মনিটরিং কার্যক্রমে ভাটা পড়ায় খুচরা বাজারে কমছে না নিত্য পণ্যের দাম

সোনার বাংলা অনলাইন
২ নভেম্বর ২০২৫ ০৭:৫৫

পাইকারিতে দাম কমলেও খুচরা বাজারে এর প্রভাব নেই

পাইকারিতে দাম কমলেও খুচরা বাজারে এর প্রভাব নেই। সরকারিভাবে পণ্যবাজার নিয়ে মনিটরিং কার্যক্রমে ভাটা পড়ায় দরপতনের সুফল পাচ্ছেন না সাধারণ ভোক্তারা। বৈশ্বিক দরপতনের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকাংশ ভোগ্যপণ্যের দাম দেশের পাইকারি বাজারে নিম্নমুখী। এক মাসের ব্যবধানে প্রায় সব ধরনের নিত্য ভোগ্যপণ্যের দাম ধারাবাহিকভাবে কমছে।
কয়েক মাস আগেও দেশে ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পণ্যের উচ্চমূল্য নিয়ে হইচই শুরু হলে প্রশাসনের পক্ষ থেকেও দাম সহনীয় রাখা, বাজার পরিদর্শন করা, দাম পুনর্নির্ধারণের মতো উদ্যোগ নেয়া হতো। তবে কয়েক মাস ধরে প্রশাসনের পক্ষ থেকেও উদ্যোগ স্তিমিত হয়ে আসায় পাইকারিতে দাম কমলেও খুচরায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। পাইকারি বাজারে দাম বাড়তি—এমন ধারণা ভোক্তাদের দিয়ে এক শ্রেণীর সাধারণ খুচরা ব্যবসায়ী বেশি দামে নিত্য ভোগ্যপণ্য বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

