ফি বছরই বাজেট হয়, কিন্তু দরিদ্রতা, বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি কমছে কি?
৪ জুন ২০২৫ ১১:৩৪
॥ ফেরদৌস আহমদ ভূইয়া॥
বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বড় হওয়ার পাশাপাশি বাজেটের আকারও প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছে। টাকার অংকে প্রতি বছরই বিশাল বাজেট প্রণয়ন ও ঘোষণা করা হচ্ছে। অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন- দুই দিকের বাজেটই বাড়ছে সমানতালে। এবারের বাজেটের আকারও ছোট নয়, বরং বড়ই বলতে হবে- যার পরিমাণ হচ্ছে সাত দশমিক নয় ট্রিলিয়ন টাকা, যা গত বছরের বাজেটের চেয়ে কিছু কম। উল্লেখ্য, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি, পরে তা সংশোধিত বাজেট হিসেবে ৭ লাখ ৪৪ হাজার কোটি করা হয়। গত ২ জুন সোমবার অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বিশাল অংকের তথা ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছে। বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা, বার্ষিক উন্নয়ন ব্যয় (এডিপি), অনুন্নয়ন ব্যয়ের একটি অংক নির্ধারণ করা হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, এডিপির প্রস্তাব করা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরের বাজেটে অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৮৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এছাড়া বাজেটের ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। এ ঘাটতি পূরণে এক লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা।
রাজস্ব বাজেটের প্রায় ৫৭ শতাংশের সিংহভাগ অর্থ বেতন, ভর্তুকি, প্রণোদনা এবং ঋণ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ করা হতে পারে। শুধু বেতন-ভাতা ৮২ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাবে বলে মনে করা হচ্ছে। বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য মহার্ঘ ভাতাও চালু করা হতে পারে। ভর্তুকি ব্যয় মোট ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এতে সুদ পরিশোধ রাজস্ব বাজেটের প্রায় ২২ শতাংশ হতে পারে।
আমাদের প্রতি বছর বিশাল বাজেট প্রণয়ন করা হয় এবং সরকার পাস করে। কিন্তু বাজেটের আসল উদ্দেশ্য কি পূরণ হচ্ছে? একটি রাষ্ট্রে কেন বাজেট করা হয় এবং বাজেট ঘোষণা করে পেশ করা হয়। তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী, এটা কি শুধু একটা টাকার অংক ঘোষণার বিষয়, নাকি তার জন্য একটি লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও প্রত্যাশা রয়েছে।
একটি রাষ্ট্রের বাজেটের মূল লক্ষ্য হলো দেশের ও জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধন করা। এটাকে আরো বিস্তারিতভাবে বলা যায়, তাহলে বলতে পারি বাজেটের লক্ষ্য থাকে বেশ কয়েকটি। যেমন দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কতটা অর্জিত হবে, মূল্যস্ফীতি কীভাবে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যাবে, বেকারত্ব হ্রাস এবং দারিদ্র্যবিমোচন কীভাবে সম্ভব হবে।
সরকারের যে অর্থ আয় হয়, তা দিয়ে দেশ পরিচালনায় যত ধরনের ব্যয় আছে, তা পূরণ করে বাকি অর্থ দিয়ে সরকার উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করে। এজন্য বরাদ্দ রাখা এ অর্থকে উন্নয়ন বাজেটও বলা হয়। এবারের বাজেটে উন্নয়ন খাতে ব্যয় বরাদ্দ করা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। বিগত আর্থিক বছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও চূড়ান্তভাবে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। উন্নয়ন ব্যয় কমানো হয় ১৮ হাজার কোটি টাকা।
বাজেট ও মূল্যস্ফীতি হ্রাস
বাংলাদেশের জনগণের কাছে নতুন বাজেট মানে এক নতুন আতঙ্ক। কারণ বাংলাদেশে প্রতি বছরের বাজেটেই নতুন নতুন কর আরোপ করা হয়। নতুন করারোপ মানেই তো পণ্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি। আবার মূল্যস্ফীতি। অথচ বাজেটের অন্যতম লক্ষ্য থাকে মূল্যস্ফীতি হ্রাস করা। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে ৬.৫ শতাংশে নিয়ে আসার টার্গেট করা হয়েছে। কিন্তু তা কতটুকু সফল হবে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তা বোঝা যাবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের কাছাকাছি।
বাংলাদেশ যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে, তখন অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা উল্লেখযোগ্য হারে মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে। অথচ শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতির হার ছিল বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি।
সংকটের চূড়ান্ত সময় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শ্রীলঙ্কার সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ৭৩ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত ওঠে। ২০২৩ সালের মে মাসে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ৩৭ দশমিক ৩ শতাংশ। সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যান্য সূচকেও বাংলাদেশ এ দুটি দেশের তুলনায় ভালো অবস্থানে ছিল। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না।
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি নেমে আসে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশে এবং শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতির ধারা থেকে বেরিয়ে উল্টো মূল্যহ্রাসের চক্রে ঢুকেছে, অর্থাৎ ডিফ্লেশন হচ্ছে দেশটিতে (মাইনাস ২ শতাংশ)।
