সংবাদ শিরোনামঃ

আন্তর্জাতিক চাপে সরকার ** গুমের সঙ্গে এই সরকার জড়িত ** যেমন কর্ম তেমন ফল ** শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে ** উৎপাদন খরচ কমলেও বাড়লো বিদ্যুতের দাম ** গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক : বিএনপি ** প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নজিরবিহীন বিক্ষোভ, উত্তাল মালয়েশিয়া ** দেশ আতঙ্কিত অথচ সরকার বলছে শান্তিপূর্ণ ** রাষ্ট্র ও সরকারকে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে ** অনুভূতির সাগরে কুরআনের দেশে ** গুম দিবসও গুম হয়ে গেলো! ** ছোটদের বন্ধু নজরুল ** বন্যায় সারাদেশে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি অপর্যাপ্ত সরকারি সাহায্য ** রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির কর্মীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা ** যশোরের শার্শায় বাণিজ্যিকভাবে বেদানা চাষ **

ঢাকা, শুক্রবার, ২০ ভাদ্র ১৪২২, ১৯ জিলকদ ১৪৩৬, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫

মতিউর রহমান আকন্দ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

শিয়াবে আবু তালেব

ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে নবী করিম (সা.) ও তার পরিবার এবং নিকটাত্মীয়দের বন্দীজীবনের স্মৃতিবাহী শিয়াবে আবু তালেব। কুরাইশ ও কাফের মুশরিকদের জুলুম-নির্যাতনের চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে তারা নবী করিম (সা.)-কে পরিবার পরিজনসহ বয়কটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ইসলামের দুশমনেরা ইসলামকে নির্মূল করার জন্য কত কঠোর, নিষ্ঠুর ও অমানবিক হতে পারে তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে শিয়াবে আবু তালেবে বন্দী জীবনের নির্মম দিনগুলো।

মীনা থেকে সামান্য দূরে পবিত্র কাবার পথে ‘শিয়াবে আবু তালেব’ এর অবস্থান। চতুর্দিকে পাহাড় বেষ্টিত এ স্থানটি সোয়া চৌদ্দশত বছর পূর্বে রাসূল (সা.)-এর বন্দী জীবনের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর আগে যতবার মক্কায় এসেছি ততবার রাসূল (সা.)-এর বন্দী জীবনের স্মৃতিময় এ স্থানটি কোথায় তা জানার ও দেখার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু সম্ভব হয়নি। কতগুলো ইট পাথরের গাঁথুনি দিয়ে তৈরি ওয়াল বিশিষ্ট এ স্থানটুকু চোখে দেখা বা না দেখার মধ্যে এবাদতের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু এ স্থানটির সাথে চেতনা, আবেগ ও অনুভূতির সম্পর্ক রয়েছে। এই আবেগ এও অনুভূতি ইসলামী আন্দোলনের পথে নিজেকে আরো মজবুত ঈমানের সাথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করে। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব নবী করিম (সা.)-এর প্রতি দুশমনদের এই আচরণ থেকে নিজেকেও অনুরূপ পরিবেশ মোকাবেলা করার এক শক্তিশালী চেতনার জাগ্রত হই এই উপত্যকায় বন্দী জীবনের দৃশ্যগুলোর কথা স্মরণে এনে। তাই এই স্থানটি দেখার জন্য ও নিজের অনুভূতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য পেরেশান ছিলাম। এবার ওমরাহ্ পালনকালে স্বপরিবারে তা দেখার এবং শিয়াবে আবু তালেবের ভেতরে প্রবেশ করে সেখানকার ধুলো নিজের শরীরে মেখে নেয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি।

৬ বছরের শিশু মুয়াজসহ আজ যখন আমরা ‘পরিবারের সদস্যগণ’ শিয়াবে আবু তালেবের ভিতরে প্রবেশ করছিলাম তখন মনে হচ্ছিল নবী করিম (সা.)-এর সাথে বনু হাশেম গোত্রের অনেক শিশু দীর্ঘ ৩ বছর পর্যন্ত এখানে আটক জীবন-যাপন করেছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে শিশুদের কান্না, হাহাকার এবং মায়াময় চাহনি, কাফের, মুশরিকদের মনে সামান্যতম দয়ার উদ্রেক করতে পারেনি।

