সারা দেশে চলছে তীব্র তাপদাহ। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, পৃথিবীর তাপমাত্রা ঊর্ধ্বমুখী এবং প্রতি বছরই বাড়ছে। সাথে সাথে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বিপদও বাড়ছে। জনজীবনে পড়ছে দুঃসহ প্রভাব। বিশেষ করে তাপদাহের সাথে সাথে লোডশেডিং বাড়ায় হুমকির মুখে পড়ছে কৃষিসহ অন্যান্য উৎপাদনশীল খাত। তীব্র তাপদাহের মধ্যেও বিদ্যুতের অভাবে ফ্যান, লাইট, এসি চালাতে পারছে না গরমে অতিষ্ঠ মানুষ। বিদ্যুৎ বিভাগ ও আবহাওয়া অধিদফতরের পক্ষ থেকেও নেই কোনো সুসংবাদ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবী উত্তপ্ত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণগুলো মনুষ্যসৃষ্ট; বিশেষ করে শিল্পবিপ্লবের উপজাতক হিসেবে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন ও জলবায়ু পরিবর্তন। এছাড়া ‘এল নিনো’ও একটা কারণ। এল নিনো এমন এক প্রাকৃতিক ঘটনা, যা প্রতি দুই থেকে সাত বছর অন্তর ঘটে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এল নিনোর কারণে মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতা অস্থায়ীভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে পৃথিবীর নানা প্রান্তে তৈরি হতে পারে খাদ্য, পানি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার ঝুঁকি। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম তাপমাত্রা রেকর্ড করা শুরু হয় ১৮৫০ সালে। সেই শুরুর সময় থেকে নিকট অতীত ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২৩ সাল ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের উষ্ণতম বছর। এমনটাই বলছে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাসাগরীয় ও বায়ুমণ্ডলীয় প্রশাসন (এনওএএ), মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসাসহ পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য আবহাওয়া পর্যবেক্ষক সংস্থা। গবেষকরা বলছেন, তাপমাত্রায় ২০২৩-কেও ছাড়িয়ে যেতে পারে ২০২৪। এ বছরের তাপদাহ বেশকিছু রেকর্ডে ভাগ বসাতে পারেÑ বলছে এনওএএ। সংস্থাটির মতে, শতকরা ৯৯ দশমিক ৯ ভাগ আশঙ্কা আছে, ২০২৪ গরম আবহাওয়ার বছরগুলোর মধ্যে শীর্ষ ১০-এ থাকবে। শতকরার ভাগ একটু কমিয়ে ৯৯ দশমিক ১-এ আনলে শীর্ষ পাঁচে অবস্থানের জোর ইঙ্গিত করছেন গবেষকরা। সাম্প্রতিক সময়ের আবহাওয়া বিশ্লেষণ ও উল্লেখযোগ্য তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রায় ৩৩ ভাগ আশঙ্কা আছে, তাপমাত্রা ২০২৩-কে ছাড়িয়ে যাবে। এনওএএ’র প্রধান বিজ্ঞানী সারা ক্যাপনিকের কাছে এসব পরিস্থিতি রীতিমতো স্তম্ভিত হওয়ার মতো। তিনি মনে করেন, কার্বন নিঃসরণ একেবারে শূন্য না হওয়া পর্যন্ত গরম বাড়বে এবং প্রতি বছরই আগের রেকর্ড ভাঙবে। গত বছরের চরম আবহাওয়া সৃষ্ট দাবানল, খরা, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘটনাগুলো এবার আরও বাড়তে পারে। তাই সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী ও গবেষকদের পরামর্শ, পরিবেশ বিপর্যয় রোধে কাজ করতে হবে সম্ভাব্য সব পর্যায় থেকেই। সাধারণ মানুষকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলাও শিখতে হবে। প্রয়োজনে নিতে হবে বিশেষজ্ঞের মতামত।
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন বলছে, বছরের পর বছর রাজধানীর তাপমাত্রা বাড়তে থাকলেও তা নিয়ন্ত্রণে নেই তেমন কোনো উদ্যোগ। তাপদাহ তীব্র হলেও তা আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নেয়নি নগর কর্তৃপক্ষ। আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস, চলতি মাসেই চল্লিশ ছুঁতে পারে ঢাকার তাপমাত্রা। এমন অবস্থায় বিদ্যুৎ সংকট দূর এবং লোডশেডিং কমানো না গেলে জনজীবনে সহজে স্বস্তি ফিরবে না। গরমের কারণে হিটস্ট্রোকসহ বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। গ্যাস সরবরাহ কম হওয়ার কারণে বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট বিভাগ জানিয়েছে। ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে। আমাদের এখানে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। আর এখন গরম বাড়ছে। যে কারণে লোডশেডিং বাড়ছে। পিডিবির কর্মকর্তারা বলেন, চাহিদার চেয়ে গ্যাসের সরবরাহ কম হওয়ায় গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোও পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। এতে কিছুটা ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় দৈনিক অন্তত ২৩২ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই চাহিদামাফিক গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় সক্ষমতার অর্ধেকও উৎপাদন হচ্ছে না। বর্তমানে সরবরাহ করা হচ্ছে ৮৭-৮৮ কোটি ঘনফুট। গ্রীষ্মে পিডিবি অন্তত ১৫০ কোটি ঘনফুট সরবরাহের দাবি জানিয়েছে পেট্রোবাংলার কাছে।
প্রথম সাত দিনের বিশেষ সচেতনতা ক্যাম্পেইন নিয়ে মাঠে নামছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। গত বছরই চিফ হিট অফিসার নিয়োগ দিয়েছে ডিএনসিসি। এবার সাত দিনের বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামছেন তারা। তাছাড়া পরামর্শ দিচ্ছেন বেশি করে পানি পান, শ্রমজীবীদের ঘাড় আর মুখে ভেজা কাপড় দিয়ে বার বার মোছা, সুযোগ হলেই ছায়ায় একটু বিশ্রাম, দীর্ঘ মেয়াদে সবুজায়নের পাশাপাশি নগরজুড়ে শেড নির্মাণের। লক্ষ্য এ বছর অন্তত হিটস্ট্রোক শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা। যুক্তরাষ্ট্রের আর্শট রক ফাউন্ডেশনের সিএইচও বুশরা আফরিন বলেন, সচেতন থাকলে গরমে মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব। এজন্য গরমে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে ব্যাগে পানির বোতল, টুপি, পাখা, ছাতা থাকলে অনেকটা সুরক্ষিত থাকা যায়।
আমরা মনে করি, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। জনগণকে সচেতন করার সাথে সাথে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো এবং তাপমাত্রা বাড়ার কারণগুলা চিহ্নিত করে তা বন্ধ করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ পাতার অন্যান্য খবর
এ বিভাগ বা পাতায় আর কোন সংবাদ, কবিতা বা অন্যকোন ধরণের লেখা পাওয়া যায়নি।