। এ বাক্য দ্বারা এখানে বোঝানো হয়েছে যে, যদি দাওয়াতের কাজে কোথাও তর্ক-বিতর্ক করতেই হয়, তবে তা হতে হবে উত্তম পন্থায়। এটা যেন কেবল বুদ্ধির লড়াই ও মানসিক কুস্তিতে পরিণত না হয়। এ দ্বারা প্রতিপক্ষকে চুপ করিয়ে দেওয়া এবং নিজের বাকপটুতাকেই প্রতিষ্ঠিত করা উদ্দেশ্যে নয়। বরং কথা বার্তায় এমন নম্রতা ও কোমলতা অবলম্বন করতে হবে এবং এমন যুক্তি প্রমাণ পেশ করতে হবে, যাতে প্রতিপক্ষ সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। বহুল প্রচলিত প্রসিদ্ধ ও সুবিদিত বাক্যাবলীর মাধ্যমে প্রমাণ দিতে হবে। যাতে প্রতিপক্ষের সন্দেহ-সংশয় দূরীভূত হয় এবং সে হঠকারিতার পথ পরিত্যাগ করে দীন গ্রহণে প্রভাবিত হয়। দাওয়াতি কাজে বিতর্ক করতে গিয়ে অহেতুক উত্তেজনা ও অতি উৎসাহের বশবর্তী হয়ে এমন কোনো পরিবেশ তৈরি করা যাবে না, যাতে প্রতিপক্ষ অন্যায় বিতর্কে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিভ্রান্তিতে সে আরো দূরে চলে যায়।
এ কথা বলে আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিচ্ছেন যে, কে পথ হারা এবং কে সত্য পথের অনুসারী তা একমাত্র তিনিই অবগত আছেন। কাজেই প্রতিপক্ষের সাথে তর্ক করতে গিয়ে অহেতুক বাদানুবাদের কোনো প্রয়োজন নেই। বরং সত্যকে সঠিক পদ্ধতিতে উপস্থাপন করে, তা প্রমাণিত করাই দাওয়াতের উদ্দেশ্যে হওয়া উচিত। চূড়ান্ত ফলাফল আল্লাহর হাতেই ন্যস্ত। মৌখিক দাওয়াত ও যুক্তির মাধ্যমে তর্ক-বিতর্কের ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে সঠিক পদ্ধতি ও নিয়মনীতি। [ফী যিলালিল কুরআন]। কোনো কোনো তাফসীরকারক বলেন, উল্লেখিত তিনটি বিষয় তিন প্রকার প্রতিপক্ষের জন্য বর্ণিত হয়েছে। হিকমতের মাধ্যমে দাওয়াত জ্ঞানী ও সুধীজনের জন্য, সদুপদেশের মাধ্যমে দাওয়াত জনসাধারণের জন্য এবং বিতর্কের মাধ্যমে দাওয়াত তাদের জন্য যাদের অন্তরে সন্দেহ ও দ্বিধা রয়েছে অথবা যারা হঠকারিতা ও একগুঁয়েমির কারণে কথা মেনে নিতে সম্মত হয় না।
হাকিমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানবী (র.) বলেন এ তিনটি বিষয় পৃথক পৃথক তিন প্রকার প্রতিপক্ষের জন্য নয় বরং দাওয়াতের এ সুষ্ঠ পন্থাগুলো প্রত্যেকের জন্যই প্রযোজ্য। কেননা দাওয়াতে সর্বপ্রথম হিকমতের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের অবস্থা যাচাই করে তদনুযায়ী শব্দ চয়ন করতে হবে। এরপর এসব বাক্যে শুভেচ্ছা ও সহানুভূতির মনোভাব নিয়ে এমন যুক্তি-প্রমাণ পেশ করতে হবে, যা দ্বারা প্রতিপক্ষ নিশ্চিত হতে পারে যে, এ সত্যের দাওয়াত তারই কল্যাণের জন্য। আর বর্ণনাভঙ্গি ও কথাবার্তা এমন সহানুভূতিপূর্ণ ও নরম রাখতে হবে, যাতে প্রতিপক্ষ নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস করে যে, দাঈ যা কিছু বলছে, তা তারই কল্যাণ ও উপকারার্থে এবং হিতাকাক্সক্ষাবশতই বলছে। তার শরমিন্দা কিংবা মর্যাদাকে আহত করার লক্ষ্যে নয়।
সমাপনী: বিজ্ঞতা-বুদ্ধিমত্তা-বিচক্ষণতা সহকারে লোকদের আল্লাহর পথে আহ্বান জানাতে হবে। নসিহতপূর্ণ সুন্দর বক্তব্য উপস্থাপন করে এবং সর্বোত্তম যুক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে লোকদের আল্লাহর পথে আহ্বান জানাতে হবে। শ্রেষ্ঠ উম্মাত হিসেবে আমাদের মানবজাতির কল্যাণের জন্য আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান জানাতে হবে। আল্লাহর পথে আহ্বানকারীকে পরিবেশ-পরিস্থিতির দিকে লক্ষ রেখে আহ্বান জানাতে হবে। ব্যক্তি মানসিকভাবে কী অবস্থায় আছেন তা আঁচ করতে হবে। ব্যক্তির সময়ের অবস্থা কী, তাও জানতে হবে। আলাপ-আলোচনাকালে নিজে কিছু বলতে হবে, তাঁকেও বলতে দিতে হবে। আলাপচারিতার ভেতর দিয়েই ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে হবে। যেই বিষয়ে তাঁর চিন্তায় বিভ্রান্তি রয়েছে, সেই বিষয়ে আল-কুরআন ও আল-হাদীসের বক্তব্য তাঁর সামনে তুলে ধরতে হবে। হিদায়াতপ্রাপ্তি একদিকে ব্যক্তির আগ্রহ; অন্যদিকে আল্লাহর অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল। দাঈর কর্তব্য হচ্ছে, আল্লাহর নির্দেশ মুতাবিক অব্যাহতভাবে দাওয়াতি কাজে অবিরত থাকা। দাওয়াতি টার্গেটকৃত ব্যক্তির হিদায়াতের জন্য আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সঠিক নিয়ম পদ্ধতি অনুসরণ করে আদ্ দাওয়াতু ইলাল্লাহ বা তাবলিগে দীনের কাজ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাঁথিয়া মহিলা ডিগ্রি কলেজ, পাবনা।