শিয়াবে আবু তালেব হচ্ছে অনেকগুলো পাহাড়ের মাঝখানে একটি গিরি উপত্যকা। বর্তমানে সৌদি সরকার মীনা ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকার পাহাড়গুলো কেটে প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণ করায় অনায়াসেই ‘শিয়াবে আবু তালেব’ যেখানে রাসূল (সা.) তিন বছরের অধিককাল বন্দী জীবন যাপন করেছেন তা সহজেই চোখে পড়ে।

‘মীনা’ জিয়ারত শেষে আমাদের গাইড আসাদ ভাই এ ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শনে আমাদেরকে সেখানে নিয়ে গেলেন। আমরা হেঁটে হেঁটে শিয়াবে আবু তালেবে পৌঁছলাম। চার দেয়াল বেষ্টিত পাথরের তৈরি একটি গৃহসহ চিহ্নিত স্থানটিই ‘শিয়াবে আবু তালেব’।

এ স্থানটির সাথে রাসূল (সা.)-এর বন্দী জীবনের স্মৃতিবাহী মুহূর্তগুলোর কথা বার বার হৃদয়পটে ভেসে উঠছিল। তখন নবুওয়াতের ৭ম বর্ষ। মহররম মাস। কুরাইশগণ যখন দেখতে পেলো যে তাদের হাজারো প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ইসলাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে, হজরত হামযা (রা.), হজরত ওমর (রা.) ইলামের সুশীতল পতাকাতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছে, নাজ্জাশীর নিরাপদ আশ্রয়ে মুসলমানগণ শান্তিতে বসবাস করছে এবং তাদের দূতগণ নিরাশ হয়ে ফিরে এসেছে, সর্বোপরি মুসলমানদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে, তখন তারা মুসলমানদের অগ্রগতি রোধ করার জন্য সকলে একত্র হয়ে পরামর্শ করলো যে, মুসলমানদের জব্দ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে তাদের সাথে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করা। কোন ধরনের সহযোগিতা না করা। মক্কার সবগোত্র ঐক্যবদ্ধ হয়ে বনু হাশেম গোত্রকে বয়কট করার চুক্তি সম্পাদন করলো। চুক্তিতে স্থির করা হলো যে, বনু হাশেম যতক্ষণ মুহাম্মদ (সা.)-কে আমাদের হাতে সমর্পণ না করবে এবং তাকে হত্যা করার অধিকার না দেবে, ততক্ষণ কেউ তাদের সাথে কোনো আত্মীয়তা রাখবে না, বিয়ে-শাদীর সম্পর্ক স্থাপন করবে না, লেনদেন ও মেলামেশা করবে না এবং কোনো খাদ্য ও পানীয় দ্রব্য তাদের কাছে পৌঁছাতে দেবে না।

আবু তালেবের সাথে একাধিকবার কথাবার্তার পরও আবু তালেব রাসূল (সা.)-কে নিজের অভিভাবকত্ব থেকে বের করতে প্রস্তুত হননি। আর তার কারণে বনু হাশেমও তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে পারেনি। এই কারণে হতাশ হয়ে তারা ঐ চুক্তি সম্পাদন করে। চুক্তিপত্র লেখা হলে কাবাগৃহে তা টানিয়ে দেয়া হয়। এ চুক্তিনামার লেখক ছিল মানসুর ইবনে ইকরামা। পরবর্তীতে তার হাত অবশ হয়ে গিয়েছিল।

