লেনদেন হবে চীনা মুদ্রায়, খুলতে পারবে এলসি
॥ উসমান ফারুক ॥
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে লেনদেন করতে মোট ১১টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ একটি হিসাব ছিল। আর পাঁচটি মুদ্রাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই তালিকায় যুক্ত হলো চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও চীনা মুদ্রা ইউয়ান। এতে করে চীনের সঙ্গে সরাসরি লেনদেন করতে পারবে বাংলাদেশ। এতদিন ডলারের মাধ্যমে বহুজাতিক বা তৃতীয় কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করতে হতো। সরাসরি ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করায় বাংলাদেশের রিজার্ভের একটি অংশ থাকবে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থা সুইফটের বদলে চীনের সিআইপিএস ব্যবহার করতে চুক্তি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। চুক্তির প্রস্তুতি নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল চীন ঘুরে এসেছে। আর লেনদেন করতে ইতোমধ্যে ইউয়ানকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনলাইন লেনদেন ব্যবস্থা আরটিজিএস সিস্টেমে যুক্ত করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের ভেতরে ও বিদেশে ইউয়ান মুদ্রায় লেনদেন করতে পারছে ব্যাংকগুলো। খোলা যাচ্ছে ব্যাংক হিসাব ও এলসি (ঋণপত্র)। ব্যবসায়ীরা ইউয়ান মুদ্রা দিয়ে আমদানি-রপ্তানি করতে পারছেন। আর্থিক ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হতে বাংলাদেশে শাখা খোলার প্রক্রিয়া শুরু করেছে চীনা ব্যাংক।
জানা গেছে, মূলত যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা দেশগুলোর সঙ্গে লেনদেন করতে বাংলাদেশকে ব্যবস্থা করে দেবে চীন। ডলারের বিকল্প বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা চীনা উদ্যোগ আরো সম্প্রসারিত হবে এর মাধ্যমে। এভাবে ডলারমুক্ত বিকল্প বাণিজ্য ব্যবস্থার অংশ হতে বাংলাদেশকে পাশে পাচ্ছে চীন।
অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে চলমান চীনের হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের অর্থ লেনদেনে ইউয়ান ব্যবহৃত হবে। এতে করে বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় চীনের অংশীদারিত্ব বাড়বে দিন দিন। যেকোনো দেশের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় প্রথমেই তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত হতে হয়। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এখন একশত কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ঋণের এ বড় বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে এগিয়ে আসছে চীন।
এজন্য বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে নাজুক হওয়া বাংলাদেশকে ইউয়ানে ধার দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে চীনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা নতুন ব্যাংক এআইআইবি (এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক)। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, ঋণ দিতে চীনের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ঘুরে গেছে। তারা এখনই ঋণ দিতে চায়। অর্থ নিয়ে পরে প্রকল্প জমা দিতে বলেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ যখন চাইবে, তখনই ঋণ নিতে পারবে।
বাংলাদেশকে এমন সময়ে চীন ঋণ দিতে চাচ্ছে, যখন ডলারের জোগান কমে যাওয়ায় গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে আমদানি কমে আসছে। আবার পুরনো ঋণ পরিশোধের চাপও বাড়ছে দিন দিন। এমন প্রেক্ষাপটে মেগা প্রকল্পের বিপরীতে নেওয়া ঋণ পরিশোধের বড় ধাক্কা আসছে আগামী ২০২৬ সাল থেকে। একদিকে নতুন ডলার না আসা; অন্যদিকে পুরনো ঋণ পরিশোধের চাপে রয়েছে বাংলাদেশ।
২০০২ সালে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দুই বিলিয়ন ডলার ছিল। কিন্তু তখনো বাংলাদেশ ডলার ও নগদ টাকার সংকটে ভোগেনি। এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সঠিক নীতিতে থাকা। পরবর্তীতে ২০২১ সালে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে রিজার্ভ উঠলে আর্থিক ব্যবস্থাপনা নাজুক হয়ে যায় বাংলাদেশের। গণতান্ত্রিক সংকট তীব্র দেখা দেওয়া ও সরকারের ভুল নীতির কারণে রিজার্ভ এখন ১৬ বিলয়ন ডলারের ঘরে নেমেছে। ডলার সংকটে ভুগছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ২১টি ব্যাংক এখন ডলার সংকটে ভুগছে। ডলারের বিপরীতে টাকার পতন হচ্ছে দিন দিন। অর্থনীতির এ অবস্থা থেকে বের হওয়ার বিকল্প প্রধান উপায় হচ্ছে সহজ ও স্বল্প সুদে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ। বাংলাদেশের এ অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ নিয়ে হাজির হয়েছে চীন।
চীনের সিআইপিএস ব্যবহার করবে বাংলাদেশ
আন্তর্জাতিক লেনদেনে সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার-ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন-টিই) সিস্টেম ব্যবহৃত হয়ে আসছে সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে নিরাপদ হওয়ায় এ সিস্টেম এখনো ব্যবহার করছে সব দেশ। পাশাপাশি কয়েকটি দেশ বিকল্প নেটওয়ার্ক ব্যবহার করলেও তা খুবই স্বল্প পরিসরে। শুধু দুই দেশের মধ্যে লেনদেন নিষ্পত্তিতে নিজেদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে থাকে। এতে ঝুঁকির দিক হলো কোনো সমস্যা দেখা দিলে আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী সমাধান করতে পারবে না। ফলে দুর্বল দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কিন্তু সুইফট সিস্টেমের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ হলে তা ডকুমেন্টনির্ভর হয়। এতে দুই দেশের মধ্যে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী সমাধান হয়। এজন্য বর্তমান বিশ্বের প্রায় পুরোটাই এ সিস্টেম ব্যবহার করে লেনদেন করে।
