সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করলে মৃত্যু
১৫ মে ২০২৫ ১৫:২২
॥ হামিম উল কবির ॥
পেটের প্রদাহ থেকে হতে পারে ভয়ঙ্কর রোগ। এ সময় খুবই সাধারণ কিছু লক্ষণ দেখা দেয়, অবহেলা করলে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি। সঠিক সময়ে চিকিৎসকের কাছে যেতে পারলে সুস্থ হয়ে যেতে পারে রোগীরা। সঠিক চিকিৎসা না হলে পরে চিকিৎসা ব্যয়বহুল হয়ে যায়। চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে দেরি করে ফেললে তা থেকেই ক্যানসার, খাদ্যনালি চিকন হওয়া, খাদ্যনালি ফুটো হয়ে যাওয়ার মতো জটিল রোগের সৃষ্টি হতে পারে। হতে পারে রক্তবমি, পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়ার মতো জটিল উপসর্গ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ জটিল রোগটি হতে পারে পেটের প্রদাহজনিত রোগ বা ইনফ্লেমেটরি বাওয়েল ডিজিজের (আইবিডি)। বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (সাবেক পিজি হাসপাতাল) গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজির সহযোগী অধ্যাপক ডা. এবিএম ছফিউল্লাহ বলেন, এ রোগটি পরিপাক বা গ্যাস্ট্রো ইন্টেসটিনাল (জিআই) ট্র্যাক্টের একটি দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধি। এ রোগকে প্রদাহের বা ফোলার পর্যায়গুলোর মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়। রোগটি সারা জীবন ধরে রোগীকে বয়ে বেড়াতে হয়। এটি এমনই এক জটিল রোগ যে, একবার শরীরে বাসা বাঁধলে তা থেকে মুক্তি পাওয়া বিরল ঘটনা। এ রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি অনেকটাই ব্যয়বহুল। রোগটি হলে দ্রুতই শরীরের ওজন কমে যায়। বিশ্বে প্রতি এক লাখ মানুষের ৪১০ জন ক্রোনস ডিজিজ এবং প্রতি এক লাখ মানুষের ৪১৪ জন আলসারেটিভ কোলাইটিস রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশেও প্রচুর রোগী রয়েছে, কিন্তু সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সঠিকভাবে শনাক্ত না হলে রোগীরা অনেক সময় অপচিকিৎসার শিকার হয়।
দুই ধরনের আইবিডি
দুই ধরনের আইবিডি রোগ শনাক্ত হয়েছে। একটি হলো আলসারেটিভ কোলাইটিস। এটি প্রধানত বৃহদন্ত্রে আলসার তৈরি করে। অন্যটির নাম ক্রনস ডিজিজ। এটা হলে মুখ থেকে পায়ুপথ পর্যন্ত পরিপাকতন্ত্রের যেকোনো অংশ আক্রান্ত হতে পারে। আইবিডির দুই ধরনেই পেটে কিংবা মলদ্বারে ব্যথা, ডায়রিয়া, মলের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, মৃদু জ্বর, ক্লান্তি ভাব, মুখে ঘা, গিরা ফোলা, খাবারে অরুচি ও ওজন কমে যেতে পারে। ক্রোনস ডিজিজের প্রদাহ অন্ত্রের পুরো প্রাচীরের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ক্রোনস ডিজিজের মারাত্মক পর্যায়ে রোগীর পায়খানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে না পারলে জীবন সংকটাপন্ন হয়ে উঠতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। রোগটি সারা দিনে ৩০ থেকে ৫০ বার টয়লেটে যেতে হয়। সেইসঙ্গে থাকে বমিভাব, খাবারে অরুচি। খাবার গ্রহণের অভাবে শরীর দুর্বল হওয়ার কারণে হাঁটতে-চলতে