সরষের মধ্যেই কি ভূত?
১ মে ২০২৫ ১৭:১১
॥ আহমদ হাসান ॥
বর্তমানে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনা করছে একটি অন্তর্বর্তী সরকার। আর ২২ উপদেষ্টা নিয়ে গঠিত হয়েছে এ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা থেকে উপদেষ্টারা এসেছেন। তাদের মধ্যে আছেন সাবেক আমলা, কূটনীতিক, পুলিশ কর্মকর্তা, আইনজীবী, শিক্ষক, এনজিও কর্মকর্তা এবং শিল্পপতি। তবে কোনো রাজনীতিক নেই। তাদের অধিকাংশই পেশাগত জীবনে সফল বলেই সবাই মনে করে এবং তাদেরও কেউ কেউ দাবি করেন সেই কথা। তারা অবশ্য জনগণের কাছে ভোট চেয়ে কোশেশ করে উপদেষ্টা হননি। তবে তাদের জোর করে এনে দায়িত্বও দেয়া হয়নি। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার গঠনকালে তাদের কাছে প্রস্তাব দেয়া হয় উপদেষ্টা পরিষদে তথা সরকারের দায়িত্ব নেয়ার জন্য, তখন তারা স্বেচ্ছায় সম্মতি দিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের যারা উপদেষ্টা, তাদের অধিকাংশের মধ্যে আরেকটি মিল রয়েছে। তা হচ্ছে তাদের অধিকাংশই গণআন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে সরাসরি ময়দানে আসা বা সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষ থেকে একটা মৃদু অভিযোগ হচ্ছে, তারা ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে কোনোদিন কোনো কথা বলেননি। গণঅভ্যুত্থানে তাদের মৌন সমর্থন থাকতে পারেÑ এটাকে প্রমাণ করা বা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ফ্যাসিস্টদের পতনে ছাত্র-জনতাকে যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তথা জীবন দিয়ে সংগ্রাম করতে হয়েছে, সে ধরনের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগ এই উপদেষ্টাদের নেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বিপ্লবকে সংহত করে জাতির আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে দেশকে চূড়ান্ত সফলতার দিকে নেয়ার মতো স্পিরিট বা কমিটমেন্ট তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে বলে মনে হয় না।
বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে তার মন্ত্রী ও পাইক-পেয়াদাদের সীমাহীন দুর্নীতি লুটপাটে সাধারণ জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সীমাহীন অত্যাচার-নির্যাতনের পাশাপাশি দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণেও পুরো দেশের জনগণ ফুঁসে উঠেছিল। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা, তাদের মাধ্যমে দুর্নীতির মূলোৎপাটন না হোক, দুর্নীতি কমে আসবে। কিন্তু আমরা সংবাদমাধ্যমে জানতে পারছি, বর্তমান সরকারের তিন উপদেষ্টার তিন পিএস তথা ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে দুর্নীতির কারণে বরখাস্ত ও অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তাদের অব্যাহতি দেয়া হয়েছে কোনো অযোগ্যতা বা দায়িত্ব অবহেলার মতো কারণে নয়। তাদের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ায় তাদের অব্যাহতি দেয়া হয়েছে, এ যেন সরষের মধ্যেই ভূত।
দেশের জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোর খবরে জানা গেছে, ইতোমধ্যে অন্তর্র্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ভূঁইয়ার এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেন ও স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের পিও তুহিন ফারাবিকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে শতকোটি টাকার দুর্নীতিরও অভিযোগ রয়েছে। তাদের দুর্নীতির খোঁজে কাজ শুরু করেছে দুদক।
‘দুই উপদেষ্টার সাবেক এপিএস ও পিওর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু’Ñ এ শিরোনামে গত ২৮ এপ্রিল যুগান্তর পত্রিকায় একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের সাবেক সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মো. মোয়াজ্জেম হোসেন এবং স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের সাবেক ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) তুহিন ফারাবির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের দুর্নীতির বিষয়ে ইতোমধ্যে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। গত ২৭ এপ্রিল রোববার দুদক মহাপরিচালক মো. আখতার হোসেন এ তথ্য জানান।’
