উপদেষ্টাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব : কি ব্রেইন গেইন
২২ মে ২০২৫ ১৬:৩২
॥ হারুন ইবনে শাহাদাত ॥
দেশ এখন দ্বৈত নাগরিকরা পরিচালনা করছেন- এমন একটি বিতর্ক তৈরি হয়েছে। যদিও রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ। ভার্চুয়াল ফিল্ডেও তারা নিষিদ্ধ। তারপরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা জোরেশোরে বিভিন্ন জনের নাম উল্লেখ করে প্রচার করছে- “যারা এখন দেশ চালাচ্ছেন তাদের একটি বড় অংশের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে। দ্বৈত নাগরিকদের সাংবিধানিক কোনো পদে থাকার অধিকার নেই।” এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই, দেশপ্রেমিকরা দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন না। তারা দেশ ছেড়ে সহজে পালানও না। দেশের সংবিধানেও দ্বৈত নাগরিকদের সাংবিধানিক কোনো পদে না রাখার বিধান আছে। তাই সংগতকারণেই এ বিতর্কের সমাধান জরুরি। বিশেষ করে যখন আওয়ামী লীগের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গণ্ডি পেরিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক মাঠেও বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে।
গত ১৭ মে শনিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এ অভিযোগের একদিন পর ১৮ মে রোববার ড. খলিলুর রহমান সালাহউদ্দিন আহমেদের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বলেন, আমি একজন বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে আমার অধিকার পূর্ণমাত্রায় প্রয়োগ করতে প্রস্তুত। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ড. খলিল আরো বলেন, অভিযোগ প্রমাণের ভার সেই ব্যক্তির ওপর বর্তায়, যিনি এটি প্রচার করেছেন। প্রয়োজনে এটি আদালতের সামনে প্রমাণ করতে হবে। এরপর আর কী বলার আছে। এছাড়াও আওয়ামী ঘরানার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও মুক্তিবার্তা৭১ ডটকম নামের একটি নিউজ পোর্টালে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ৫ উপদেষ্টা, উপদেষ্টাদের ৬ সহকারী, সংস্কার কমিশনের ৫ সদস্য এবং বিভিন্ন পর্যায়ের সচিব মর্যাদার ৭ জনের নাম উল্লেখ করে দাবি করা হয়েছে, তাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যারা অভিযোগ করেছেন, প্রমাণ করার দায়িত্ব তাদেরই। এদের মধ্যে কয়েকজন তাদের ভিত্তিহীন অভিযোগ করায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার কথাও বলেছেন। পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের অংশ হিসেবে এমন প্রচারণা আওয়ামী লীগের চক্রান্ত। ফ্যাসিস্ট সরকারের অত্যাচার-নির্যাতন এবং মেধার অবমূল্যায়নের কারণে অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। সেই ব্রেইন ড্রেন (ইৎধরহ ফৎধরহ)কে ব্রেইন গেইন (ইৎধরহ এধরহ)-এ পরিণত করার অংশ হিসেবে ড. ইউনূসের সরকার মেধাবীদের দেশে ফিরিয়ে এনে দেশের উন্নয়নের কাজে লাগালে ক্ষতি কি? তাদের কেউ যদি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে বিদেশি নাগরিকত্ব নিয়ে থাকেন, প্রয়োজনে এখন তা ত্যাগ করবেন। দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধের দিন আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ও তো বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করে আমেরিকার নাগরিকত্বের শপথ নিয়েছেন।
ব্রেইন ড্রেন, ব্রেইন গেইন কেন
কোনো দেশ থেকে যখন মেধাবীরা বিদেশে চলে যায়, এটি মেধা পাচার বা ব্রেইন ড্রেন। অর্থ পাচারের চেয়েও এটি দেশ-জাতির জন্য ক্ষতিকর। এ মেধাবীদের উন্নত দেশ গ্রহণ করে তাদের দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে ব্রেইন গেইন হিসেবে। পৃথিবীতে ব্রেইন ড্রেন, ব্রেইন গেইনের এ প্রতিযোগিতা চলছে প্রাচীনকাল থেকে। পারস্য আক্রমণ করে দুর্ধর্ষ মঙ্গল যোদ্ধা সম্রাট হালাকু খাঁ ২০ হাজারের বেশি মানুষ হত্যা করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন পারস্যের প্রতিভাবান দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ খাজা নাসিরুদ্দিন তুসিকে হালাকু খাঁ সপরিবারে ধরে নিয়ে গিয়ে নিজ দরবারের মন্ত্রীর মর্যাদায় পরামর্শক নিয়োগ করেছিলেন। আমেরিকাও আজ একই কাজ করে। সারা পৃথিবী থেকে মেধাবীদের বৃত্তি, নাগরিকত্ব দিয়ে তার দেশে নিয়ে কাজে লাগায়। হালাকু খাঁ প্রসঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাস বইয়ে জর্জ সার্টন লিখেছেন, খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি হালাকু খাঁর ওপর গভীর প্রভাব রেখেছিলেন। হালাকু সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই তুসির সঙ্গে শলাপরামর্শ করতেন। কারণ হালাকু খাঁ নানা বিষয়ে তুসির ব্যাপক পাণ্ডিত্য সম্পর্কে সচেতন ছিল। ড. ইউনূস দেশের লুট হয়ে যাওয়া ব্রেইনগুলোকে উদ্ধার করে দেশের কাজে লাগাতে পারলে ক্ষতি কি?