কাফের-মুশরিকদের এ সিদ্ধান্তটি ছিল একটি কঠোর সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তের ফলে বনু মোত্তালিবের মুসলিম-অমুসলিম, নারী-পুরুষ-শিশু সবাই শিয়াবে আবু তালেব নামক এ স্থানটিতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। বয়কটের ফলে খাদ্যসামগ্রীর আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। যে সব খাদ্যসামগ্রী মক্কায় আসতো মুশরিকরা তাড়াতাড়ি সেগুলো কিনে নিতো। ফলে অবরুদ্ধ মুসলিম অমুসলিম কারও কাছে স্বাভাবিক উপায়ে খাবার পৌঁছাতো না। তারা গাছের পাতা এবং চামড়া খেয়ে জীবন ধারণ করতেন। ক্ষুধা এত মারাত্মক ছিল যে, ক্ষুধার্ত নারী ও শিশুর কাতর কান্না ‘শিয়াবে আবু তালেব’-এর বাইরে থেকে শোনা যেতো। এ মর্মভেদী কান্নার আওয়াজ শুনে কুরাইশরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতো। আরোপিত এ বয়কটের ফলে নবী করিম (সা.) ও সমগ্র বনু হাশেম গোত্রের সাথে যে অমানবিক, অসহিষ্ণু ও মানবতা বিরোধী আচরণ করা হয়েছে তা যুগযুগ ধরে কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে।

আমরা শিশু মুয়াজ ও মুসআবসহ যখন এ উপত্যকায় প্রবেশ করলাম তখন বয়কটকালীন ভয়াবহ চিত্রের কথা হৃদয়পটে ভেসে উঠছিল। আল্লাহর দ্বীনের জন্য, ইসলামের সুমহান আদর্শ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে রাসূল (সা.)-এর উপর কাফের মুশরিকদের এ নিপীড়ন যুগ যুগ ধরে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের আবেগ আপ্লুত করবে, অনুপ্রাণিত করবে। নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে আপোষহীনভাবে নিজেকে প্রস্তুত করার চেতনা ও প্রেরণা জোগাবে।

শিয়াবে আবু তালেবের সেই দেয়াল, ইট-পাথর গাঁথা গৃহে প্রবেশ করে আমরা যেন দেখতে পেলাম কাফের মুশরিকদের সৃষ্ট সে বিভীষিকাময় দৃশ্য। প্রায় ৩ বছরের অধিককাল স্থায়ী এ বয়কট এমন জোরদার ছিল যে, একবার হজরত খাদিজার ভাতিজা হাফীস বিন হিসাম তার ভৃত্যকে দিয়ে সামান্য পরিমাণ আটা হজরত খাদিজা (রা.)-এর নিকট পৌঁছালেন। পথিমধ্যে আবু জেহেল তা দেখে কেড়ে নিতে চাইল। ঠিক এ সময় আবুল বুখতারি উপস্থিত হলো। তার মধ্যে একটু মানবিক সহানুভূতি জেগে উঠলো। সে আবু জেহেলকে বলল, ‘এক ব্যক্তি নিজ ফুফুকে কিছু খাবার পাঠাচ্ছে, তুমি কেন তাতে বাধা দাও? তাকে খাদ্য নিয়ে যেতে দাও।’ আবু জেহেল তার কথা মোটেই গ্রাহ্য করলো না।

তদানীন্তন আরব ভূখণ্ডে যিনি সবচেয়ে ধনী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, শুধুমাত্র ইসলামী আন্দোলনের কারণে সেই খাদিজা (রা.)-কেও ক্ষুধার যন্ত্রণায় এ গিরি পর্বতে কষ্টকর জীবন যাপন করতে হয়েছে।

এ সঙ্কটময় মুহূর্তে আবু তালেব সবসময় রাসূল (সা.)-কে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। রাতে সবাই শুয়ে পড়ার পর তিনি ভ্রাতুস্পুত্রকে বলতেন, যাও তুমি এবার তোমার বিছানায় শুয়ে পড়ো। তিনি একথা এজন্যই বলতেন যাতে কোন গোপন আততায়ী থাকলে বুঝতে পারে যে তিনি কোথায় শয়ন করছেন। এরপর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আবু তালেব তাঁর প্রিয় ভ্রাতুস্পুত্রের শোয়ার স্থান বদলে দিতেন। ভ্রাতুষ্পুত্রের বিছানায় নিজের পুত্র, ভাই বা অন্য কাউকে শয়ন করাতেন। রাত্রিকালে প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে তিনি উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাতেন। আবু তালেবের এ ভূমিকা ও রাসূল (সা.)-এর প্রতি তার আচরণ সমগ্র উম্মতে মুহাম্মদীর হৃদয়ে তরঙ্গায়িত হতে থাকবে।

