একটি পারিবারিক বৈঠকের কিছু কথা

প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী
সম্প্রতি একটি পারিবারিক বৈঠকে আমার কিছু কথা বলার সুযোগ হয়। আখিরাতে ধ্বংস ও ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায় হলো ঈমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে পরস্পরে হকের নছিয়ত ও ধৈর্যধারণের উৎসাহ দানে নিজেকে সম্পৃক্ত করা। আমি চেষ্টা করি এমন সুযোগকে কাজে লাগাতে। নববধূসহ আমরা দু’টি পরিবার একত্রে বসেছিলাম এবং বৈকালিক আপ্যায়ন শেষে নবুবধূর সাথে পরিচয় ও পারিবারিক জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি আনয়নে আমাদের করণীয় বিষয়ে কিছু কথাবার্তা হয়। যেহেতু এর মধ্যে কিছু নছিয়ত রয়েছে তাই আমার ফেসবুক বন্ধুদের সাথে একটু শেয়ার করতে চাই।

এভাবে বসাটাকে আমি খুবই ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি এবং আমাদের উচিৎ মাসিক বা সাপ্তাহিক নিয়ম করে বসা যাতে পরিবারে সৌহার্দ-সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়। সবাইকে উদ্দেশ্য করে আমি বলি যে, প্রতিটি পরিবারকে নিয়ে একটি মিনি পার্লামেন্ট এবং এই পার্লামেন্টের স্পিকার হলেন পরিবারের কর্তা পিতা ও ডেপুটি স্পিকার হলেন পরিবারের কর্ত্রী মাতা, যেখানে সকল কাজ সম্পন্ন হবে পরামর্শক্রমে। ইসলাম পরামর্শভিত্তিক কাজ করার উপর খুবই গুরুত্ব প্রদান করে। যেখানে একাধিক ব্যক্তির স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতা রয়েছে সেখানেই পরামর্শ। মু’মিনের চরিত্রবৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে যেয়ে আল্লাহ বলেন-‘তারা তাদের সামগ্রিক ব্যাপারসমূহ পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন করে’। মু’মিন ডিক্টেটর বা স্বৈরাচার হয় না। স্বামী তার স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে এবং ছেলে-মেয়ে বড় হলে তাদেরকেও পরামর্শে শরীক করে। বংশীয় বিষয় হলে বংশের নেতৃস্থানীয়দের সাথে পরামর্শ করে। যেখানে পরামর্শ আছে সেখানে ভুল-বুঝাবুঝি থাকে না এবং সেই পরিবারে শান্তি ও স্বস্তি বজায় থাকে।

