সংবাদ শিরোনামঃ

বিদ্যুৎ : কোন সুখবর নেই লোডশেডিং তীব্রতর হবে ** জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যার নেপথ্য খলনায়ক কে? ** জামায়াত নেতৃবৃন্দ যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত নন ** কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে আ’লীগ সরকারের কোরআন বিরোধী নারী নীতি ** বিশ্বকাপে বাংলাদেশের স্বপ্ন প্রলম্বিত হোক ** পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করার নায়ক ডেভিস ইস্যুতে পাক জনমত ও আদালতের চাপে সরকার ** ভূমিকম্প আর সুনামির পর পরমাণু আতঙ্কে জাপান ** কোরআন বিরোধী নারীনীতির অনুমোদনের পর সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ** আশির দশক ও কবি মতিউর রহমান মল্লিক **

ঢাকা শুক্রবার ০৪ চৈত্র ১৪১৭, ১২ রবিউস সানি ১৪৩২, ১৮ মার্চ ২০১১

।। ড. মোহাম্মদ বেলাল হোসেনূ ।।
মিকা
রাষ্ট্র সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। এটি এমন একটি রাজনৈতিক কাঠামোর নাম যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোন ভূখন্ডের অধিবাসীরা তাদের সামাজিক জীবনের আইন-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন সাধনের জন্য একটি নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। পাশাপাশি ভূখন্ডকে স্থিতিশীল ও শীক্তশালী করা, এর ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশ সাধন, আইন ও নিরাপত্তা ইত্যাদির অগ্রগতি যখন নিয়মতান্ত্রিকতার সাথে চলতে থাকে তখনই সৃষ্টি হয় রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা মানব ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে যুগ পরিক্রমায় রাষ্ট্র ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার এর প্রয়োজনীয়তা প্রবলভাবে অনুভূত হয়ে আসছে। সৃষ্টির আদিকাল থেকে নবী ও রাসূলগণ রাষ্ট্র পরিচালনার মহান দায়িত্ব পালন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর নির্দেশে মোতাবেক মদীনায় একটি কল্যাণকামী ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। হয়। এ মর্মে আল-কুরআনে তাঁকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন,

‘‘(হে নবী) আমি সত্য ও সঠিকভাবে তোমার প্রতি ও কিতাব নাযিল করেছি, তা পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের সত্যতা প্রতিপন্ন করে এবং তার সংরক্ষণ করে। সুতরাং আল্লাহ যা কিছু নাযিল করেছেন, তদানুযায়ী লোকদের মধ্যে তুমি ফায়সালা করো। আর মানুষের প্রবৃত্তির অনুবর্তন করতে গিয়ে তোমার নিকট আগত সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না।’’ (সূরাহ আল-মায়িদাহ্: ৪৮)

রাসূল (সা.) আল-কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী মদীনায় হিজরতের পর সেখানে স্বাধীন ও উন্মুক্ত পরিবেশে যে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেন তা-ই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। এ স্বৈরাচারী শাসন অথবা শেখতন্ত্রের পরিবর্তে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নব প্রতিষ্ঠিত ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রে স্বৈরাচারী শাসন অথবা শেখতন্ত্রের পরিবর্তে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব স্বীকৃতি লাভ করে। ধর্ম ও রাষ্ট্রের সহাবস্থানে ইসলাম একটি সর্বজনীন ধর্ম ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিণত হয়। এক দশকের কম সময়ের মধ্যেই মদীনার এ রাষ্ট্র জাতীয় ও জনকল্যাণ রাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহ করে। অহীর মাধ্যমে রাসূল (সা.) এ রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যক্রম দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেন। ১৪০০ বছর পূর্বেকার সমাজ ও এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থা আজও একবিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে বিশ্ববাসীর কাছে এক অনুসরণযোগ্য রাষ্ট্র ব্যবস্থার মডেল হয়ে আছে হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

সার্বভৌমত্ব
সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর। তিনি সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। তিনি ছাড়া অন্য কোন মানবীয় ও অমানবীয় শক্তির পক্ষ থেকে নির্দেশ বা ফয়সালা দান করার কারোর অধিকার নেই। পৃথিবীতে তাঁর এ সার্বভৌমত্ব প্রয়োগের জন্য তিনি নিজেই মানুষকে খলীফা হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। আল-কুরআনে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে :
‘‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনবে ও নেক আমল করবে, তাদের সাথে আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে, তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে প্রতিনিধি বানাবেন ঠিক যেভাবে তাদের পূর্বে অনূদেরকে প্রতিনিধি বানিয়েছিলেন।’’(সূরাহ নূর - ৫৫)

