কুরবানি ও আযান নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যে ক্ষোভ


২২ মে ২০২৫ ১৬:৪১

॥ জামশেদ মেহদী॥
বিপ্লবের সরকার বা গণঅভ্যুত্থানের সরকারের বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটকে ধারণ করতে হবে প্রশাসনকে। অন্যথায় বিপ্লবোত্তর বা গণঅভ্যুত্থানোত্তর সরকারই শুধু ব্যর্থই হবে না, সেই বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানও ব্যর্থ হয়ে যাবে বা হাতছাড়া হয়ে যাবে। আমরা বিভিন্ন দেশের গণবিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস থেকে এ শিক্ষাই পাই। ফ্রান্সসহ বেশ কয়েকটি দেশে দেখা যায় যে, বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব হয়েছে। ফ্রান্সে একটি নয়, দুটি নয়, চারটি বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লবের পর পঞ্চম দফায় একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সাচ্চা গণতন্ত্র ফিরে আসে। এ অভ্যুত্থানের নায়ক ছিলেন ফরাসি সেনাবাহিনী প্রধান চার্লস দ্যাগল। পরবর্তীতে তিনি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন।
বাংলাদেশের জোর বরাত, জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব ঘটেনি। যেখানে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি রন্ধ্রে ঢুকেছিলো, সেখানে প্রতিবিপ্লবটাই স্বাভাবিক ছিল। অবশ্য একটি নয়, দুটি নয়, গত বছরের আগস্ট মাসে বেশ কয়েকটি প্রতিবিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা করেছিল শেখ হাসিনার রেখে যাওয়া প্রেতাত্মারা। সর্বাগ্রে চেষ্টা হয়েছিল একটি জুডিশিয়াল ক্যু বা বিচারিক অভ্যুত্থান ঘটানোর। বিপ্লবের কাঠিন্য এবং গতিবেগ নিয়ে সেই জুডিশিয়াল ক্যু ঠেকানো গেছে। এর আগে সেনাবাহিনীর মধ্যেও একটি অনর্থ ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। যতগুলো প্রতিবিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা হয়েছিল বা সরকারকে ডিস্ট্যাবিলাইজ করার অপচেষ্টা হয়েছিল, তার সবগুলোকেই বানচাল করা সম্ভব হয়েছে। কারণ বাংলাদেশের লাখকোটি জনগণ এ বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছেন।
এ বিপ্লবের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের করণীয় ছিল সমাজে; বিশেষ করে প্রশাসনের সর্বস্তরে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা। কারণ সচিবালয় থেকে শুরু করে জেলা; এমনকি উপজেলা পর্যায়েও আওয়ামী লীগ তাদের নেতা-কর্মীদের বসিয়েছিল। তাদের সকলকে অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত এত বিপুলসংখ্যক জুলাই বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ অফিসার হয়তো পাওয়া যায়নি। অথবা থেকে থাকলেও তাদের সন্ধান বের করা সম্ভব হয়নি। তবে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করা, নিদেনপক্ষে আওয়ামী লীগের আদর্শ, অর্থাৎ ভারতের দালালি করা এবং ইসলাম ও মুসলিমের মর্মবাণীর বিরোধিতা করার অফিসাররা যে এখনো তাদের মিশনে ক্রিয়াশীল রয়েছেন, তার অনেক প্রমাণ বিগত ১০ মাসে বিভিন্ন সময় পাওয়া গেছে। তবে সর্বশেষ ঘটনাটি তাজা এবং টাটকা। এখন দেখা যাচ্ছে, ঐ ধরনের আওয়ামীপন্থি অফিসাররা ইসলাম এবং মুসলমানের ঈমান, আকিদা, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের ওপর আঘাত করছেন। এর সর্বশেষ প্রমাণ হলো কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত কূটনীতিক শাবাব বিন আহমেদের সর্বশেষ হুকুম। এ অফিসার এখনো কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনে ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে জয়েন করেননি। তিনি জয়েন করবেন আগামী ২ জুন। কিন্তু জয়েন করার আগেই তিনি নেদারল্যান্ডসে বসে কলকাতা হাইকমিশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দকে একটি মারাত্মক ইসলামবিরোধী হুকুম দিয়েছেন।