ইসলামে বিবাহিত জীবনকে অত্যন্ত মর্যাদা দান করা হয়েছে। বিবাহবহির্ভূত অনৈতিক জীবন (নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা) অত্যন্ত ঘৃণ্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিবাহিত জীবনে রয়েছে শান্তি-স্বস্তি-নিরাপত্তা ও ছাওয়াব। এই পরিবারে নববধু হিসেবে মিমের আগমনকে আমরা স্বাগত জানাই। পিতা-মাতা ও আপন জন এবং একটি পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে সম্পূর্ণ নতুন একটি পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়ায়ে নেয়াটা একটু কঠিনই বলা যায়। সবার পক্ষ থেকে সহযোগিতা দিয়ে নতুনকে বরণ করে নেয়াই হলো জগতের নিয়ম। আমরা মনে করি এরই মধ্যে মিম সে সহযোগিতা পেয়েছে। একজন নারীর স্বার্থকতা এই যে, সে তার আচার-আচরণ দিয়ে কত দ্রুত সবার মন জয় করতে পারে। আত্মীয়তা দু’ধরনের-এক. রক্ত সম্পর্কীয় ও দুই. বৈবাহিক সম্পর্ক। বিয়ের মাধ্যমে শুধু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কই নয়, সেই সাথে শ্বশুর-শাশুড়ী, ননদ, শ্যালক-শ্যালিকাসহ অনেক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। আমাদের ধর্মে আত্মীয়তার বন্ধনকে খুব বড় করে দেখা হয়। হাদিসের ভাষায়-‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে যাবে না’। আত্মীয়তার হক এ নয় যে, কেউ ভালো ব্যবহার করলে পাল্টা তার সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে। বরং কেউ সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাইলে তা জুড়ে দেয়া হলো আত্মীয়তার হক। আত্মীয়তার সম্পর্ককে সুদৃঢ় করার জন্য আমাদের উচিৎ শ্বশুরবাড়ির কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি চোখে পড়লে তা বাবা-মা’র বাড়িতে না বলা। এতে উভয় পরিবারে ভুল-বুঝাবুঝি সৃষ্টি হয়। সংসারে শান্তি-স্বস্তির মূলে রয়েছে উদার দৃষ্টিভঙ্গি। আল্লাহর বাণী-‘যে স্বীয় মনের সংকীর্ণতা থেকে নিজেকে রক্ষা করলো সেই প্রকৃত কল্যাণ লাভ করলো’। একজন উদারমনা ব্যক্তি অপরের ত্রুটি-বিচ্যুতি সহজেই উপেক্ষা করতে পারে। আর এই উপেক্ষা করার মধ্যেই রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ। রাসূল (সা.) বলেন-‘যে অপরের দোষ-ত্রুটি গোপন করে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটি গোপন করবেন এবং যে অপরের অপরাধ ক্ষমা করে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার অপরাধ ক্ষমা করবেন’। আমরা সবাই পরকালের যাত্রী। তাই আমাদের উচিৎ পরকালের পাথেয় সংগ্রহের আশায় উদার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণের মাধ্যমে সবারই ছোট-খাট ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা। ভুল হওয়া মানুষের প্রকৃতি, আবার ভুল স্বীকার করা ও অপরের ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করাও মানবপ্রকৃতি। অপরের ত্রুটি-বিচ্যুতি তালাশ করা ও গোপন বিষয় খুঁজে বেড়ানো খুবই নিন্দনীয় এবং আল্লাহপাক সূরা হুজরাতে স্পষ্টভাবে নিষেধ করেছেন। সংসারে চলতে গেলে মনোমালিন্য, কথাকাটাকাটি ও রাগ-অভিমান হতেই পারে; কিন্তু সেটা বাড়তে দেয়া ঠিক নয়। এমন পরিস্থিতি যদি কখনও উদ্ভব হয়েই পড়ে তবে মু’মিন তিন দিনের বেশি পরস্পরে কথা বন্ধ করে থাকতে পারে না এবং এমতাবস্থায় যে আগে কথা বলে সে প্রভূত ছাওয়াবের অধিকারী হন। সম্পর্কটা পুনস্থাপন এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এ লক্ষ্যে কেউ মিথ্যার আশ্রয় নিলে তা আর মিথ্যা হয় না, বরং তা হয় ছওয়াবের। তাই আমাদের সবারই চেষ্টা থাকবে সংসারে সুখ-সমৃদ্ধি-স্বস্তি আনয়নে উদারতার পরিচয় দেয়ার।

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মনিব ও দাসের নয়। কেউ কারো প্রভু বা ভৃত্য নয়। সম্পর্কটা হলো বন্ধু ও সাথীর। কুরআনের ভাষায়-‘ঈমানদার নর ও নারী পরস্পরের বন্ধু ও সাথী, তারা ভালো কাজে আদেশ করে ও মন্দ কাজে নিষেধ করে’। অবশ্য শৃঙ্খলা বিধানের স্বার্থে আল্লাহপাক পুরুষকে কর্তৃত্বশীল করেছেন এবং ঈমানদার নারী স্বামীর আনুগত্যপরায়ণ হয়ে থাকে। আমি প্রায়ই বলে থাকি যে, গৃহরূপ রাষ্ট্রে স্বামী হলেন রাষ্ট্রপ্রধান এবং স্ত্রী হলেন তাঁর অধীন প্রধানমন্ত্রী যেখানে সবাই তাঁকে মান্য করে চলেন।