ইউয়ানে লেনদেন করতে বাংলাদেশ সুইফটের বদলে চীনা নেটওয়ার্ক ক্রস বর্ডার ইন্টার-ব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম (সিআইপিএস) ব্যবহার করবে। যদিও ইউয়ান আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে আইএমএফের (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) স্বীকৃতি রয়েছে। বাংলাদেশ চাইলে সুইফটের মাধ্যমে ইউয়ান ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু চীনের আগ্রহে সিআইপিএস ব্যবহার করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
এজন সম্প্রতি লেনদেনের চুক্তি ও ব্যাংক হিসাব খুলতে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সফর করেছে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল। প্রক্রিয়া শেষ করে দ্রুত ব্যাংক হিসাব খুলবে বাংলাদেশ। অন্যদিকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যুক্ত হতে বাংলাদেশে শাখা খুলবে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। সেই আলোচনায়ও বেশ অগ্রগতি হয়েছে।
প্রভাব কমবে যুক্তরাষ্ট্রের
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের ১১টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি লেনদেন করতে ব্যাংক হিসাব রয়েছে। এগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক, ব্যাংক অব ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইতালি ও ফ্র্রান্স।
এখন ১২তম দেশ হবে চীন। এসব দেশে থাকা ব্যাংক হিসাবে মূলত রিজার্ভ রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রিজার্ভ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে। আর্থিক খাতে যুক্ত হলে বাংলাদেশের রিজার্ভের অর্থের একটি অংশ রাখা হবে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। ডলারের পর রিজার্ভের সবচেয়ে বড় অংশ রাখা হয়েছে স্বর্ণে। বাংলাদেশ চাইলে খুব সহজেই রিজার্ভে থাকা স্বর্ণের অংশ চীনে রাখতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, চীনের পরিকল্পনায় যোগ দিলে বাংলাদেশে ভবিষ্যতে চীনা বিনিয়োগ ও ঋণ আরো বাড়বে। তখন চীনা সহযোগিতায় বাস্তবায়িত হওয়া সব প্রকল্পের হিসাব ইউয়ানে হবে। ইউয়ানের মাধ্যমেই অন্যান্য দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করতে বাধ্য হবে বাংলাদেশ। এসব প্রকল্পের দেওয়া বিনিয়োগের বিপরীতে নিরাপত্তা চাইবে চীন। তখন বাধ্য হয়ে বাংলাদেশকে রিজার্ভের অর্থ জামানত হিসেবে রাখতে হবে চীনের কাছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাইরে গিয়ে ডলারের বিকল্প মুদ্রায় লেনদেন করার জন্য চীন-রাশিয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে; তা আরো বেগবান হবে বাংলাদেশের মাধ্যমে। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমবে। যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্কট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (এইআই) এক হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত চীন থেকে বাংলাদেশে মোট বিনিয়োগ এসেছে ৭ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন বা ৭০৭ কোটি ডলারের বেশি।
অন্যদিকে চীনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা বাংলাদেশের নির্মাণকাজের ঠিকাদারি নিয়ে রেখেছে প্রায় ২৩ বিলিয়ন বা দুই হাজার ৩০০ কোটি ডলারের, স্থানীয় মুদ্রায় যা দুই লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। বিশাল এ অংকের লেনদেন আগামীতে ইউয়ানে হতে পারে বা চীনের মাধ্যমে হতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় চীন যে দেশের সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে, তাদের গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়েছে। প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমার সর্বশেষ উদাহরণ। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হয়ে সফল হলে চীন সামরিক চুক্তিতে যায়। এর সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে মালদ্বীপ। গণতন্ত্রহীনতার পথে ইতোমধ্যে নাম লিখিয়েছে ক্ষমতাসীন সরকার। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশে এখনো গণতান্ত্রিক বোধ ও অনুসারী টিকে আছে। চীন এখানে সফল হলে সবচেয়ে বড় হুমকিতে পড়বে প্রতিবেশী দেশ ভারত। প্রতিবেশী এ দেশটিতে গণতন্ত্র থাকায় অভ্যন্তরীণ বহুমুখী সমস্যা এখনো সামাল দিতে পারছে। তারপরও স্বৈরতান্ত্রিক বিজেপি সরকারের কারণে দেশটির সেভেন সিস্টার নামে খ্যাত সাতটি রাজ্য হুমকির মধ্যে রয়েছে।
এ পাতার অন্যান্য খবর
- খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনে বাড়ছে পেটে গ্যাস
- আবার পরিবর্তন আসবে হয়তো!
- ২৯ পণ্যের সরকারি মূল্য মানছে না ব্যবসায়ীরা
- ভারত থেকে আমদানি কমেছে
- ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করতে হবে---হামিদুর রহমান আযাদ
- আমাদেরকে ইসলামী আদর্শের দিকেই ফিরে আসতে হবে----মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন
- মানুষ ঠিকমতো মাহে রমাদানও পালন করতে পারছে না--ছাত্রশিবির সভাপতি
- সীমান্তে ২ জনের হতাহতের ঘটনা প্রমাণ করে স্বাধীনতা চরম সংকটে : মির্জা ফখরুল
- ঈদের আগেই উদ্ধারের আশা মালিকপক্ষের
- হজ, ওমরা এবং ট্রাভেল ব্যবসায়ীদের নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