দুদক মহাপরিচালক আখতার হোসেন বলেন, ‘আমরা তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পেয়েছি এবং ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেছি। আইন ও বিধি অনুযায়ী আমরা তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’ দুদক মহাপরিচালক জানান, ‘তাদের বিরুদ্ধে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিট তদন্ত করছে। তদন্তের অগ্রগতি যথাসময়ে জানানো হবে।’
সম্প্রতি তাদের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে যুগান্তরে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। দুর্নীতির অভিযোগ আলোচিত হলে মোয়াজ্জেম হোসেন ও তুহিন ফারাবিকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ২২ এপ্রিল এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে মোয়াজ্জেম হোসেনকে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। উপদেষ্টা আসিফ ৮ এপ্রিল তাকে বরখাস্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
জ্বালানি উপদেষ্টার পিএসকে অব্যাহতি
অন্তর্র্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের একান্ত সচিব (পিএস) মুহাম্মদ হাসনাত মোর্শেদ ভূঁইয়াকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। গত ৬ এপ্রিল তাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পদে বদলি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তবে সম্প্রতি বিষয়টি জানা গেছে। হাসনাত মোর্শেদকে কী কারণে উপদেষ্টার একান্ত সচিবের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে কিছু বলা হয়নি।
বিসিএস ২৮তম ব্যাচের কর্মকর্তা হাসনাত মোর্শেদ গত বছরের ১৮ আগস্ট ফাওজুল কবির খানের পিএস হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। নিয়োগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, উপদেষ্টা যতদিন পদে থাকবেন অথবা পিএস হিসেবে কাউকে রাখার অভিপ্রায় ব্যক্ত করবেন, ততদিন পর্যন্ত তিনি পিএস পদে থাকবেন। উপদেষ্টাদের পছন্দ অনুযায়ী উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে তাদের একান্ত সচিব নিয়োগ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
গ্রেফতারে আলটিমেটাম
এদিকে মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, তুহিন ফারাবি ও এনসিপি নেতা তানভীরকে গ্রেফতারের ১৫ দিনের আলটিমেটাম দিয়েছে যুব অধিকার পরিষদ। তাদের গ্রেফতারের দাবিতে গত ২৭ এপ্রিল রোববার ‘মার্চ টু দুদক’ কর্মসূচি থেকে এ আলটিমেটাম দেয় সংগঠনটি।
এদিকে মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, তুহিন ফারাবি ও এনসিপি নেতা তানভীরকে গ্রেফতারের দাবিতে রোববার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গণজমায়েত করেন গণঅধিকার পরিষদের ছাত্র সংগঠন যুব অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীরা। প্রেস ক্লাব থেকে মিছিল নিয়ে তারা দুদক কার্যালয়ের সামনে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন। এ সময় গণঅধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদ সদস্য ও গণমাধ্যম সমন্বয়ক আবু হানিফ তাদের গ্রেফতারের দাবিতে ১৫ দিনের আলটিমেটাম দেন।
যুব অধিকার পরিষদের সভাপতি মনজুর মোর্শেদ মামুন ও সাধারণ সম্পাদক নাদিম হাসানের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ১৫ দিনের ভেতরে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, যেসব উপদেষ্টার পিএসের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে সেসব উপদেষ্টা নৈতিকভাবে আর পদে থাকতে পারেন না। তাই উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও নূরজাহানের পদত্যাগ করা উচিত। অভিযুক্ত পিএস ও এনসিপি নেতা তানভীরকে আটক করতে হবে। ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে যারা এখন দায়িত্বে আছেন, উপদেষ্টা হয়েছেন-তাদের অনেকেই ফ্যাসিবাদের আমলে একটা টুঁ শব্দ পর্যন্ত করেনি। জনগণ যেভাবে আপনাদের ক্ষমতায় বসিয়েছে, জনগণের বিরুদ্ধে গেলে সেখান থেকে টেনে নামাতেও জনগণ চিন্তা করবে না। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে কোনো দুর্নীতিবাজের ঠাঁই হবে না।
উপদেষ্টাদের কি দায়ভার নেই?