আল্লাহপাক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটাকে পরস্পরের পরিচ্ছদ বলে উল্লেখ করেছেন। এখানে কোন গোপনীয়তা নেই এবং এই জায়গাটি হলো পরস্পরের আস্থা ও বিশ্বাসের। সবকিছু সেখানে শেয়ার করা যায়। আমাদের সমাজে এমন অনেকে আছেন যারা একে অপরকে আড়াল করে চলতে চায়। যেমন স্বামী তার মা’র জন্য দেড় হাজার টাকা দিয়ে শাড়ি কিনে এনে স্ত্রীকে শোনায় ৮০০/- টাকা হয়েছে। আসলে এ সব গোপন থাকে না। মিথ্যার আশ্রয় নেয়ার ফলে পরস্পরে সন্দেহ-অবিশ্বাস দেখা দেয় যা দাম্পত্যজীবনকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ডেল কার্নেগী কত চমৎকারভাবেই না বলেছেন-‘গৃহজীবনে সুখি হতে চান, তাহলে একে অপরকে অবিশ্বাস করবেন না, আর ঘ্যানর ঘ্যানর করবেন না’। অসুখী দম্পতি জীবনে বেঁচে থাকার আনন্দই হারিয়ে ফেলে। পক্ষান্তরে সুখী দম্পতি পাহাড় পরিমাণ সমস্যা সহজেই মোকাবেলা করতে পারে। স্ত্রী যদি তার স্বামীর আয় জানে এবং এটাও জানে যে তার স্বামীর কোন অবৈধ উপার্জন নেই তাহলে স্ত্রী অল্পতেই তুষ্ট থাকবে এবং এমতাবস্থায় স্ত্রী আর ঈদে ৫,০০০/- টাকা দামে শাড়ি কেনার জন্য বায়না ধরবে না।

ভোগ নয় ত্যাগেই আনন্দ। মানুষ মানুষের জন্য। আমরা প্রত্যেকেই পরের তরে। কথাগুলোর মধ্যে সত্যতা রয়েছে এবং পরকালে বিশ্বাসীদের জন্য আরো বেশি মূল্যবহন করে। কারণ এ দুনিয়ায় যা কিছু সে ছাড় দেয় বা ত্যাগস্বীকার করে তা কখনই নষ্ট হয় না, মহান আল্লাহ তা বহুগুণ বাড়িয়ে ফেরৎ দেবেন। এই ত্যাগস্বীকার আবার নিকটবর্তীদের জন্য আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নিজের পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, ভাই-বোন ও নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনের প্রতি দায়িত্ব পালন অর্থই হলো ত্যাগস্বীকার। দাম্পত্যজীবনে সুখ-শান্তি-স্বস্তি একান্তভাবে নির্ভর করে পরস্পরের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও ত্যাগ স্বীকারের ওপর। আমরা আমাদের উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে Gift of the Magi-এ জিম ও ডেলার কাহিনী পড়েছি। উভয়ের মধ্যে পরস্পরের প্রতি প্রেম-ভালোবাসা লেখক অতি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। তারা দরিদ্র ছিল, কিন্তু অসুখী ছিল না। ডেলার ছিল আকর্ষণীয় লম্বা চুল ও জিমের ছিল হাতঘড়ি যা উভয়ের কাছে ছিল খুবই পছন্দনীয়। বিয়ে বার্ষিকীতে তারা চেয়েছিল পরস্পরকে কিছু Gift দিতে। জিম ইচ্ছা করেছিল তার স্ত্রীর জন্য একটি ভালো চিরুণী কিনতে ও ডেলা চেয়েছিল তার স্বামীর জন্য ঘড়ির একটি চেইন কিনতে। কিন্তু কেনার মতো তাদের হাতে কোন অর্থ ছিল না। শেষে ইচ্ছা পূরণের জন্য জিম তার ঘড়ি বিক্রি করে একটি চিরুণী কিনে ও ডেলা তার লম্বা চুল বিক্রি করে কিনে একটি চেইন এবং উভয়েই যখন তাদের উপহারসামগ্রী নিয়ে বাড়ি ফেরেন, তখন দেখেন যে, তাদের উপহারসামগ্রী আর কোন কাজে আসছে না। কিন্তু তা হলে কী হবে? তারা যে পরস্পরের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে পেরেছে, সেটাই তাদেরকে তৃপ্ত করেছে। তাই উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও ত্যাগের মনোবৃত্তি একটি পরিবারকে অস্বচ্ছলতার মাঝেও সুখী করতে পারে। প্রতিটি গৃহ হোক শান্তির নীড় এবং সকল পরিবারে সুখ-শান্তি ও আনন্দে ভরে উঠুক-পরম করুণাময়ের কাছে এটাই আমাদের বিনীত প্রার্থনা। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর পথে চলাটা সহজ করে দিন। আমিন।

অধ্যক্ষ, সিফাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল।