রি-ট্রায়াল ন্যায়বিচারের দাবি
৪ জুন ২০২৫ ১১:০৫
॥ জামশেদ মেহদী॥
কথায় আছে, পাতিলের একটি ভাত টিপলে বোঝা যায় যে আর সব ভাত সেদ্ধ হয়েছে কিনা। জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম বেকসুর খালাস পাওয়ার রায়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ বিচারপতিগণ যে রায় বা অবজারভেশন দিয়েছেন, সেই অবজারভেশন থেকেই বোঝা গেছে যে, এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের নামে যে মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, সেগুলোও ছিল মিসক্যারেজ অব জাস্টিস। অর্থাৎ বিচারের নামে বিরাট তামাশা এবং তামাশার মাধ্যমে আগে থেকে নির্ধারণ করা রায়ে ঠাণ্ডামাথায় তাদের হত্যা করা হয়েছে। এককথায় তারা জুডিশিয়াল কিলিংয়ের শিকার হয়েছেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, অতীতের রায়ে বাংলাদেশসহ এ ভারতীয় সাব-কন্টিনেন্টে ক্রিমিনাল বিচার ব্যবস্থার পদ্ধতি চেঞ্জ করে দেয়া হয়েছিল, এটা ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। আদালতের সামনে উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণ অ্যাসেসমেন্ট করা ছাড়াই এটিএম আজহারুল ইসলাম সাহেবকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি Travesty of truth, অর্থাৎ বিচারের নামে অবিচার। যেসব তথ্য-প্রমাণ আদালতে হাজির করা হয়েছিল, অতীতের আপিল বিভাগ তা সঠিকভাবে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
রায়ে আপিল বিভাগ বলেছেন, বস্তুগত প্রমাণ এবং পেশ করা আইনি যুক্তিতর্ক পুঙ্খানুপুঙ্খ পুনর্মূল্যায়নের পর আপিল বিভাগ বিবেচনা করছে যে, এটিএম আজহারুল ইসলামকে দোষী সাব্যস্ত করা ছিল ফৌজদারি আইনশাস্ত্রের মৌলিক নীতিগুলোর প্রতি স্পষ্ট অবজ্ঞা, যার ফলে ন্যায়বিচারের চরম অবহেলা ঘটেছে।
এছাড়া এটিএম আজহারুল ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ সম্পর্কিত প্রমাণ সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে তার পূর্বের ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন আপিল বিভাগ। এ মৌলিক নীতিগুলো মেনে চলতে ব্যর্থতার ফলে ন্যায়বিচারের প্রতি চরম অবজ্ঞা করা হয়েছে।
আপিল বিভাগ বলেন, আদালত গভীর দুঃখের সাথে স্বীকার করেন যে, তার পূর্ববর্তী রায়ে তারা এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ ও তাকে দোষী হিসেবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আপিল বিভাগের পূর্ববর্তী রায়টি দুঃখজনকভাবে এত গুরুতর প্রকৃতির ফৌজদারি কার্যধারায় যাচাই-বাছাই করা হয়নি এবং ইনসাফের উচ্চমান পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আদালত বলেন, আপিল বিভাগ আরও দুঃখের সাথে স্বীকার করেন যে, আগের রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের বৃহত্তর প্রেক্ষাপট এবং রাষ্ট্রপক্ষের মামলার অন্তর্নিহিত দুর্বলতাসমূহ প্রমাণের বিষয়টি সিরিয়াসলি বিবেচনা করা হয়নি। তাই ন্যায়বিচারের স্বার্থে এটিএম আজহারুল ইসলামকে দোষী সাব্যস্তকরণ এবং তার সাজা বহাল রাখা সম্ভব নয়।
ইতোপূর্বে জামায়াতের ৫ জন এবং বিএনপির এক জনসহ ছয় শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এছাড়া অন্তত পাঁচজন জেলে মৃত্যুবরণ করেছেন। দুনিয়ার ইতিহাসে এটা নজিরবিহীন নির্যাতনের শামিল। এটিএম আজহারুল ইসলাম সৌভাগ্যবান, বিলম্বে হলেও তিনি ন্যায়বিচার পেয়েছেন, আল্লাহ তায়ালা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন বলে। আমরা মনে করি, এ রায়ের মাধ্যমে সিন্ডিকেটেড ইনজাস্টিসের অবসান হয়েছে। আমরা এটাও মনে করি, এ রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আদালতের মর্যাদা সমুন্নত হয়েছে। আমরা মনে করি, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অতীতের অনেক রায় সম্পর্কে এ রায়ে অনেক পর্যবেক্ষণ থাকবে। সরকারের উচিত হবে- এ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর একটা রিভিউ বোর্ড গঠন করে অতীতের রায়গুলোকে পুনর্বিবেচনা করা, যেন মৃত্যু-পরবর্তীতে হলেও যাদের সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে, অবিচার করা হয়েছে, তাদের পরিবার, তাদের দল এবং এদেশের মানুষ যেন ন্যায়বিচার পেতে পারে।