রহমানের বান্দার পরিচয় : পর্ব-৫
বাইয়াত বা আনুগত্যের শপথের আলোকে জীবন পরিচালনা
॥ ড. মুহাম্মদ খলিলুর রহমান ॥
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
উপরোক্ত হাদিস শরীফ থেকে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, মুসলিম মিল্লাতের আমীর মুয়াবিয়া রা. নিকট ইলমে তাসাউফ অর্জনের জন্য পীর হিসেবে কেউ বাইয়াত নেন নাই, বরং আমীর হিসেবেই বাইয়াত নিয়েছিলেন সাহাবায়ে কিরাম রা.গণ। আর এটাই ফরজ বাইয়াত যেখানে মুসলিম মিল্লাতের আমীরের হাতে ঐ এলাকায় থাকা কোটি কোটি মুরিদের যদি হাজার হাজার পিরও বিদ্যমান থাকেন। বিষয়টা আরো ক্লিয়ার হয়ে যাবে এই হাদিসের দ্বারা। ‘ইরবাদ বিন সারিয়াহ রা. থেকে বর্ণিত। একদিন রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের মাঝে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় আমাদের নসীহত করেন, যাতে আমাদের অন্তরসমূহ ভীত হলো এবং চোখগুলো অশ্রু বর্ষণ করলো। উনাকে বলা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ সা.! মনে হচ্ছে বিদায়কালীন উপদেশ দিচ্ছেন? অতএব আমাদের নিকট থেকে একটি প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করুন (একটি সুনির্দিষ্ট আদেশ দিন)। তিনি বলেন, তোমরা আল্লাহ্ভীতি (অর্থাৎ তাকওয়া পরহেজগারিতা) অবলম্বন করো, শ্রবণ করো ও আনুগত্য করো (আমীরের-আদেশ), যদিও সে আবিসিনিয়ান (কাফরী) গোলাম হয়। (সুনানে ইবনে মাজাহ ৪২, তিরমিযী শরীফ : ১৭০৬, ২৬৭৬, রিয়াদুস সালেহীন ১৫৭, ৭০১) আহ কি একটা অবস্থা ভাবা যায়? শ্রবণ করো ও আনুগত্য করো।
মুসলিম মিল্লাতের বাইয়াত গ্রহণকারী দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. বলেন, আমার শাসনামলে ফুরাতের তীরে যদি একটি ছাগল ও অনাহারে মারা যায়, তাহলে কিয়ামতের ময়দানে আমাকে মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট এর জবাবদিহি করা লাগবে বলে মনে করি। (হিলিয়াতুল আউলিয়া ১৩৭)। এ হলো ধর্মব্যবসায়ী ভণ্ড পীর আর ইসলামিক খিলাফতের আমীরের নিকট বাইয়াতের তফাৎ।
বাইয়াতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা:-
রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, আর আনুগত্য দেখাতে অসিয়ত করছি; যদি কোনো হাবশি গোলাম ও তোমাদের আমীর হয় তবুও। (সুনান ইবনে মাজাহ : ৪২)।
খিলাফতের পতনের পর জাহেলি রাজনীতির কবলে অধিকাংশ মুসলিম দেশ আক্রান্ত হয়ে আছে। মুসলিমদের বিরাট একটি অংশ জাহেলি রাজনীতিকে গ্রহণ করে নিয়েছে দুনিয়া পরিচালনার জন্য। অন্যদিকে ক্ষুদ্র একটি অংশ বিদ’আতি রাজনৈতিক দল গঠন করে আন্দোলন করে আসছে দীন কায়েমের আশায়। ফলে কাক্সিক্ষত ইসলামিক খিলাফত; এমনকি কোনো রাষ্ট্রে শরিয়া প্রতিষ্ঠার সুযোগ তারা আজ পর্যন্ত পায়নি। ইবলিসের ধোঁকায় পড়ে সিয়াসাহ শারঈয়্যাহ বা শারঈ রাজনীতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকাও তাদের ব্যর্থতার বড় একটি কারণ।
শারঈ রাজনীতির তিনটি ধারাবাহিক পর্যায়সমূহ
১. মহান আল্লাহ তায়ালার দিকে দাওয়াত দান। কোনো দল, গোষ্ঠী, জাতির দিকে নয়। কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর দাওয়াত মানুষের সামনে উপস্থাপন করা।