রাসূলুল্লাহ (সা.) এই সার্বভৌমত্বের উপর ভিত্তি করে মদীনায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তিনি এ রাষ্ট্রে আইন, শাসন, সমাজ, ব্যক্তি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিক ও বেসামরিক প্রভৃতি সেক্টরে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে দশ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এ সার্বভৌমত্বের বাইরে কোন নাগরিক অবস্থান করতে পারেনি। তিনি রাষ্ট্রের জনগণকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আল্লাহ রিয্কদাতা, সকল ক্ষমতার মূল উৎস। কেবলমাত্র তাঁর সার্বভৌমত্বেই নিহিত রয়েছে মানুষের মুক্তি, শান্তি ও প্রগতি। মানুষ মানুষের দাস হতে পারে না, কারো গোলামীও করতে পারে না। কেবল দাসত্ব ও গোলামী আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। আল্লাহ তাঁর সার্বভৌমত্ব প্রয়োগকারী হিসেবে তাঁর প্রতিনিধি বা খলীফা নিযুক্ত করেছেন। আর আল্লাহই হলেন এই প্রতিনিধির নিয়ামক শক্তি। তাই কোন ব্যক্তি বা রাষ্ট্রনায়ক নিজেদের খেয়াল-খুশিমত আইন প্রণয়ন করার অধিকার রাখে না। রাসূল (সা.) আল্লাহর এ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্ব মানবতাকে গোলামীর শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে মানব জীবনে আইনের শাসন, জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা এবং বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ পৃথিবীকে উপহার দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ঐশীর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এ রাষ্ট্রে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ আইনের চোখে যেমন সমান বলে বিবেচিত হয়েছিল, তেমনি তাদের অধিকার পুরোপুরিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

প্রশাসন প্রশাসন
পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রকৃত পরিচালক রাসূল (সা.) ছিলেন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কর্তৃত্বের একমাত্র উৎস;। আইন, প্রশাসনিক, সামরিক ও বিচার বিভাগীয় সকল ক্ষমতা তাঁর হাতে কেন্দ্রিভূত ছিল। একটি সরকার ও প্রশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বেশ কিছু সংখ্যক সাহাবীকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদে নিয়োগ করে তাদের নিকট স্বীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন। তাঁর এ বেসামরিক প্রশাসন যন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক এবং স্থানীয় প্রশাসকগণ। কেন্দ্রীয় প্রশাসকদের মধ্যে ছিলেন স্বয়ং রাসূল (সা.) এবং তাঁর সব প্রতিনিধি, উপদেষ্টা, সচিব, দূত, কমিশনারগণ, বা বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, কবি, বক্তা এবং আরো নানা ধরনের কর্মকর্তাগণ। অপরপক্ষে প্রাদেশিক কর্মকর্তাগণ ছিলেন বিভিন্ন গভর্নর, স্থানীয় প্রশাসকবৃন্দ, প্রতিনিধিবর্গ, ও বিচারকবৃন্দ ও বাজার কর্মকর্তাগণ। তাঁদের সকলকে নিয়ে রাসূল (সা.) এক দশকের শাসনামলে বেসামরিক প্রশাসনের বিভিন্ন শাখা ও কর্মকর্তাদের কার্যপ্রণালীর ঐতিহাসিক বিবর্তন আনয়ন করেন।