এ অবস্থায় পুরো তিন বছর কেটে যায়। এরপর নবুওয়তের দশম বর্ষে মহররম মাসে চুক্তি ছিন্ন করার ঘটনা ঘটে। কুরাইশদের মধ্যকার কিছু লোক এ ধরনের অবরোধ ব্যবস্থার বিরোধী থাকায় তারা অবরোধ বাতিল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

অমানবিক অবরোধ সম্পর্কিত প্রণীত দলিল বিনষ্ট করার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বনু আমের ইবনে লুয়াই গোত্রের হেশাম ইবনে আমের নামক এক ব্যক্তি। হেশাম রাত্রিকালে চুপিসারে খাদ্যদ্রব্য পাঠিয়ে আবু তালেব ঘাঁটির অসহায় লোকদের সাহায্য করতেন। প্রথমে হেশাম যুহাইর ইবনে আবু উমাইয়া মাখযুমির কাছে যান। যুহাইয়ের মা আতেকা ছিলেন আব্দুল মোত্তালেবের কন্যা অর্থাৎ আবু তালেবের বোন। হেশাম তাকে বললেন, যুহাইর তুমি কি চাও যে, তোমরা পানাহার করবে অথচ তোমার মামা এবং অন্যরা ধুকে ধুকে মারা যাবে? তারা কি অবস্থানে রয়েছে সেটা কি তুমি জান না? যুহাইর বললেন, আমি একা কি করতে পারি? যদি আমার সাথে আরো কেউ এগিয়ে আসে তবে আমি সে দলিল বিনষ্ট করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি।

হেশাম বললেন, অন্য একজন রয়েছেন। যুহাইর জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কে? হেশাম বললেন, আমি। যুহাইর বললেন, আচ্ছা তবে তৃতীয় কাউকে খুঁজে বের কর। একথা শোনার পর হেশাম মুতয়াম ইবনে আদীর কাছে গেলেন এবং বনু হাশেম এবং বনু মোত্তালেবের দুরাবস্থার কথা উল্লেখ করে তার সাহায্য চাইলেন। ওরা যে তার নিকটাত্মীয় সে কথাও বললেন। মুতয়াম বললেন, আমি একা কি করতে পারি? হেশাম বললেন, আরো একজন আছেন। মুতয়াম জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কে? হেশাম বললেন, আমি। মুতয়াম বললেন, আচ্ছা তৃতীয় একজন লোক খুঁজে নাও। হেশাম বললেন, সেটাও করেছি। মুতয়াম বললেন, তিনি কে?  হেশাম বললেন, যুহাইর ইবনে উমাইয়া। মুতয়াম বললেন, ‘আচ্ছা চতুর্থ একজন তালাশ কর।’

এরপর হেশাম আবুল বাখতারির কাছে গেলেন এবং তার সাথেও মুতয়ামের কাছে যেভাবে বলেছেন সেভাবে কথা বললেন। আবুল বাখতারি জানতে চাইলেন এ ব্যাপারে সমর্থক কেউ আছে কিনা। হেশাম বললেন, হ্যাঁ আছে। এর পর তিনি যুহাইর ইবনে আবু উমাইয়া মুতয়াম ইবনে আদী-এর কাছে নিজের কথা জানালেন। আবুল বাখতারি বললেন, আচ্ছা, তবে বিশ্বস্ত একজন লোক খোঁজ করো। এরপর হেশাম জাময়া বিন আসওয়াদের সাথে কথা বললেন।

এর পর উল্লেখিত সবাই ‘হাজুন’ নামক জায়গায় একত্রিক হয়ে দলিল বিনষ্ট করার ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন। যুহাইর বললেন, প্রথমে আমি কথা তুলবো। সেই ঘোর দুর্দিনে এ কয়জন ব্যক্তির এ উদ্যোগ ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