যেই তিন উপদেষ্টার তিন ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে বরখাস্ত ও অব্যাহতি যাই হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এসেছে। ইতোমধ্যে দুদক থেকে প্রেস ব্রিফিং করে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়েছে যে, তাদের দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত শুরু করা হয়েছে। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের আকার ছোট হওয়ার কারণে একজন উপদেষ্টাকে রাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করতে হয়। তার সাথে প্রশাসনের বেশ কয়েকজন সচিব কাজ করলেও পিএস কিন্তু একজন। পিএস ও পিএ-রা সর্বক্ষণ উপদেষ্টার সাথে কাজ করেন। মন্ত্রণালয়ের সচিবের সাথে যোগাযোগ ও ফাইল আদান-প্রদান ইত্যাকার কাজগুলো উপদেষ্টারা পিএসের মাধ্যমেই করে থাকেন।
অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টা কিন্তু মাত্র তিনজন না, উপদেষ্টার সংখ্যা ২২। কিন্তু অভিযোগ এসেছে তিন উপদেষ্টার পিএসের বিরুদ্ধে। অভিযোগ কিন্তু সাধারণ নয়, গুরুতর অভিযোগ, তা হচ্ছে আর্থিক দুর্নীতি। দুদক তাদের ব্যাপারে তদন্তও শুরু করেছে। এ পিএসরা উপদেষ্টাদের সাথে বিগত ৬-৭ মাস ধরে কাজ করেছেন। পিএসরা উপদেষ্টাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু পিএসরা উপদেষ্টাদের এত কাছে থেকে দুর্নীতি করেছেন, তা বুঝতে পারলেন নাÑ এটা একটা বড় প্রশ্ন। আমরা বিশ^াস করি, উপদেষ্টারা নিজেরা দুর্নীতি করেননি। কিন্তু উনাদের পাশে থেকে একসাথে কাজ করে পিএসরা দুর্নীতি করলেন, উনারা বুঝতে পারলেন নাÑ এটা খুবই দুঃখজনক। প্রধান উপদেষ্টা তার বিভিন্ন বক্তৃতায় বলেছেন, বাংলাদেশে উন্নয়নের অন্যতম একটি বাধা হচ্ছে সরকার ও প্রশাসনে দুর্নীতি। সরকারের মূল কর্তা ও চালিকাশক্তি হচ্ছে মন্ত্রীবর্গ তথা বর্তমানে উপদেষ্টারা। তারা যদি নিজেরা দুর্নীতি না করেন এবং দুর্নীতির প্রশ্রয় না দেন, তাহলে দেশে দুর্নীতি হতে পারে না। কিন্তু কীভাবে তিন উপদেষ্টার তিন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এভাবে দুর্নীতি করলেন, তারা বুঝতে পারলেন না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এ দীর্ঘসময় ধরে ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা দুর্নীতি করে আসছেন, তা ধরতে বা বুঝতে না পারার মধ্যে দুটি কারণ হতে পারে। একটি তারা বুঝতে পারেননি যে, ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা দুর্নীতি করছেন আর একটি কারণ হতে পারে, তা দেখেও না দেখার ভান করেছেন। যেই কারণই হোক না কেন, তাদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত বা অব্যাহতি পেয়েছেন। এ দায় থেকে উপদেষ্টারা বাদ পড়তে পারেন না। এখানে উপদেষ্টাদের দেশ, জাতি ও সরকারের প্রতি দায়বদ্ধতার যে কমিটমেন্ট তার ঘাটতি রয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। একটি রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। উপদেষ্টারা যদি জাতির প্রতি কমিটেড হন, তাহলে তাদের অধীনে কর্মকর্তারা দুর্নীতি ও অনিয়ম করার সুযোগ পেতে পারে না। বর্তমানে যারা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের অধিকাংশ দেশের সিনিয়র সিটিজেন এবং ইতোপূর্বে তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনেক বড় বড় দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। তারা যদি সিদ্ধান্ত নেন যে তার মন্ত্রণালয়ে কোনোরকম দুর্নীতি তারা বরদাশত করবেন না, তাহলে দুর্নীতি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তারপরও উপদেষ্টাদের সাথে যারা সর্বক্ষণ অবস্থান করে, অনিয়ম করেছেন কীভাবে? তাদের সাথে সর্বক্ষণ অবস্থান করে যারা, তাদের অনিয়ম আইডেন্টিফাই করতে পারেন না যারা, তারা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সারা দেশের অফিস-আদালতের দুর্নীতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন। আমরা চাই বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদ একটি দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়তে সমর্থ হবেন। এ তিন ব্যক্তিগত কর্মকর্তার উদাহরণটিকে সামনে রেখে তারা আরো সচেতন হবেন, আরো সক্রিয় হবেন। এককথায় দুর্নীতির ব্যাপারে জিরো টলারেন্স হবেনÑ এটাই জাতির কাম্য।