শূরা বা পরামর্শ সভা মজলিসে শূরা
আল-কুরআনে রাসূলে কারীমকে (সা.) পরামর্শের ভিত্তিতে কার্যনির্বাহ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কুরআনের এ নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রাসূলে কারীম (সা.) রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে মজলিসুস শূরা বা পরামর্শ সভা গঠন করেন। মজলিসুস শূরা গঠনে রাসূল (সা.) একটি কৌশল অবলম্বন করেন। তাহলো এ পরামর্শ সভাকে গতিশীল ও সার্বজনীন করার জন্য মদীনার বাইরে এমন কি আরবীয় গন্ডির বাইরের কয়েকজনকে এর সদস্যভুক্ত করেন। মুহাজির ও আনসারী বিজ্ঞ সাহাবী ছিলেন এ সভার অন্যতম সদস্য। রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ, প্রশাসনিক কাঠামোর রূপরেখা দান, শাসন প্রণালী প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ শূরা নির্ণয় করত। তিনি মজলিসসে শূরার সদস্যদের সাহাবীগণের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করতেন এবং তাদের পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। তবে কুরআন তাকে যে অলঙ্ঘনীয় ব্যাপক ক্ষমতা দিয়েছে তার প্রেক্ষিতে তিনি সে সব পরামর্শ গ্রহণ বা বর্জন করার এখতিয়ার রাখতেন। তিনি সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শ করার পর যে মতটি অধিক সঠিক ও কল্যাণকর মনে করেছেন সেটিই গ্রহণ করেছেন। সম্প্রদায়গত স্বার্থ, ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ক প্রশ্নে প্রতিনিয়ত পরামর্শ সভা চলত। সে পরামর্শের ভিত্তিতে তিনি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হযরত সালমান ফারিসীর পরামর্শক্রমে খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খনন এবং তায়িফে অভিযান চলাকালে অবরুদ্ধ শত্রুদের বিরুদ্ধে মিনজানিক ব্যবহার করা সংক্রান্ত পরামর্শ রাসূল (সা.) তিনি বিনা বাক্যে গ্রহণ করেন। রীতি পরামর্শনীতি অনুসরণ করেই মদীনায় মসজিদে নববীর স্থান নির্বাচন এবং মুয়াখাতের (ভ্রাতৃত্ববোধ) রীতি প্রচলিত হয়। রাসূল কারীম (সা.) কোন কোন সময় পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়ার পর সার্বিক কল্যাণের কথা চিন্তা করে কৌশলগত কারণে তা পরিবর্তন করতেন। যেমন ঐতিহাসিক তথ্যাবলী থেকে জানা যায় যে, খায়বার অভিযানকালে কয়েকটি নির্দিষ্ট ধরনের গাছ কেটে ফেলা সম্পর্কে আল-হুবাব ইবনুল মুনযিরের (রা.) পরামর্শ তিনি রাসূলে কারীম  (সা.) মেনে নিলেও পরবর্তী পর্যায়ে হযরত আবু বকরের (রা.) ভিন্নতর পরামর্শে তিনি উক্ত সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেন। ঘটনাক্রমে কুরআন উভয় মতের যথার্থতা ও উপযোগিতার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করে। রাসূলে কারীম (সা.) কোন কোন ক্ষেত্রে পরামর্শদাতাদের পরামর্শ শুনেছেন কিন্তু সুদূর প্রসারী চিন্তা-ভাবনা ও সময়োপযোগী কৌশল অবলম্বন করে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করেননি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হৃদাইবিয়ার সন্ধির ব্যাপারে সমস্ত সাহাবী মক্কার কাফিরদের সাথে সন্ধি করার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তিনি সন্ধি করলেন এবং তা কার্যকর করলেন। শেষে সন্ধি করার এ কৌশল গ্রহণ করার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীকালে এটি মুসলমানদের জন্য প্রকাশ্য বিজয়ের রূপ পরিগ্রহ করে। অনুরূপভাবে উসামা ইবন যায়েদকে সেনাপতি বানানোর বিরুদ্ধে বড় বড় সাহাবী মতামত দেন। কিন্তু রাসূলে কারীম (সা.) এ বিষয়ে তাদের বিরোধিতা পরোয়া না করে হযরত উসামাকে (রা.) নিজ হাতে পতাকা দিয়ে বললেন,  ‘‘তুমি রওয়ানা হয়ে যাবে সেখানে, যেখানে তোমার পিতা শহীদ হয়েছেন এবং সেই স্থানের লোকদের অশ্ব ক্ষুরে নিষ্পেষিত করবে। আমি তোমাকে এই বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ নিযুক্ত করলাম।’’ এ সব ঘটনা থেকে পরামর্শ গ্রহণের ব্যাপারে নবী কারীম (সা.) এর এ নীতির সন্ধান মিলে যে, নেতা পরামর্শ চাইবেন সংশ্লিষ্ট লোকেরাও পরামর্শ দিবে; কিন্তু তার নিকট যে পরামর্শ অধিক সঠিক ও কল্যাণকর মনে হবে তা তিনি গ্রহণ করবেন।

নেতা নির্বাচন
তাঁর মুহাদ্দিছ ও আনসার সাহাবীদের নিয়ে যে পরামর্শ সভা গঠন করেন তা মজলিসে সূরা নামে পরিচিতি রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ প্রশাসনিক কাঠামোর রূপরেখা দান রাষ্ট্রীয় পরিচালনার বিভিন্নপন্থা প্রভৃতি বিষয় এ সূরায় নির্ণয় করত। মদীনার মসজিদে এ পরামর্শ পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হত।
মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সুষ্ঠু, সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপরই জনগণের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য একান্তভাবে নির্ভর করে। এ কারণে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তাই রাসূলে কারীম (সা.) রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ করেন। তিনি নেতৃত্ব নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কেবলমাত্র যিনি যোগ্য ও বিশেষজ্ঞ নিরপেক্ষভাবে তাকেই কেবলমাত্র তিনি মনোনীত করতেন। এ ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট কিংবা ক্ষমতা বা পদের জন্য লালায়িত ব্যক্তিকে নেতা নির্বাচন করতেন না। তিনি যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে অনুপম আদর্শ স্থাপন করেছেন তা স্থান-কাল-পাত্রভেদে সকল যুগে সকল মানুষের জন্য এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। এ মর্মে তিনি সকলের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন,  ‘‘আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, আমি এই দায়িত্বপূর্ণ কাজে এমন কোন ব্যক্তিকে নিয়োগ করব না, যে তা পাওয়ার জন্য প্রার্থী হবে, অথবা এমন কাউকেও নয়, যে তা পাওয়ার জন্য লালায়িত হবে।’’