২. বাইয়াতের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত খিলাফত গঠন করে খলিফাতুল মুসলিমীন/ইমামুল মুসলিমীন/আমীরুল মুমিনীন-এর আনুগত্য করা। আর তা সম্ভব না হলে কোনো রাষ্ট্রেও যদি শরিয়া প্রতিষ্ঠা করা যায় সে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া আবশ্যক তবে তা কোনো কুফরি পন্থায় নয়।
৩. রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী শরিয়াতের পূর্ণ বাস্তবায়ন করা। কারণ মহান আল্লাহ পাক আল কুরআনে এটাই বলেছেন, হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা মহান আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য করো, আনুগত্য করো রাসূলুল্লাহ সা.-এর এবং সেসব লোকদের, যারা উলিল আমর, অতঃপর কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে যদি ইখতেলাফের সৃষ্টি হয়, তাহলে সে বিষয়টি (ফয়সালার জন্য) মহান আল্লাহ তায়ালা ও রাসূলুল্লাহ সা.-এর দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও, যদি তোমরা মহান আল্লাহ তায়ালার ওপর এবং কিয়ামতের দিনের ওপর ঈমান এনে থাকো! (আর) এ (পদ্ধতিই) হচ্ছে (বিরোধ মীমাংসার) সর্বোৎকৃষ্ট উপায় এবং পরিণামের দিক থেকেও (এটি) হচ্ছে সর্বোত্তম পন্থা। (সূরা নিসা : ৫৯)। আয়াতে উল্লেখিত ‘উলুল আমর’ আভিধানিক অর্থে সেসব লোককে বলা হয়, যাদের হাতে ইসলামিক সালতানাত পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত থাকে, যেমন খিলাফতের দায়িত্বে থাকা আমীর। এছাড়া ‘উলুল আমর’ দীনের হাকিকি জ্ঞান অর্জনকারী মুত্তাকি পরহেজগার উলামা ও ফুকাহাগণকেও বলা হয়ে থাকে।
মহান আল্লাহ তায়ালা ও রাসূলুল্লাহ সা.-এর দিকে প্রত্যাবর্তন করার অর্থ হলো, উনার কিতাবের দিকে প্রত্যাবর্তন করা। আর রাসূল সা.-এর বিছল শরীফের (অফাত) পর উনার দিকে প্রত্যাবর্তন করার অর্থ হলো উনার সুন্নতের দিকে প্রত্যাবর্তন করা।
মহান আল্লাহ তায়ালা আল কুরআনে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সা.-এর অনুসরণ ও উনার পথকে আঁকড়ে ধরে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া তিনি আমাদেরকে জামাতবদ্ধ থাকতে ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের আদেশ করেছেন। দলাদলি ও মতবিরোধ করা থেকে নিষেধ করেছেন। তোমরা সম্মিলিতভাবে মহান আল্লাহ তায়ালার রজ্জুকে (অর্থাৎ মহান আল্লাহ তায়ালার দীন ও কিতাবুল্লাকে) আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না (সূরা আলে ইমরান আলাইহিস সালাম : ১০৩)। তিনি আরো বলেন, নিশ্চয়ই যারা নিজেদের দ্বীনকে খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত করেছে। আর দলে দলে ভাগ হয়ে গেছে তাদের কোনো কাজের সাথে আপনার কোনো সম্পর্কই নেই। তাদের বিষয় মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট, (সময় হলেই) তিনি তাদেরকে জানিয়ে দেবেন তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে। (সূরা আল আন’আম : ১৫৯)। এছাড়া মহান আল্লাহ পাক স্পষ্ট বলে দিয়েছেন মুসলিমদের যে, দলে দলে বিভক্ত হওয়া এবং উল্লসিত হওয়া মূলত মুশরিকদের তরিকা। (সূরা রূম ৩০ : ৩১-৩২)। কারণ আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল সা.