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে তার করা রিভিউ সর্বসম্মতিতে মঞ্জুর করেছেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এটিএম আজহারকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় এবং মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে এর আগে আপিল বিভাগের দেওয়া রায় বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে উক্ত রায়ে। এ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টির কৃতিত্ব জুলাই গণআন্দোলনের অকুতোভয় ছত্র-জনতা এবং তাদের নেতাদের। এ সুযোগকে রক্ষা করার দায়িত্ব এখন আমাদের সবার।
সুপ্রিম কোর্টের অবজারভেশন প্রায় হুবহু তুলে দিতে হলো। কারণ এর মাধ্যমে এটি প্রমাণ হলো যে, অতীতে জামায়াতের সাবেক আমীর মাওলানা শহীদ মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা ও শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, এবং সাবেক নির্বাহী পরিষদ সদস্য শহীদ মীর কাসেম আলী এবং বিএনপির সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ যে ৬ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, সেগুলো ছিল স্রেফ হত্যাকাণ্ড। একটি স্বাধীন দেশে গণতন্ত্রের দাবিদার সরকারের আমলে এমন বিচারিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সমসাময়িক ইতিহাসে নেই।
॥দুই॥
এ মামলার রায়ের পর বিএনপির তরফ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। অথচ সেই ২০১৩ সালেই বিএনপি জাতির কাছে ওয়াদা করেছিল যে, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপরাধের বিচার পুনর্বিবেচনা করবে। এ সম্পর্কে ‘দৈনিক জনকণ্ঠে’ ২০১৩ সালের ২৭ জুলাই প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম, ‘বিএনপি ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপরাধী বিচার পুনর্বিবেচনা করবে’। রিপোর্টে বলা হয়, ‘বর্তমান সরকারের আমলে (আওয়ামী লীগ সরকার) যে বিচার হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখার পাশাপাশি সরকারি দলের মধ্যেও কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তাদেরও বিচারের আওতায় আনবে। আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যুদ্ধাপরাধের বিচার করছে বলেও বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। বিএনপির (তৎকালীন) স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ (বর্তমানে মরহুম) দলের কোনো কোনো নেতা বিভিন্ন সভা সমাবেশ প্রকাশ্যেই বলে আসছেন, বিএনপি যুদ্ধাপরাধের বিচার চায়। তবে এ বিচার হতে হবে স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিচার করছে। এছাড়া সরকারি দলের লোকদের এ বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না। তাই বিএনপি ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপরাধের বিচার পুনর্বিবেচনা করা হবে।’ জনকণ্ঠের ঐ রিপোর্টে বলা হয়, ‘অন্যদিকে বিএনপির সংসদীয় দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকও এক অনুষ্ঠানে যুদ্ধাপরাধ বিচারে শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হবে বলে ঘোষণা করেন।’
২০১৩ সালের পর আজ ২০২৫ সালের জুন মাস। প্রায় ১৩ বছর পর এটিএম আজহারুল ইসলাম বেকসুর খালাস পেলেন। সেই সাথে খালাসের স্বপক্ষে সুপ্রিম কোর্ট যে একাধিক অবজারভেশন দিয়েছেন, তারপর বিএনপি কী করবে? বিএনপি নেতারা দাবি করছেন, যদি ডিসেম্বরে নির্বাচন হয়, তাহলে তারা দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন পেয়ে সরকার গঠন করবে। আগামী নির্বাচনে কোন দলের কী অবস্থা হবে, সেটি একমাত্র ভবিষ্যৎই বলতে পারে। তবে তর্কের ছলে ধরে নিচ্ছি যে, আগামীতে বিএনপি সরকার গঠন করছে। তাহলে কি তারা অতীতের বিচারিক প্রহসন, যার মাধ্যমে অন্য নেতাদের হত্যা করা হয়েছে, তার কি রি-ট্রায়াল বা পুনর্বিচার করবে?