বিচার ব্যবস্থা বিচারকার্য
প্রশাসনিক কর্মদক্ষতার মূর্ত প্রতীক ছিলেন মহানবীরাসূল (সা.)। তিনি  আল্লাহর আইন অনুযায়ী ইনসাফের সাথে বিচারকার্য সম্পাদন করতেন। খোদায়ী বিধানের প্রধান ব্যাখ্যাদাতা হিসেবে তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারপতি। ইমাম আল-কুরতবী, ইবন হিশামসহ খ্যাতনামা পতিগণের পরিবেশিত ঐতিহাসিক তথ্যাবলী থেকে জানা যায় যে, সর্বোচ্চ বিচারক হিসোবে রাসূল (সা.) অসংখ্য মামলার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। অথচ পশ্চিমা পন্ডিতরা যারা ইসলামী বিচার ব্যবস্থাকে আধুনিক বিচার ব্যবস্থার মানদন্ডে বিচার করেন তারা অপপ্রচার করে থাকেন যে, ইসলামের সোনা স্বর্ণালী যুগে বিচার বিভাগের তেমন প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ ঘটেনি। এরূপ ধরনের মিথ্যা ধারণার বিস্তার করার জন পোষণের জন্য তাদের ইসলাম সম্পর্কে তাকে অজ্ঞতাই দায়ী। মুসলিম পন্ডিত ও ফকীহগণ রাসূলের বিচার সম্পর্কে যে বিপুল সংখ্যক গ্রন্থপুস্তক রচনা করেছেন সেগুলোর মাধ্যমেই তার প্রশাসনের এ গুরুত্বপূর্ণ দিকটির মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা অত্যন্ত সহজ। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত লেখক আল-কাত্তাজনী রাসূলের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পর্যায়ের বিচারকদের এক দীর্ঘ তালিকা প্রণয়ন করেছেন।

বিচারের ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) আল্লাহর আইন কার্যকর যেমন কোনরূপ দুর্বলতা দেখাননি তেমনি সে ক্ষেত্রে তিনি কোন সুপারিশও গ্রহণ করেননি। বিচারের কাঠগড়ায় মুসলিম, অ-মুসলিম ছিল সমান। শরী‘য়তের দন্ডাদেশ কার্যকর করার ক্ষেত্রে আল্লাহর আইন জারি করার ব্যাপারে সুপারিশের কথা শুনে তিনি রাগান্বিত হয়েছেন এবং তীব্র ভাষায় তার প্রতিবাদ করেছেন। বর্ণিত আছে যে, মাখযুমী বংশের একজন মহিলা চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত হলে সে  হয়। সে মহিলা রাসূলের (সা.) অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তি উসামা ইবন যায়েদের মাধ্যমে তার দন্ডাদেশ মওকুফ করার ব্যাপারে রাসূলের (সা.) এর নিকট সুপারিশের জন্য অনুরোধ করেন। রাসূল (সা.) তার এ সুপারিশের কথা শুনে উসামাকে ধমক দিয়ে বলেন, আল্লাহ ঘোষিত দন্ড বিধি কার্যকরণের ক্ষেত্রে তুমি কি সুপারিশ করছ? জেনে রাখ!
‘‘আল্লাহর কসম! যদি মুহাম্মদের মেয়ে ফাতেমাও চুরি করত, অবশ্যই আমি তার হাত কেটে দিতাম।’’

আইন প্রয়োগ পদ্ধতি
রাসূলের (সা.) সরকার ও শাসন ব্যবস্থা আল্লাহর আইন ও তাঁর মতাদর্শসুন্নাহ দিয়েই পরিচালিত হত। মানুষের নিত্য-নৈমিত্তিক এবং ব্যবহারিক জীবনে বাস্তব প্রয়োগ ও অনুসরণের জন্যই হলো কুরআন ও সুন্নাহর বিধান। মজলিসে-ই-শূরায় চিন্তা গবেষণা করে পারস্পরিক আলোচনার-পর্যালোচনার মাধ্যমে যে আইনসমুহ ধারাবদ্ধ হয় এর উদ্দেশ্যও একই। এ কারণে  রাষ্ট্রে শরীয়া’হ্  আইনগুলো যথাযথভাবে কার্যকরণের জন্য সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করা অনস্বীকার্য। রাসূল (সা.) আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন এবং ক্ষেত্রে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেন হয়েছেন। তিনি মনে করতেন, শুধু রাষ্ট্র শক্তির সাহায্যে আইন কার্যকর করলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে তা নয়; করা একমাত্র কাজ নয়। বরং সে আইনের ভিত্তিতে ব্যক্তি, সমাজ এবং পরিবার গঠন ও লালনের মাধ্যমে আইন বাস্তবায়ন করাই হল আসল উদ্দেশ্য। এ জন্য তিনি আইন কার্যকর কারার পূর্বেই আইন মানার জন্য যে পরিবেশ ও চরিত্র গঠনের প্রয়োজন তা সুনিশ্চিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ফলে রাষ্ট্রীয়ভাবে আইন মানার প্রবণতার সাথে সাথে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে তা গ্রহণ ও মান্য করার স্পীহা সৃষ্টি হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় আইনের শাসন, মূলোৎপাটিত হয় স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি ও দাম্ভিকতা। ঐতিহাসিক তথ্য বিশে­à¦·à¦£ করলে দেখা যায় যে, আইনের শাসন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) যে কৌশল অবলম্বন করেন তা ছিল অনুকরণীয়। নবুওয়তের পর মক্কায় ইসলামের দাওয়াত দান, এবং মদীনায় হিজরত, এবং তথায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার পর মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত এইসুষম পরিবেশ বিরাজিত না থাকায় তিনি কোন মূর্তি ভাঙ্গার উদ্যোগ নেননি। অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। এবং মানুষকে মূর্তির অর্চনা থেকে মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে ফিরিয়েছেন। কিন্তু তিনি মূর্তি ভাঙ্গেননি। অতঃপর মক্কা যখন বিজিত হলো, গোটা আরব উপদ্বীপে ইসলাম বিরোধী শক্তি আর রইল না। এবং এ ভূ-খন্ডের গোটা পরিবেশ ইসলাম বিরোধীমখিতার আবহাওয়া থেকে মুক্ত হলো। ঠিক তখনই তিনি মক্কার কাবাগৃহে প্রবেশ করে মূর্তিগুলোকে আঘাত করলেন। এবং বলতে লাগলেন, সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত, নিশ্চয় মিথ্যা অপসৃতই হয়ে থাকে।