সমস্যা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হয়। আইবিডিতে যেকোনো বয়সের মানুষই আক্রান্ত হতে পারেন। তবে তরুণদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। রোগটির প্রকৃত কারণ এখনো অজানা। বংশগত বা জেনেটিক কারণে কেউ কেউ এ রোগের ভুগতে পারেন। আবার ভাজাপোড়া, উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার, জাঙ্কফুড, ফার্স্টফুড, ধূমপান, মদ্যপান আইবিডিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্পূর্ণ নিরাময় না হলেও আগে-ভাগে রোগ শনাক্ত ও সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে আইবিডি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। কিন্তু অবহেলায় ডেকে আনতে পারে ক্যানসার। ডা. এবিএম ছফিউল্লাহ বলেন, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, ব্লাডপ্রেশারের মতো এ রোগটিকেও নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা যায়। অবশ্যই সঠিক সময়ে চিকিৎসাটি নিতে হবে। পেটে ব্যথা, খাবারে অরুচি কিংবা ওজন কমে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো কেউ কেউ উপেক্ষা করে থাকেন, এটা ঠিক নয়। অনেক ক্ষেত্রে এ অবহেলাই ডেকে আনতে পারে বড় বিপদ। রোগটি সম্পূর্ণ নিরাময় না হওয়ার কারণে সারা জীবন এ রোগের ব্যয়ভার বহন করতে করতে রোগী অথবা পরিবার আর্থিক সংকটে পড়তে পারে। আইবিডির ঝুঁকি এড়াতে শাকসবজি, ফলমূল, সুষম খাবার ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে বসবাস, নিয়মিত ব্যায়ামের ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সেইসঙ্গে সর্বস্তরের মধ্যে জনসচেতনতাই এ রোগ প্রতিহত করতে পারে বলে মনে করেন তারা।
কিছু ভাইরাসের কারণে রোগটি হয়
আইবিডি প্রাপ্তবয়স্কদের নোরো ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে। শিশুদের মধ্যে হয়ে থাকে রোটা ভাইরাসের কারণে। ৩ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে হয়ে থাকে অ্যাস্ট্রো ভাইরাসের কারণে এবং আইবিডির কারণে শ্বাসকষ্ট হলে তা হয়ে থাকে অ্যাডেনো ভাইরাসের কারণে। কিছু কারণ লক্ষণগুলোকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। এগুলো হলো- স্ট্রেস, ডায়েট, কয়েক ধরনের ওষুধ এবং লাগাতার সংক্রমণ। সুষম খাদ্য খাওয়া, হাইড্রেটেড (পর্যাপ্ত পানি পান করা) থাকা, নিয়মিত ব্যায়াম করা, স্ট্রেস লেভেল জেনে রাখা এবং চিকিৎসা নিতে পারলে এ জটিল রোগটি থেকে মুক্ত থাকা যায় বলে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
রোগ নির্ণয়
রোগের উপসর্গ ও ইতিহাস সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হলে কিছু রক্ত পরীক্ষা যেমন রক্তের সিবিসি, ইএসআর, সিআরপি, অ্যালবুমিন ইত্যাদি পরীক্ষা করে রোগটি নির্ণয় করা যায়। মলের কিছু পরীক্ষা যেমন ক্যালপ্রোটেকটিন, কোলনোস্কপি, আইলিওস্কোপি, অ্যান্টেরোস্কোপি, টিস্যু বায়োপসি পরীক্ষা, বেরিয়াম এক্স-রে, এমআর অ্যান্টারোগ্রাফি ইত্যাদি পরীক্ষা করে রোগটি শনাক্ত কর যায়। আবার কখনো কখনো সার্জারির পর টিস্যু পরীক্ষার মাধ্যমে ক্রোনস ডিজিজ ধরা পড়ে।
ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে সুস্থ থাকা