গত ১৯ মে সোমবার দৈনিক ‘আমার দেশের’ প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদে এমন খবর পরিবেশিত হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে যে, কলকাতা মিশনে ঐতিহ্যগতভাবে চলে আসা কুরবানি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এ নির্দেশ জারির পক্ষে তিনি বলেন, যারা আমাদের মিশনের নিরাপত্তায় থাকে, তাদের সংখ্যা ২৫ জনেরও বেশি। এর সকলেই ভারতীয় এবং তারা গরু পূজা করেন। এখন যদি মিশনের অফিসার ও স্টাফ কুরবানি উপলক্ষে গরু জবাই করেন, তাহলে ঐসব হিন্দু নিরাপত্তা কর্মীর মনের অবস্থা কী হবে, সেটি তিনি ভেবে দেখতে বলেছেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, শাবাব বিন আহমেদ এখনো মিশনে যোগদানই করেননি। তার আগেই তিনি এ ধরনের অত্যন্ত স্পর্শকাতরই শুধু নয়, রীতিমতো ইসলামবিরোধী একটি নির্দেশ পাঠিয়েছেন। তার এ নির্দেশের কথা ইতোমধ্যেই মিশনের আশপাশের বাসিন্দারা জেনে গেছেন। জেনে তাদের মধ্য তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
খবরে বলা হয়েছে যে, বিগত ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কলকাতা মিশনে কুরবানি দেওয়া হচ্ছে। প্রতি বছরেই ৫ থেকে ৭টি গরু এবং ছাগল কুরবানি দেওয়া হয়। এ কুরবানির গোশতের একটি বড় অংশ এতিমখানায় পাঠানো হয়। রিপোর্ট মোতাবেক, বাংলাদেশ মিশনের আশপাশে বসবাসকারী বাসিন্দাদের ৯০ শতাংশই মুসলমান। এ মুসলমানরাও মিশনের কুরবানি থেকে গোশত পেয়ে থাকেন। এভাবেই কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের একটি ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে। রিপোর্টে বলা হয়, মিশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বিষয়টির স্পর্শকাতর দিকটি তার কাছে বার বার তুলে ধরেন এবং এ ধরনের নির্দেশদানে বিরত থাকার অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি নাকি কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করেননি। তখন মিশনের কর্মচারীরা তাকে বলেন, সেক্ষেত্রে তিনি যেন কুরবানি ঈদের পরে যোগদান করেন। কিন্তু সে অনুরোধও তিনি রক্ষা করেননি। তিনি সাফ জানিয়ে দেন যে, তিনি আগামী ২ জুন দায়িত্ব নেবেন। এর মধ্যে অফিসার ও স্টাফরা যেন কুরবানি বন্ধ করার যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। আলোচ্য রিপোর্ট মোতাবেক, মিশনের আশপাশের হিন্দু বাসিন্দারাও বলেছেন, কুরবানি বন্ধের সিদ্ধান্ত যেন কার্যকর করা না হয়। যদি কুরবানি বন্ধ হয়, তাহলে তার একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে পড়বে। শাবাব বিন আহমেদ যুক্তি দেখান যে, যদি মিশনে কুরবানি বন্ধ হয়, তাহলে নাকি হোস্ট কান্ট্রির (ভারত) আস্থা অর্জন করা সম্ভব হবে। আর হোস্ট কান্ট্রির আস্থা অর্জন করা নাকি আমাদের জন্য খুব জরুরি।
রাজনৈতিক মহল এ কথা ভেবে বিস্মিত হচ্ছেন যে, যেখানে খোদ ড. ইউনূসের সরকার ধর্মীয় ফরজ পালন না করে ভারতের আস্থা অর্জনকে তত জরুরি মনে করছে না, সেখানে শাবাব বিন আহমেদের মতো আমলা ভারতের আস্থা অর্জনের জন্য এত বেতাল হয়েছেন কেন? এ লোকের চিন্তাধারার সাথে আওয়ামী লীগের চিন্তাধারার কোনো তফাৎ নেই। এ ধরনের ভারতীয় দালালশ্রেণির অফিসারদের ভারতের মতো বাংলাদেশবিরোধী দেশের মিশনে (২ নম্বর ব্যক্তি করে; ১ নম্বর ব্যক্তি হলেন দিল্লিস্থ বাংলাদেশ মিশনের হাইকমিশনার) পাঠানো হয় কীভাবে? গত ৩০ বছর ধরে কলকাতায় কুরবানি চলে আসছে। তখন কোনো সমস্যা হয়নি। এখনই নতুন ডেপুটি হাইকমিশনার আসার আগেই নিজ থেকেই সমস্যা সৃষ্টি করা হচ্ছে কেন?