ঢাকা ও চট্টগ্রামের ভোগ্যপণ্যের বড় পাইকারি ও খুচরা বাজারের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, একসময় খুচরা পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা কেজিপ্রতি ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ লাভ করতেন। বর্তমানে পাইকারি দাম কমতে কমতে সহনীয় পর্যায়ে নামলেও অধিকাংশ খুচরা বিক্রেতা কেজিপ্রতি সামান্য কমিয়ে পণ্য বিক্রি করছেন। এতে এসব প্রতিষ্ঠানের কেজিপ্রতি লাভের হার ১০-২০ শতাংশ, ক্ষেত্রবিশেষে তা আরো বেশি। ফলে ঠকছেন সাধারণ ক্রেতারা।
পাইকারি ও খুচরা বাজারে ভোগ্যপণ্যের মধ্যে কয়েকটির দাম অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বর্তমানে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি মোটা মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৮১-৮২ টাকায়। কিছুদিন আগেও এর পাইকারি দাম ছিল ৮৮-৯০ টাকা। একই সময়ে চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি খুচরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন তারা প্রতি কেজি মসুর ডাল বিক্রি করছেন ১০৫-১১০ টাকা কেজি দরে। অর্থাৎ ৮২ টাকা কেজিতে কিনে ১০৫ টাকায় বিক্রি করলে প্রতি কেজিতে লাভ হচ্ছে ২৩ টাকা বা ২৮ শতাংশ।
একই চিত্র দেখা গেছে চিনির ক্ষেত্রে। বর্তমানে পাইকারিতে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৯১-৯২ টাকা দরে। এই হিসাবে খুচরায় কেজিপ্রতি ১০০ টাকার মধ্যে চিনি বিক্রির কথা। কিন্তু চট্টগ্রামের বাজারে খুচরায় প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে সর্বনিম্ন ১০২ থেকে সর্বোচ্চ ১০৫ টাকায়। মুগ ডাল, ছোলা, খোলা সয়াবিন, পাম অয়েল, সুপার পাম অয়েল, আটা-ময়দার মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য পাইকারি বাজার থেকে বাড়তি দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা।
পাইকারি বাজারের তথ্যমতে, বর্তমানে ভারত থেকে আমদানি হওয়া মসুর ডাল কেজিপ্রতি ৪-৫ টাকা কমে লেনদেন হচ্ছে ১৪৮ টাকায়, মুগ ডাল ১৫৫ থেকে কমে ১৪০ টাকায়, ছোলা ১০৫ থেকে কমে ৯০ টাকায়, ছোলার ডাল ১০০ থেকে কমে ৯২ টাকায়, খেসারি ডাল ৮৭ থেকে কমে ৭৫ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। আবার চিনির দাম কমতে কমতে কেজিপ্রতি ৯১-৯২ টাকায় নেমে এসেছে। ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধির জন্য মিল মালিকদের সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের পরিপ্রেক্ষিতে কিছুদিন পণ্যটির দাম বেড়ে যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের টানা দরপতন শুরু হলে দেশের পাইকারি বাজারেও এর প্রভাব পড়ে। ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারের পাশাপাশি দেশের বাজারেও অনেক ভোগ্যপণ্যের দাম নিম্নমুখী। প্রায় সব ধরনের ডালের দাম রেকর্ড পরিমাণ কমে গেছে। বিগত দুটি রমজানে চড়া দামে ছোলাসহ বিভিন্ন ডাল বিক্রি করতে হয়েছে। বিশ্ববাজারের পাশাপাশি দেশের পাইকারি বাজারেও দাম কমছে। যার কারণে আগামী রোজায় কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম দামে ছোলা কিনতে পারবেন ভোক্তারা।’ চালের পর প্রধান ভোগ্যপণ্য হিসেবে ডালের দাম কমে যাওয়া দেশের সাধারণ মানুষের জন্য একটি সুখবর বলে মনে করছেন তিনি।
ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণ সংগঠন ও বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাইকারিতে কমলেও খুচরা বাজারে দাম সমন্বয় না হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে প্রশাসনের তৎপরতার ওপর। নৈতিকতার কারণে খুচরা ব্যবসায়ীদের উচিত পাইকারি বাজারে দামের ওঠানামার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ দাম নিয়মিত পরিবর্তন করা। কিন্তু দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এক মুহূর্ত দেরি না করলেও পাইকারিতে কমে গেলে খুচরা দাম কমাতে গড়িমসি করা হয়। তাছাড়া রমজান, কোরবানির ঈদ ব্যতীত ভোক্তা অধিকার কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের বাজার মনিটরিং কার্যক্রম কার্যত বন্ধ থাকে। এর সুযোগ নিয়ে খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা পাইকারি বাজারে দাম কমে যাওয়ার বিষয়টি আড়াল করে নিত্য ভোগ্যপণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে বাড়তি মুনাফা করছেন।
পাইকারি ও খুচরা বাজারের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রিতে খুচরা বিক্রেতারা লাভ করেন লিটারপ্রতি ৩-৪ টাকা। বর্তমানে পাইকারি বাজারে প্রতি মণ সুপার পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার ১০০ থেকে ৬ হাজার ১২০ টাকায়। মিলগেট থেকে সংগ্রহ করে খুচরা পর্যায়ে পৌঁছতে আরো ১৫০ টাকার মতো ব্যয় হয়। এই হিসাবে প্রতি কেজি সুপার পাম অয়েলের খুচরা বিক্রেতাদের ক্রয়মূল্য হয় কেজিপ্রতি ১৬৮ টাকা। তবে চট্টগ্রামের বাজারে প্রতি কেজি সুপার পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ভোগ্যপণ্যের দৈনিক বাজারদর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শনিবার খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মুগ ডালের সর্বনিম্ন দাম ছিল ১২০ থেকে সর্বোচ্চ ১৮০ টাকা। যদিও দেশের প্রধান পাইকারি বাজারগুলোতে সর্বনিম্ন ৮৫ থেকে ১৪০ টাকায় মুগ ডাল লেনদেন হচ্ছে। সবচেয়ে ভালো মানের মুগ ডাল (দেশীয় চিকন) পাইকারি থেকে খুচরা বাজারে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছতে ৪০ টাকা লাভ করা হচ্ছে। একইভাবে প্রতি কেজি অ্যাংকর ডালের খুচরা দাম ৬০-৮০ টাকা। যদিও পাইকারি বাজারে এখন অ্যাংকর ডালের দাম কমে নেমে এসেছে ৪৩-৪৫ টাকা কেজিতে।
দেশের বিভিন্ন খুচরা দোকান ও সুপারশপে মোড়কজাত ভোগ্যপণ্যের দাম পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দুগ্ধ, শিশুখাদ্য, কনফেকশনারি, মসলাসহ বিভিন্ন পণ্য মোড়কের দামের তুলনায় অনেক বেশি ছাড় দিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। সুপারশপগুলোতে অফার মূল্যে বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে মোড়কের দাম কিংবা মোড়কের নির্ধারিত দামের ৫-১০ টাকা ছাড়ে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। বিশ্ববাজারে পণ্যের দরপতনের পরিপ্রেক্ষিতে কনজিউমার পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন খরচ কমলেও মোড়কের দাম কমায়নি তারা। যার কারণে বড় রিটেইল শপগুলো বিপুল ছাড়ে পণ্য বিক্রি করলেও সাধারণ খুচরা দোকানদাররা ভোক্তাদের কাছে বাড়তি মুনাফায় পণ্য বিক্রি করে। এতে ভোক্তারা বিশ্ববাজার ও পাইকারি বাজারে দাম কমে যাওয়ার সুফলবঞ্চিত হচ্ছে।

বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য আগের তুলনায় অনেক কমেছে বলে স্বীকার করেছেন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এমএইচ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন মিন্টু। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববাজারে দাম কমার পাশাপাশি দেশীয় ভোগও কমে গেছে। কয়েক বছর ধরে দেশীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিবর্তে বরং কমেছে। বৈশ্বিক বাজারে দাম কমে যাওয়ায় দেশের পাইকারি বাজারেও এর প্রভাব পড়ছে। পাইকারি বাজারে দাম কমলেও খুচরায় দ্রুত প্রভাব না পড়ার পেছনে রয়েছে ব্যবসায়ীদের নৈতিকতাবিরোধী অবস্থান।’

কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘দেশের ভোগ্যপণ্য বাজার নিয়ে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কারসাজি কিংবা অতিমুনাফার বিষয়টি আমরা জানি। সরকার উৎসবের সময়ে দাম নিয়ন্ত্রণে নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ করলেও সারা বছর উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেয় না। যার কারণে পাইকারি বাজারের পাশাপাশি খুচরা বাজারেও সাধারণ ভোক্তারা বেশি দামে পণ্য কিনতে বাধ্য হয়। ভোক্তারা যাতে না ঠকে সে জন্য সারা বছরই নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকারের কাজ করা উচিত।’