জবাবদিহিতা শাসকের দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা
রাসূলুল্লাহর (সা.) রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ছিল, শাসন, কর্তৃত্ব এবং তার ক্ষমতা ইখতিয়ার ও এবং অর্থ-সম্পদ আল্লাহ এবং মুসলমানদের আমানত। আল্লাহর ভীরু, ঈমানদার এবং ন্যায় পরায়ন লোকদের হাতে তা ন্যস্ত থাকবে। কেউ ইচ্ছামত বা স্বার্থবুদ্ধি প্রণোদিত হয়ে এ আমানতের খিয়ানত করার অধিকার রাখে না। এ আমানত যাদের হাতে সোপর্দ করা হবে তারা এর দায়িত্ব পালন সম্পর্কে  জবাবদিহি করতে বাধ্য। রাসূলুল্লাহর (সা.) সরকার কাঠামোতে ও প্রশাসনিক পরিমন্ডলে সরকারি যাবতীয় কার্যক্রমের জবাবদিহির প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তিনি আল্লাহর বাণী উচ্চারণের মাধ্যমে তার জবাবদিহিতার বহিঃপ্রকাশ ঘটান এভাবে, ‘‘আমানত বহনের যোগ্য ব্যক্তিদের হাতে আমানত সোপর্দ করার জন্য আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। আর যখন মানুষের মধ্যে ফায়সালা করবে, ন্যায়নীতির সাথে ফায়সালা করবে, আল্লাহ তোমাদেরকে ভাল উপদেশ দিচ্ছেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন।’’ (সূরাহ নিসা: ৫৮)

সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণ
তিনি দায়িত্বশীলদেরকে জবাবদিহিতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সাবধান তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় নেতা - যিনি সকলের উপর শাসক হন তিনিও দায়িত্বশীল। তাঁকেও তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।’’ (বুখারী)

অমুসলিমদের সাথে সম্পর্ক ও সহাবস্থান
রাসূলুল্লাহর  (সা.) রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অমুসলিম সংখ্যা লঘুদের সঙ্গে সম্পর্ক ও সহাবস্থানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। তিনি মদীনায় হিজরতের পর তিনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতি স্থাপন করে এক তুলনাবিহীন রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি রাজনৈতিক ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এবং মুসলিম ও অমুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ভিত্তিতে সহনশীলতার মনোভাব গড়ে তোলার জন্য একটি সনদ প্রণয়ন করেন। এ প্রণীত এ সনদ পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সনদ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। তিনি এর মাধ্যমে তৎকালীন বিশ্বে ধর্ম ও রাজনীতির সমন্বয়ে যে ইসলামী উম্মাহ প্রতিষ্ঠা করেন, উত্তরকালে তা বিশাল ইসলামী সাম্রাজ্যের মহীরুহে পরিণত হয়। তিনি এ সনদ প্রণয়নে যে কৌশল অবলম্বন করেন তাহলো মদীনার বিভিন্ন অমুসলিম সম্প্রদায়কে প্রাথমিকভাবে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সহায়ক শক্তিতে পরিণত করা এবং তাদের ও মুসলামানদে সহঅবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত করা। যাতে ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। তিনি এ সনদের মাধ্যমে যে মহানুভবতা ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পরিচয় দেন তা বিশ্বের ইতিহাসে সত্যই বিরল। তিনি রাসূল (সা.) মুসলমানদের সাথে অমুসলিমদের সহাবস্থান এবং জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা এবং নিজ নিজ ধর্ম পালনে স্বাধীনতা দান করেন। তিনি ঘোষণা দেন, কারো ধর্ম মতে কোনরূপ অসম্মান করা যাবে না এবং সকলেই পরস্পর ভাই ভাই হিসেবে সহাবস্থান করবে। সংখ্যা লঘু অমুসলিমদের অধিকারের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা দেন যে, ‘‘যে লোক কোন যিম্মিকে কষ্ট দিবে আমি তার প্রতিবাদকারী হব।, আর আমি যার প্রতিবাদকারী হব, কিয়ামতের দিন তার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াব।’’