৩৬ জুলাই বিপ্লবের পর দেশ চালাচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। যারা সরকারে আছেন, তারা কেউ কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে নেই। হাসিনার ফাসিস্ট রাজত্বের পতনের পর রাজনৈতিক দলগুলো আশা করেছিল, দেশ পরিচালনার ভার আসবে তাদের হাতে। বিশেষ করে দেশের আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে বিএনপির নামই প্রথম আসে। তারা ধরেই নিয়েছেÑ অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের শূন্যস্থান তারাই পূর্ণ করবে। হাসিনার পতনের পর অন্যান্য দলের ‘জাতীয় সরকার’ প্রতিষ্ঠার দাবি তারা বার বার উপেক্ষা করেছে। তারা ক্ষমতায় কাউকে ভাগ দিতে রাজি নয়। কিন্তু সমস্যা হলো, ৩৬ জুলাইয়ে বিপ্লবীদের প্রধান দাবি ছিল, হত্যা, সন্ত্রাস, ঘুষ, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, দুর্নীতি ও বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের যে স্বপ্ন নিয়ে তারা রক্ত দিয়ে দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছে। কিন্তু অনেক সেই স্বপ্নের বিপরীত তৎপরতা শুরু করে একটি গোষ্ঠী। তারা দেশের সবচেয়ে বড় একটি রাজনৈতিক দলের ব্যানার ব্যবহার করে আওয়ামী ফ্যাসিস্টের শেখানো রাজনীতির নামে দুর্বৃত্তপনা শুরু করে কোনো প্রকার রাখডাক না রেখেই। আওয়ামী লীগের চাইতেও কয়েকগুণ বেগে অনেক ক্ষুধা নিয়ে জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভাবখানা এমন, দেশের ক্ষমতা এখন তাদের হাতে। মানে দেশটা এখন তাদের। আর ঠেকায় কে? বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে বার বার সতর্কবার্তা এবং শাস্তি ঘোষণায় স্বার্থান্বেষী সেই গোষ্ঠী, কিছুটা পিছিয়েছে, তবে পালায়নি, সুযোগের সন্ধানে অপেক্ষা করছে। তাদের এ অপকর্মের কারণে রাষ্ট্র সংস্কারের জনতার দাবি আরো জোরালো হয়। তারা ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবং হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর তার দেখানো পথে যারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, তাদের বিচার দাবি করছে। রাষ্ট্র সংস্কার ও ফ্যাসিস্টদের বিচারের আগে জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো- যাদের লক্ষ্যই হলো ক্ষমতা, তারা বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারছে না। নির্বাচনের দাবি আদায়ে হুমকি দিচ্ছে।
একটি সূত্রে প্রকাশ, পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার অভিযানের পর পাচারকারী ফ্যাসিবাদের দোসর ব্যবসায়ী এবং আমলারা রাজনৈতিক দলগুলোকে চাপ দিচ্ছে ইউনূসের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করতে। এমনকি তারা হাসিনার সাথে যোগাযোগ করছে দ্রুত নির্বাচনের দাবি আদায়ে হরতালের মতো কর্মসূচি দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতে। হাসিনা সরকারের ডামি নির্বাচনের এক বছর শেষ হওয়ার আগেই পতন হয়েছে। এ হিসেবেও কমপক্ষে চার বছর ধৈর্য ধরা উচিত বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। সংস্কার ও ফ্যাসিস্টদের বিচারের আগে এ সরকার চলে যাক, তা অধিকাংশ জনগণ এবং রাজনৈতিক দল চায় না। ভারত, আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের দোসররা দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করে রাখায় সঠিক গতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাজ করতে পারছে না। এমন অবস্থায় দ্বৈত নাগরিকত্ব বিতর্ক সরকারকে নতুন করে সংকটে ফেলবে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। তাই বিষয়টি হালকাভাবে নেয়া ঠিক হবে না। এ সরকার বিপ্লবী সরকার হলে কোনো কথা ছিল না। না বিপ্লবী না সাংবিধানিক- এমন দ্বৈত অবস্থার কারণেই দ্বৈত নাগরিক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, সংবিধান কী বলে?