॥তিন॥
অতীতের কথা আর বেশি বলব না। শুধু কয়েকটি গ্রস ইনজাস্টিসের উদাহরণ দেব। একজন হলেন শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা। বিচারিক আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। এ কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে শাহবাগে তৈরি করা হয় গণজাগরণ মঞ্চ। সেই গণজাগরণ মঞ্চে আওয়াজ তোলা হয়, কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই। তাদের দাবি মোতাবেক শেখ হাসিনার সাজানো রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট নতুন করে আইন করে যেখানে পূর্বের আইন সংশোধন করে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়। এরপর উচ্চ আদালতে নতুন আইনে জামায়াতের তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
যদি কোনো নতুন আইন প্রণীত হয়, তাহলে সেই আইন যেদিন থেকে কার্যকর হয়, সেদিন থেকে আসামির সেই আইনে বিচার করা যায়। কিন্তু কোনো আসামিকে আইনের ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতার মাধ্যমে (Retrospective effect) বিচার করা যায় না। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একটি নজিরও নেই। এভাবে রাজপথে বা জনসভার দাবি মোতাবেক বিচারের রায় প্রদানের ইতিহাস পৃথিবীতে এ প্রতিবেদকের জানা মতে এটিই প্রথম।
॥চার॥
অনেক উদাহরণই রয়েছে। মাত্র সাড়ে ১৮ বছর বয়সে একজন আইএ ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র জামায়াতের আরেক নেতা শহীদ কামারুজ্জামান কীভাবে জেলা মার্শাল ল’ অথরিটিকে ৪০-৫০ ব্যক্তিকে হত্যা করার কমান্ড দিতে পারেন? তিনি কোনো হিন্দু নেতাকে হত্যা করেননি। এ বক্তব্য প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ঐসময় শেরপুর থানার সবচেয়ে প্রভাবশালী হিন্দুর কন্যা মিনা ঢাকার উদ্দেশে নিউইয়র্ক থেকে রওনা হন। এখন তার নাম মিনা ফারাহ। কিন্তু তাকে লন্ডনে থামিয়ে দেয় শেখ হাসিনার গোয়েন্দা বাহিনী।
আল্লামা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আসা সুখরঞ্জন বালিকে হাসিনার গোয়েন্দারা আদালত প্রাঙ্গণ থেকে উঠিয়ে নেয়। পরবর্তীতে ড. কামাল হোসেনের জামাতা ডেভিড বার্গম্যান তাকে কলকাতার একটি জেলে আবিষ্কার করেন। এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামিক স্কলার আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী বিনা চিকিৎসায় কারাগারে ইন্তেকাল করেন।
অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে হওয়ায় ব্রিগেডিয়ার (অব.) আমান আযমী এবং শহীদ মীর কাসেম আলীর ছেলে হওয়ায় ব্যারিস্টার আরমানকে ৮ বছর আয়নাঘরে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। শেখ হাসিনার পিশাচিনী মন-মানসিকতার শিকার হয়েছেন অসংখ্য জামায়াত ও শিবির নেতা।
এটিএম আজহার খালাস মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণের আলোকে সচেতন জনগণ মনে করেন, এসব সিন্ডিকেটেড ইনজাস্টিসের পুনর্বিবেচনা করতে অবিলম্বে রিভিউ বোর্ড গঠন করা দরকার। যারা অবিচারের শিকার হয়েছেন, তাদের পরিবার এ ট্র্যাভেস্টি অব জাস্টিসের প্রতিকার চেয়ে আইনের শরণাপন্ন হন। উচ্চতর আদালত তাদের ন্যায়বিচার প্রদান করার জন্য রি-ট্র্যায়ালের ব্যবস্থা করুন। আর আইনজীবীরা বিনাপারিশ্রমিকে বা নামমাত্র পারিশ্রমিকে তাদের মামলা লড়ুন।
মরণোত্তর ন্যায়বিচার হলো আজ আইনের শাসন এবং ইনসাফের দাবি।