প্রতিরক্ষা ও সামরিক ব্যবস্থা যুদ্ধের নীতিমালা নির্ধারণ
যে কোন নবগঠিত রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা চিরকাল একটি জটিল সমস্যা বলে চিহ্নিত হয়ে থাকে। রাসূল (সা.) এ সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অপূর্ব অসম সাহসিকতা, ও অপূর্ব দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। মদীনায় মাত্র দশ বছরের জীবনে তাকে ছোট বড় তিরাশিটি অভিযান পরিচালনা করতে হয়। এর মধ্যে সাতাশটিতে তিনি নিজেই সেনাপতির ভূমিকা পালন করেন। অবশ্য এর মধ্যে মাত্র নয়টি যুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাত ঘটে। এবং এর প্রত্যেকটিতেই এসব যুদ্ধে বিজয় অর্জন রাসূলের (সা.) অপূর্ব যুদ্ধকৌশলের বারতা বহন করে। রাসূলের জীবনে সংঘটিত এই যুদ্ধগুলো ছিল প্রতিরক্ষামূলক। কেননা তিনি যুদ্ধবাজ ছিলেন না। ছিলেন না সাম্রাজ্যবাদী। উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে হামলাও করেননি তিনি; বরং শত্রুপক্ষের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য আত্ম‘রক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বাতিল শক্তির বহুবধি হুমকি ও বিপদের মুখে মদীনার শিশু ইসলামী রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্য তিনি রাসূল  (সা.) একদিকে যেমনদক্ষ সামরিক সংগঠন ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলেন। অতি অল্প সময়ে বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে এ সংগঠন যথারীতি এক উন্নত সেনাবাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অপরদিকে তেমনি এক অভিনব রণকৌশল অনুসরণ করেন। ফলে তিনি তার এ সেনা সংগঠনের সহযোগিতায় সমগ্র আরব উপদ্বীপ তাঁর পদানত হয়। রাসূল (সা.) রণক্ষেত্রে অভিনব কৌশল অনুসরণ করেন।  মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের সামরিক সংগঠন রাসূলের (সা.) জীবনকালের এক দশক সময়কালের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে যথারীতি এক উন্নত সেনাবাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। রাসূল (সা.) কোন অভিযান প্রেরণকালে তিনি কমান্ডারদেরকে অভিযানের সহায়ক দিক নির্দেশনা এবং এর কৌশল ব্যাখ্যা করতেন। তিনি রণক্ষেত্রে যে সমস্ত কৌশল অবলম্বনের নির্দেশ দিতেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, রাতের বেলায় অগ্রসর হওয়া, শত্রুকে অপ্রস্ত্তত অবস্থায় আক্রমণ করা, গুপ্তচর ও পর্যবেক্ষণকারীর সাহায্য গ্রহণ, শত্রুদের যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, তাদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে শিবির স্থাপন, চতুর্দিক থেকে তাদেরকে বেষ্টন করা, ভোরে তাদের উপর আক্রমণ চালানো, যুদ্ধাভিযানে গমণকালে গোপনীয়তা অবলম্বন। এ ছাড়া রাসূল (সা.) শত্রু বাহিনীর হামলা ও কৌশল কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার লক্ষ্যে মুসলিম বাহিনীকে কেন্দ্র, দক্ষিণবাহবাহু, বামবাহু, অগ্রবর্তী বাহিনী ও পশ্চাদরক্ষী এ পাঁচটি বাহিনীতে  ভাগে বিভক্ত করতেন। এ পদ্ধতি শত্রু বাহিনীর জন্য ছিল ভীতিকর। প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিক ইবন খালদুন রাসূলের (সা.) এ যুদ্ধ কৌশলকে এমন এক রণপদ্ধতি হিসেবে বর্ণনা করেছেন যে, এ পদ্ধতিতে সেনাবাহিনী নামাযের সারির মত বিভিন্ন সারিতে বিভক্ত হয়ে যায় যা দেখা মাত্রই শত্রু বাহিনীর মধ্যে প্রচন্ড ভীতির সঞ্চার হত।