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের কাছাকাছি। দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে এ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এত দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। বাজেটের একটি অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা। কিন্তু বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে আসছে না। এবারের অন্তর্বর্তী সরকার বাজেটে যে নীতিমালা ঘোষিত হয়েছে তাতে কী, আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতি কমবে কি? এ প্রশ্ন সাধারণ জনগণের। প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য বেশকিছু নীতিমালা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা আশা করি, মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য বাজেট পাসের আগে আরো কিছু নীতিমালা নেয়া যেতে পারে। বিশেষ করে করহার হ্রাসের মাধ্যমে এটা করা যায়।
দারিদ্র্যের হার কি কমছে
বাজেটের আর একটি লক্ষ্যমাত্রা থাকে দেশের দারিদ্র্য হার কমিয়ে আনা। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো দারিদ্রের হার ২০ শতাংশের বেশি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, অতি দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়েছে। বলা হচ্ছে এটা ২০২৫ সালে ৯ দশমিক ৩ শতাংশে উঠবে। জাতীয় দারিদ্র্য হার গত বছরে ছিল সাড়ে ২০ শতাংশ। ২০২৫ সালে তা বেড়ে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৪ কোটি ১৭ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছেন। তাদের মধ্যে ৬ দশমিক ৫ শতাংশের অবস্থা গুরুতর।
কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশে দারিদ্র্য হার আরো অনেক বেশি। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের টেবিল মেকিং তথ্য-উপাত্ত দিয়েই এখনো চলছে। তাই বিগত সরকারের তথ্য-উপাত্তের ওপর নির্ভর করার কোনো সুযোগ নেই। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনাসহ দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যেই বাজেটে একটি উন্নয়ন বাজেট ঘোষণা করা হয়ে থাকে। এবারের বাজেটেও দুই লাখ কোটি টাকারও বেশি উন্নয়ন বাজেট করা হয়েছে। বিগত বছরও এটা আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি ছিল। কিন্তু এ উন্নয়ন বাজেট কি সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কোনো কাজে আসছে। বরং প্রতি বছরই উন্নয়ন বাজেটের যে টাকা বরাদ্দ হয়, তার একটি অংশ ব্যয়ই হয় না। তার কারণ কী। রাষ্ট্রের যে নির্বাহী বিভাগ রয়েছে, তাদের ওপর দায়িত্ব উন্নয়ন বাজেটের বরাদ্দকৃত টাকা খরচ করা। কিন্তু নির্বাহী বিভাগ কোনো বছরই উন্নয়ন বরাদ্দের পুরো টাকা খরচ করতে পারে না। অথচ কোনো বছরই শোনা যায়নি বাজেটের অনুন্নয়ন বাজেট খরচ হয়নি। অনুন্নয়ন বাজেটের মধ্যে সিংহভাগ হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা। সেই বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা, তার প্রক্রিয়া করা উঠানো ও প্রদান করার ব্যাপারে নির্বাহী কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। কিন্তু উন্নয়ন বাজেটের অর্থ নির্ধারণ, বরাদ্দ প্রদান, অর্থছাড় ইত্যাদি কাজে দায়িত্বে অবহেলার কারণে প্রতি বছরই অর্থ অব্যবহৃত থেকে যায় বলে সরকারের তথ্য-উপাত্তে জানা যায়। প্রতি বছরই যদি উন্নয়ন বাজেটের টাকাটা সঠিকভাবে যথাযথ স্থানে ব্যবহার করা যেত, তাহলে দেশের দারিদ্র্য হার এ পরিমাণ থাকত না। বরং প্রতি বছরই কমে আসার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বিগত ৫৪ বছরে ৫৪টি বাজেট ঘোষণা ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে অথচ এখনো বাংলাদেশের দারিদ্র্য হার ২০ শতাংশের নিচে এলো না।
বাজেট প্রতিক্রিয়ায় বগুড়া সাতমাথা পত্রিকার বার্তা সম্পাদক এফ শাহজাহান বলেছেন, বাজেটের বরাদ্দ ওপর থেকে ফিল্টারিং হতে হতে তৃণমূলে এসে যতটুকু পড়ে, তাতে স্থানীয় জনিপ্রতিনিধিদের ভাগ্যোন্নয়ন কিছুটা হলেও মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখে না। মুজাফফর হোসেন নামে এক নাগরিক বাজেট নিয়ে এক মন্তব্যে বলেছেন, এরচেয়ে কম টাকার বাজেট হলেও জনসাধারণের কল্যাণ হবে যদি নেতৃত্ব ও কর্মচারী সৎ হয়।
বাংলাদেশে ফি বছরই বাজেট হয়, তাতে কি সাধারণ মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরে বা সাধারণ মানুষের উন্নয়ন হচ্ছে, এ প্রশ্নটা সাধারণ মানুষের। কিন্তু রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষ থেকে তার ইতিবাচক কোনো উত্তর হবে না। বরং সাধারণ মানুষের আক্ষেপ হচ্ছে বাজেটের অনুন্নয়ন বরাদ্দের সবটুকু ব্যয় হয়, কিন্তু উন্নয়ন বাজেটের বরাদ্দকৃত অর্থের অনেক টাকা ফেরত যায়। তার প্রেক্ষিতে বলা যায়, তাহলে প্রতি বছরের বাজেটের নির্বাহী বিভাগ তথা রাষ্ট্র ও সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার বরাদ্দটা ঠিকই ব্যয় হয়। তাই কথাটা তিক্ত হলেও বলতে হয়, বাংলাদেশে বাজেট দেয়ার মূল লক্ষ্যটা কি শুধু বেতন-ভাতা পরিশোধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, দেশের উন্নয়ন, বেকারত্ব হ্রাস, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা এবং দরিদ্রতা হ্রাসের লক্ষ্যে যে বাজেট ঘোষণা করা হয়, তার প্রতিফলন কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় না।
আমরা আশা করি, বর্তমান সরকার সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে আরো জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব হ্রাস ও মধ্যবিত্তের জীবনমানের উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি হ্রাসেও যথাযথ নীতিমালা ও কর্মসূচি গ্রহণ করবে। বিশেষ করে দরিদ্র ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর খেয়ে পড়ে থাকার জন্য বর্তমান বাজেটে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আর তখনই প্রতি বছরে বিশাল অংকের বাজেট প্রণয়ন ও ঘোষণা সার্থক হবে।