-কে বলতে শুনেছি, পৃথিবীতে) আগমনকারী হিসেবে আমরা সর্বশেষ হলেও সর্বাগ্রে (জান্নাতে) প্রবেশকারী (হবো)। আর যে আমার আনুগত্য করল, সে মহান আল্লাহ তায়ালারই আনুগত্য করল, যে আমার নাফরমানি করল, সে মহান আল্লাহ তায়ালারই নাফরমানি করল। আর যে আমীরের আনুগত্যে খিলাফত ও বাইয়াত গ্রহণ করল, সে আমারই আনুগত্য করলো। আর যে আমীরের নাফরমানি করল, সে আমারই নাফরমানি করল। ইমাম তো ঢালস্বরূপ। উনার নেতৃত্বে জিহাদ এবং উনারই মাধ্যমে নিরাপত্তা অর্জন করা হয়। অতঃপর যদি তিনি (খলিফা/আমীর/ইমাম) মহান আল্লাহ তায়ালার তাকওয়ার (বিষয়ে) নির্দেশ দেয় এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠা করেন, তবে উনার জন্য (আখিরাতে) রয়েছে পুরষ্কার, আর যদি তিনি এর বিপরীত করেন তবে এর মন্দ পরিণাম তার ওপরই বর্তাবে। (বুখারী শরীফ ২৯৫৬, ২৯৫৭)। আর এ আমীর ও ইসলামিক ফরজ বাইয়াতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা কেবল তখনই সম্ভব, যখন মানুষ সম্মিলিতভাবে দীন পালনের নিমিত্তে জামাতবদ্ধ হয়ে নির্দিষ্ট একটি স্থানে একত্রে বসবাস করবে। কারণ জামায়াতবিহীন একা একা দীন পালন করে হিদায়েত লাভ করা যাবে না। ‘জুমার দিনে যখন নামাযের জন্য ডাকা হয়, তখন আল্লাহ্র জিকিরের দিকে দৌড়াও এবং বেচা-কেনা বাদ দাও।’ সূরা জুমা : ৯)।
সেসব লোক যাদেরকে ব্যবসা, বেচা কেনা ও কাজ কারবার ইত্যাদি কোনো কিছুই আল্লাহ্র জিকির থেকে গাফেল করে দেয় না। সূরা নুর:৩৭
এ দুটি আয়াতে জীবিকা অর্জনের সব রকম ব্যাবস্থাকেই বাইয় শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে।
রাসূল (সা.)-এর হাতে সাহাবারা বিভিন্ন বিষয়ে বাইয়াত হতেন। কখনো জিহাদের জন্য বাইয়াত হতেন। আমৃত্যু দুশমনের সঙ্গে লড়াই করার জন্য রাসূল (সা.) এর হাতে রেখে বাইয়াত হতেন। নামায, যাকাত ও সাধারণ মুসলমানদের জন্য কল্যাণকামনার বিষয়েও বাইয়াত হওয়ার ঘটনা হাদিসে পাওয়া যায়। যেমন- সহিহ বুখারীতে হজরত জারির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.)-এর ঘটনা এসেছে। তিনি বলেন, ‘আমি রাসূল (সা.) এর হাতে বাইয়াত হয়েছি এ বিষয়ে যে, নামায কায়েম করবো, যাকাত দেবো ও সব মুসলমানের কল্যাণ কামনা করব।’ (সহিহ বুখারী)।
যেমন সূরা মুমতাহিনায় এসেছে, ‘হে নবী! যখন মুমিন নারীরা আপনার কাছে এ মর্মে বাইয়াত হওয়ার জন্য আসে যে, তারা কোনো কিছুকে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, নিজেদের সন্তানদের হত্যা করবে না, নিজেদের হাত-পায়ের মাঝে বানিয়ে কোনো অপবাদ রটাবে না এবং কোনো ভালো কাজে আপনার নাফরমানি করবে না তখন আপনি তাদেরকে বাইয়াত করে নিন এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন।’ (আয়াত নম্বর: ১২)। এ আয়াত থেকে কয়েকটি বিষয় বুঝে আসে। (চলবে)
এ পাতার অন্যান্য খবর
এ বিভাগ বা পাতায় আর কোন সংবাদ, কবিতা বা অন্যকোন ধরণের লেখা পাওয়া যায়নি।