আপনার শরীরে ইমিউন সিস্টেমকে (রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা) শক্তিশালী করে রোগটি থেকে মুক্ত থাকা যায়। ব্যায়াম করবেন, কিন্তু একই সাথে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেবেন। বমি কিংবা ডায়রিয়া হলে যেটুকু তরল শরীর থেকে হারিয়ে যায় পূরণ করতে হবে। ইলেক্ট্রোলাইট (যেমন খাবার স্যালাইন) পান করা, পানি পান করা। অনেকেই পেটে তরল রাখতে পারেন না। এমন হলে বরফ টুকরো ধীরে ধরে চোষার চেষ্টা করা যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। অসুস্থতা দ্রুত সমাধান করতে প্রোবায়োটিক খাবার খাওয়া যেতে পারে। প্রোবায়োটিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে। চর্বিযুক্ত, চিনিযুক্ত বা ক্যাফেইন বা দুধের মতো খাবার এড়িয়ে চলুন। এগুলো ডায়রিয়া এবং বমিকে বাড়িয়ে দেয়। সহনীয় মাত্রায় সাধারণ খাবার খাওয়া যায়। তবে ক্ষুধা না থাকলে জোর করে খাওয়ার প্রয়োজন নেই। ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা হয়ে গেলে তৃষ্ণা ও প্রস্রাবের সময় পরিবর্তন হওয়া, দুর্বলতা অনুভব করা, মাথা ঘুরলে এবং মুখ শুষ্ক হয়ে গেলে বুঝতে হবে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিয়েছে।
তখন প্রয়োজনমতো পানি পান করতে হবে। এ রোগের উপসর্গ প্রদাহের মাত্রার ওপর নির্ভর করে স্পষ্ট হয়। শরীরে জ্বালাপোড়া বেশি হলে রোগটি সক্রিয় থাকে এবং জ্বালা কমে গেলে রোগটি মৃদু আকারে থাকে।
রোগটির ঝুঁকি
৩০ বছরের কমবয়সীরা রোগটিতে বেশি আক্রান্ত হয়। যদিও শ্বেতাঙ্গদের এ রোগের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি, তবে এটি যেকোনো জাতির হতে পারে, বাংলাদেশেও প্রচুর রয়েছে। এমন অনেককে খুঁজে পাওয়া যায়, যাদের কোনো ডায়াবেটিস নেই, কিন্তু দিন দিন ওজন কমে যায়। পঞ্চাশোর্ধ হলেও শরীরের ৫০ কেজির নিচে, হাড্ডি কঙ্কালসার। এ ধরনের লোকেরা সারা দিন ১০-১৫ বার টয়লেটে যাওয়ার অভ্যাস থাকলেও এটাকে খুবই স্বাভাবিক মনে করে। অনেকের এর চেয়ে বেশি সমস্যায় ভোগেন না বলে এরা এটাকে খুব বেশি সমস্যা মনে করেন না। এটা ছাড়াও বংশগত যেমন পিতা-মাতা, ভাই-বোন, নিজের শিশু যদি এ রোগে আক্রান্ত হয়, তাহলে আপনিও এ রোগের ঝুঁকির মধ্যে থাকতে পারেন। ধূমপান ক্রোনস আইবিডি আক্রান্তের ঝুঁকির অন্যতম কারণ। এর বাইরে যারা ননস্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ওষুধ বেশি বেশি সেবন করেন, তাদের মধ্যে রোগটি হয়ে থাকে। স্টেরয়েডের মধ্যে রয়েছে আইবুপ্রোফেন ও নেপ্রোক্সেন সোডিয়াম ও ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম ইত্যাদি। যারা আইবিডিতে আক্রান্ত, এ ওষুধগুলোর কারণে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। আবার বিপরীত কিছু ঘটে থাকে স্টেরয়েড সেবন করলে। এ ওষুধটি সেবন করলে রোগটির উপসর্গ কমে গিয়ে রোগটি নিয়ন্ত্রণে থাকে। তবে স্টেরয়েড নিজে নিজে সেবন করা মারাত্মক ঝুঁকি, অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে সেবন করতে হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।