শিক্ষানীতি
শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতিষ্ঠিত মদীনার এ ইসলামী রাষ্ট্রে এ কথার বাস্তব রূপায়ন দেখতে পাওয়া যায়। তিনি যে যুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন সে যুগ ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। ইসলামের ইতিহাসের পরিভাষায় এ যুগকে অজ্ঞতার যুগ বলা হয়ে থাকে। রাসূল (সা.) এ রাষ্ট্রের মাধ্যমে অজ্ঞতার এই ঘোর অমানিশাকে দূরীভূত করেন। তিনি বিদ্যা শিক্ষা করাকে বাধ্যতামূলক করেন। কারণ বিদ্যান বা জ্ঞানীরাই সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, এমনকি রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। আর প্রতিটি মুসলমান এ সকল বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে না পারলে আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ ইবাদতও সম্ভব নয়। তাই তিনি সাধারণভাবে সকল শ্রেণীর লোকদেরকে জ্ঞানার্জনের প্রতি অনুপ্রাণিত করেন। মদীনার মসজিদ কেন্দ্রিক জ্ঞান লাভের যে বিদ্যানিকেতন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, পরবর্তীকালে সেখান থেকেই শিক্ষা কার্যক্রমের শ্রোতধারা সমগ্র পৃথিবীতে প্রবাহিত হয়। তিনি রাষ্ট্রের শিক্ষিত ব্যক্তিদেরকে যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে অভিসিক্ত করেন।

পররাষ্ট্রনীতি
রাসূল (সা.) ছিলেন অবিসংবাদিত বিশ্বনেতা ও সফল রাষ্ট্র নায়ক। তাই নির্দিষ্ট কোন ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে ইসলামী নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব সীমাবদ্ধ থাকবে তা তিনি চাননি। এর সম্প্রসারণের কৌশল হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে আরব উপদ্বীপের বাইরের অঞ্চলগুলোতে একদিকে যেমন তিনি  লোক প্রেরণ করে ইসলামী দাওয়াতের সর্বজনীনতা নিশ্চিত করেছেন। অপরদিকে তেমনি বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রধানদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বৈদেশিক নীতির ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেন। পাশ্চাত্য সভ্যতা উদয়ের বহু বছর পূর্বে একমাত্র রাসূলই (সা.) রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা বৈদেশিক বা পররাষ্ট্রনীতি উদ্ভাবন করেন।

রাসূলের (সা:) রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলনা বরং তা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ব্যাপকতা লাভ করে। তার যে দল এ ইসলামী আন্দোলন পরিচালনার সৌভাগ্য লাভ করেছিল তা শ্রেষ্ঠ দল হিসেবে সারা পৃথিবীর ও সর্বকালীন মানবজাতীর কল্যাণার্থে আর্বিভূত হয়েছিল। সমগ্র মানবজাতিকে সত্য, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, ইনসাফ ও সৌভ্রাতৃত্বের বিধান বাস্তবায়নের পথ প্রদর্শক বানানো হয়েছিল। শুধু আরবদের সংস্কার সংশোধন এবং তাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সংঘবদ্ধ করাই তাঁর চূড়ান্ত ও সর্বশেষ লক্ষ্য ছিল না; বরং তার লক্ষ্য ছিল একটি ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করা এবং যাবতীয় উপায় উপকরণকে কাজে লাগিয়ে সারা পৃথিবীর সকল জাতি ও দেশকে ইসলামী বিধান বাস্তবায়নের আহবান জানানো। ঐ রাজতান্ত্রিক যুগে আল্লাহর যে কোটি কোটি বান্দা ছোট ছোট শ্রেণী ও পরিবারের গোলামীর যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিল, যাদের না ছিল বিচার স্বাধীনতা, না ছিল অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এবং না ছিল কোন রাজনৈতিক অধিকার। তাদের নির্যাতিত নিষ্পেষিত অবস্থা সম্পর্কে কোন সংস্কারমূলক আন্দোলন কিভাবে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে। পারস্য সম্রাটের কাছে লেখা চিঠিতে রাসূল (সা.) নিজেই স্বীয় দাওয়াতের আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলকে এ বলে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন যে, ‘‘আমি সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে আল্লাহর প্রেরিত দূত বা রসূল।’’
রাসূল (সা.) সমকালীন রাজা বাদশাহদেরকে চিঠি লিখতে গিয়ে একদিকে তিনি যেমন প্রচলিত রীতিনীতি মেনে চলতেন, অর্থাৎ সিল মারার জন্য আংটি তৈরি করান এবং তাতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ শব্দটা খোদাই করান। অপরদিকে তেমনি নিজের একটা স্বতন্ত্র রীতি ও পদ্ধতি চালু করেন। প্রত্যেক চিঠি বিস্মিল্লাহির রহমানির রাহীম দিয়ে শুরু করতেন। অতএব প্রেরক হিসেবে নিজের নাম এবং যাকে চিঠি পাঠান তার নাম লেখাতেন। অতপর ন্যূনতম, অত্যন্ত মাপাজোকা ও সতর্ক ভাষায় বক্তব্য তুলে ধরতেন। সেই যুগের প্রেক্ষাপটে যে কূটনৈতিক ভাষা তিনি চিঠির জন্য অবলম্বন করেন তা রাসূলের (সা.) মানসিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ বহন করে। যেমন তিনি এ সব চিঠিতে অতি সংক্ষেপে এ বাক্যটি ব্যবহার করেন যে, ‘‘ইসলাম গ্রহণ করুন শান্তি পাবেন।’’ এর আরো একটি অর্থ এও হতে পারে হয় যে, আনুগত্য করন শান্তি পাবেন।

অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
রাসূল (সা.) তাঁর প্রশাসন ও সরকার কাঠামোকে সুদৃঢ় করার জন্য এক সুষম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি সরকারিভাবে কুসিদপ্রথা বন্ধ করার মাধ্যমে পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূলে কুঠারাঘাত করেন। আল-কুরআনের নির্দেশ মোতাবেক তিনি যাকাত ও সাদাকাহ্র বিধান প্রবর্তন করেন। ইসলামী রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে যাকাত আদায় না করে রাষ্ট্রীয়ভাবে তা আদায় করার জন্য বেতনভুক্ত ‘আমিল নিযুক্ত করেন। ফলে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যাকাত অনাদায়ের প্রবণতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

উপসংহার
রাসূল (সা.) রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় একনায়কতন্ত্রের পরিবর্তে প্রজাতন্ত্র, কৌলিণ্যের পরিবর্তে প্রগাঢ় ধর্ম বিশ্বাস, গোত্রপ্রীতি ও জাতীয়তাবাদের স্থলে ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ এবং রক্তপাতের পরিবর্তে শান্তির নীতি ও পলিসি গ্রহণ করেন। তিনি করার জন্য রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক ও পরিসিলসিগত কার্যসূচি প্রণয়ন করেন। তিনি তাদেরকে ইসলামী বিধান ও আইন কানুনে সম্পর্কে ব্যাপক শিক্ষা দান করেন। ইসলাম কর্তৃক উপস্থাপিত নৈতিক আদর্শ ও রীতিনীতি সম্পর্কে-যা কুরআনে মৌলিক শিক্ষা তাদেরকে তিনি পূর্ণমাত্রায় অবহিত করেছিলেন। জনগণের বিবাদ মীমাংসা, তাদের সমস্যা সমাধান এবং যুলুম ও সীমা লংঘনমূলক কার্যক্রমের বিচার পদ্ধতি শিক্ষা দান করেছিলেন। যাকাত ও অন্যান্য করসমূহ আদায় করা এবং তা পাওয়ার যোগ্য অধিকারী লোকদের মধ্যে যথাযথভাবে বণ্টনের নিয়ম সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করেন। এক কথায় যাবতীয় জনকল্যাণমূলক কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে তিনি তাদেরকে নিজ নিজ দায়িত্বে বসিয়েছিলেন। জনগণের বিবাদ মীমাংসা, তাদের সমস্যা সমাধান এবং যুলুম ও সীমা লংঘনমূলক কার্যক্রমের বিচার পদ্ধতি শিক্ষা দান করেছিলেন। আধুনিককালের রাষ্ট্র নেতা ও শাসন কর্তৃপক্ষকে প্রতিষ্ঠানগতভাবে যে যে কাজ করতে হয় এবং পলিসি গ্রহণ করতে হয় রাসূল (সা.) সে সব কাজ করেছেন এবং সে পলিসিও গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তা তিনি করেছেন নিজের ইচ্ছামত নয় বরং আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী। তাই তার প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র যেমন সর্বোত্তম তেমনি দুনিয়ার সকল মানুষের জন্য তা অনুসরণীয় আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থা। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তার প্রতিষ্ঠিত সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুসরণীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা। আজ সারা বিশ্ব এক চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। শাসকরা জনকল্যাণমূখী রাষ্ট্র পরিচালনার পরিবর্তে জনগণের সাথে প্রতারণার কৌশল গ্রহণ করছে। বিশ্ব মোড়লদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমরনীতি প্রভৃতি আজ দরিদ্র-ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোকে গ্রাস করতে বসেছে। শতধা বিভক্ত, ইসলামী নীতি বজি©à¦°à§à¦¤ মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানগণও আজ রাক্ষুসে রাষ্ট্রগুলোর পদলেহনে ব্যস্ত। বিশ্বের সর্বত্রই অশান্তির দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলছে। দিশেহারা বিশ্ববাসী প্রচলিত রাষ্ট্রনীতি প্রত্যাখ্যান করে নতুন একটি রাষ্ট্রনীতির সন্ধানে ব্যগ্র। অশান্ত এই পৃথিবীতে আল্লাহর কিতাবের আলোকে পরিচালিত রাসূল (সা.) এর রাষ্ট্র পরিচালনা কৌশলই শান্তির সুবাতাস বইয়ে দিতে পারে।
লেখক : প্রফেসর ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

এ পাতার অন্যান্য খবর

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।