দেখা যাচ্ছে, ইসলামবিরোধিতা শুধু আওয়ামীপন্থি অফিসারদের মধ্যেই নয়, একশ্রেণির বিএনপি নেতাদের মধ্যেও সেটি গজাতে শুরু করেছে। একই দিন অর্থাৎ গত ১৯ মে সোমবার দৈনিক ‘আমার দেশের’ শেষ পৃষ্ঠায় বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও পাবনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান হাবিব ঘোষণা করেছেন যে, পাবনার আটঘরিয়া উপজেলায় জামায়াতপন্থি কোনো মুয়াজ্জিন আজান দিতে পারবেন না এবং জামায়াতের কোনো ইমাম নামাজ পড়াতে পারবেন না। তিনি বলেন, ‘আমি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছি, আটঘরিয়ায় কোনো মসজিদে জামায়াতপন্থি মুয়াজ্জিন আজান দিতে পারবেন না। তাদের কোনো ইমাম ইমামতি করতে পারবেন না।’ জামায়াতপন্থি ইমামের পেছনে দাঁড়ালে নাকি নামাজ হয় না।
মানুষ ভেবে অবাক হচ্ছেন, হাবিবুর রহমান হাবিব যে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছেন, তার সাথে সংগঠন হিসেবে বিএনপি সহমত কিনা। যেখানে বেগম খালেদা জিয়া এখন বহাল তবিয়তে ঢাকায় অবস্থান করছেন, সেখানে হাবিবুর রহমান হাবিবের মতো নেতার এ ধরনের স্পর্ধা বেগম জিয়া নিশ্চয়ই অনুমোদন করবেন না। তবে হাবিবের এ উক্তিতে জনগণ অবাক হননি। কারণ হাবিব তো একসময় ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। অনেকে ঠাট্টা করে বলেন, ঙহপব ধহ অধিসর খবধমঁবৎ, ধষধিুং ধহ অধিসর খবধমঁবৎ. অর্থাৎ কেউ একবার আওয়ামী লীগ করলে মন-মগজে সবসময় সে আওয়ামী লীগারই থেকে যায়।
দেশের রাজনীতিকে অকস্মাৎ হিংসাশ্রয়ী হতে দেখা যাচ্ছে। হাবিবের এ স্পর্ধিত উক্তির পর কুমিল্লার একটি খবরে দেখা যাচ্ছে যে, ঐ জেলায় অর্থাৎ কুমিল্লায় এনসিপি নেতা এবং জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের অন্যতম শীর্ষনেতা হাসনাত আব্দুল্লাহকে কুমিল্লায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। তাকে নাকি কুমিল্লায় ঢুকতে দেওয়া হবে না। তিনি নাকি বলেছেন যে, আওয়ামী লীগের টাকায় বিএনপি চলে। হাসনাতের এ বক্তব্যের জবাব দেওয়া যেত রাজনৈতিকভাবে। তারা যদি হাসনাতের বক্তব্যকে মিথ্যা প্রমাণ করতে পারেন অথবা হাসনাত বা তার দলের বিরুদ্ধে জেনুইন কোনো অভিযোগ আনতে পারেন তাহলে সেটিই হবে রাজনীতিতে যোগ্য জবাব। কিন্তু সেটি না করে তাকে তার নিজ জেলায় ঢুকতে দেওয়া হবে না, এ ধরনের উক্তি এবং কাজ তো করতো আওয়ামী লীগ। এগুলো তো ফ্যাসিবাদী কাজ। এখন বিএনপিও কি আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী পদাঙ্ক অনুসরণ করবে?
৫ আগস্ট অর্থাৎ জুলাই বিপ্লবের পর থেকে বিগত সাড়ে ৯ মাস জামায়াত এবং ছাত্রশিবির অত্যন্ত গঠনমূলক এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করছে। এর ফলে এ অল্প সময়ের মধ্যে জামায়াত এবং ছাত্রশিবিরের জনপ্রিয়তা অবিশ্বাস্য রকম বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন জামায়াতের এ জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের আচরণ অরাজনৈতিক বলে মানুষের কাছে প্রতিভাত হচ্ছে। ফেসবুকে তার ভেরিফায়েড পেজে প্রদত্ত এক পোস্টে তিনি বলেন, শর্ষিনাপন্থি মাদরাসায় নাকি জামায়াত নেতাদের ফাঁসিকে দেখা হতো তাদের আলেম ও সহিহ ইসলামবিরোধিতার ফসল হিসেবে। তিনি আরও দুটি পোস্টে বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থা আবিষ্কার করেছেন। এসব আজগুবি কথা বলে তিনি একদিকে শর্ষিনার দরবার শরীফ সম্পর্কে মানুষের মনে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি করছেন; অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ভাষায় জামায়াতকে পাকিস্তানপন্থি বলে সমালোচনা করায় তার গ্রহণযোগ্যতা কতখানি কমে গেছে, সে সম্পর্কে তিনি সচেতন বলে মনে হয় না।
এসব উসকানিতেও জামায়াত ধীরস্থির ও শান্ত। কিন্তু দেশ এখন এক গুরুতর সংকট অতিক্রম করছে। এখন প্রয়োজন ছিল জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী সকলের ঐক্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে অংশীজনদের মধ্যে সেই ঐক্য মারাত্মকভাবে বিনষ্ট হচ্ছে এবং তাদের মধ্যে দূরত্ব দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। ওরা ভুলে যাচ্ছেন যে পেছনে ওঁত পেতে বসে আছে ভারত। আওয়ামী লীগকে সামনে ঠেলে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। এসব বিষয় বিবেচনায় না নিলে আখেরে ফ্যাসিবাদবিরোধী সকলকে পস্তাতে হবে।