সংবিধান কী বলে
এ কথা সবাই স্বীকার করেন, আমলা ও রাজনৈতিক নেতারা দ্বৈত নাগরিক হলে তা দেশের জন্য ক্ষতিকর। কারণ এ নাগরিকত্বের সুযোগ নিয়ে তারা অর্থ পাচারসহ নানা অপরাধ আড়াল করতে পারে। সাধারণ নাগরিকরা অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে তেমন ক্ষতির আশঙ্কা নেই। বরং দেশ অনেক ক্ষেত্রে লাভবান হয়। দেশে দ্বৈত নাগরিক ও দ্বৈত পাসপোর্টধারীর সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৩১ জন আছে বলে ২০২১ সালের এক হিসাবে জানা গেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশের নাগরিকরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব অব্যাহত রাখার পাশাপাশি পৃথিবীর মোট ১০১টি দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারবেন। অর্থাৎ বাংলাদেশের নাগরিকরা বাংলাদেশের পাসপোর্ট রাখার পাশাপাশি আরও ১০১টি দেশের মধ্য থেকে যেকোনো দেশের পাসপোর্ট বহন করতে পারবেন।
সংবিধানের প্রথমভাগে (অনুচ্ছেদ ৬-এর ১) ‘নাগরিকত্ব’ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের নাগরিকত্বের বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে সংবিধানের পঞ্চম ভাগের ‘আইনসভা’-বিষয়ক অনুচ্ছেদে। এমপি নির্বাচনে ‘যোগ্যতা ও অযোগ্যতা’ বিষয়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৬ (২) এর (গ) তে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি (২) কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি ওই ব্যক্তি বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন। নির্বাচিত সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় সংবিধানের এ অনুচ্ছেদ রাখা হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের বিষয়ে স্পষ্ট কিছু নেই সংবিধানে। পর্যবেক্ষকদের অভিমত বিশ্ব নাগরিক বিবেচনায় গ্লোবাল ভিলেজে কেউ দ্বৈত নাগরিক হতে চাইলে দেশের স্বার্থ ঠিক রেখে সে সুযোগ দেওয়া উচিত, যা বাংলাদেশ ‘নাগরিকত্ব আইন-২০১৬’ বিলের মাধ্যমেও অনুমোদিত। দ্বৈত নাগরিকরা উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারও দেশে প্রয়োগ করতে পারবেন এবং দেশের বিভিন্ন প্রযুক্তিনির্ভর খাতে প্রযুক্তির ব্যবহারে দিকনির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি বিনিয়োগ করার লক্ষ্যেও আকৃষ্ট হবেন। একই সাথে দেশের সঙ্গে তাদের নিবিড় সম্পর্ক হতে পারে দেশকে প্রযুক্তি ও জ্ঞানে আরো সমৃদ্ধ করতে। তবে দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণকারী বেশিরভাগ নাগরিকই কীভাবে একই সঙ্গে নতুন নাগরিকত্ব পাওয়া দেশের পাসপোর্ট ও বাংলাদেশের পাসপোর্ট অব্যাহত রাখবেন কিংবা কীভাবে বাংলাদেশে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন, সে বিষয়ে অসচেতন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। বিতর্ক বন্ধে উল্লেখিত বিষয়গুলো পরিষ্কার করা সরকারের দায়িত্ব।