সকাল বেলা নিয়মানুযায়ী সবাই মজলিসে একত্রিত হলো। যুহাইর দামী পোশাক পরে সেজেগুজে উপস্থিত হলেন। যুহাইর সাতবার কাবাঘর তাওয়াফ করে সবাইকে সম্বোধন করে বললেন, ‘মক্কাবাসীরা শোনো, আমরা পানাহার করবো, পোশাক পরিধান করবো আর বনু হাশেম ধ্বংস হয়ে যাবে! তাদের কাছে কিছু বিক্রি করা হচ্ছে না, তাদের নিকট থেকেও কেনা হচ্ছে না। খোদার কসম এ ধরনের অমানবিক দলিল বিদ্যমান থাকা অবস্থায় আমি নীরব থাকতে পারি না। আমি চাই এ দলিল বিনষ্ট করে ফেলা হোক।’

আবু জেহেল একথা শুনে বলল, ‘তুমি মিথ্যা বলছো। খোদার কসম এ দলিল ছিন্ন করা যাবে না।’ জাময়া ইবনে আসওয়াদ আবু জেহেলকে জবাব দিল ‘আল্লাহর কসম, তুমিই সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী। এ চুক্তি যেভাবে লেখা হয়েছে আমরা তা পছন্দ করি না।’

আবুল বাখতারি বলে উঠলো, ‘জাময়া ঠিকই বলেছে। এ চুক্তি আমাদের পছন্দ নয় এবং আমরা তা মানি না।’ মুতয়ামও সমর্থন করে বললো ‘তোমরা দুজন ঠিকই বলেছ। এর বিপরীত যে বলে সে মিথ্যা বলে।’

এভাবে অধিকাংশ লোক বলতে থাকায় আবু জেহেল মুখ কাচুমাচু করে বসে রইল। সে সময় আবু তালেবও অদূরে উপস্থিত ছিলেন। রাসূল (সা.) তাকে জানিয়েছিলেন, ‘চাচাজান, আল্লাহ তায়ালা কুরাইশদের চুক্তিপত্রকে কীট দ্বারা বিনষ্ট করে দিয়েছেন। তাতে আল্লাহর নাম ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। জুলুম, উৎপীড়ন ও আত্মীয়তার বন্ধন ছেদন সংক্রান্ত শর্তগুলো তা হতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।’ আবু তালেব বললেন, ‘তোমার প্রতিপালক কি সে সম্বন্ধে তোমাকে অবহিত করেছেন?’ রাসূল (সা.) বললেন, ‘হ্যা’। আবু তালেব বললেন, ‘তবে তোমার উপর কেউ আধিপত্য লাভ করতে পারবে না।’

যখন চুক্তিপত্র সম্পর্কে কাবা প্রাঙ্গনে কথাবার্তা চলছিল তখন আবু তালেব সেখানে গিয়ে বললেন, ‘কুরাইশগণ! আমার ভ্রাতুস্পুত্র বলেছে যে, তোমাদের চুক্তিপত্রটি আল্লাহ তায়ালা একধরনের পোকা পাঠিয়ে নষ্ট করে দিয়েছেন, শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার নামটুকু সেখানে অবশিষ্ট রয়েছে। যদি একথা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয় তাহলে আমি তার ও তোমাদের মাঝ থেকে সরে দাঁড়াব এবং তোমরা যা ইচ্ছা করতে পারবে। আর যদি সত্য বলে প্রমাণিত হয় তাহলে বয়কটের মাধ্যমে আমাদের প্রতি যে অন্যায় আচরণ করছ তা থেকে বিরত হও।’ এ বিষয়ে কুরাঈশরা সম্মত হলো।

এ নিয়ে আবু জেহেল ও অন্যান্যদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক শেষ হলে মুতয়াম বিন আদী চুক্তিপত্র ছিঁড়তে গিয়ে দেখলো সত্য সত্য আল্লাহর নাম লেখা অংশ বাদে বাকি অংশ পোকায় খেয়ে ফেলেছে। এরপর অঙ্গীকারপত্র ছিঁড়ে ফেলা হলে বয়কটের অবসান হলো এবং রাসূল (সা.) ও অন্য সকলে ‘শিয়াবে আবু তালেব’ থেকে বেরিয়ে এলেন। রাসূল (সা.)-এর ৩ বছরের বন্দী জীবনের অবসান ঘটলো।

কাফেররা এ বিস্ময়কর নিদর্শনে আশ্চর্য হলো। কিন্তু তাদের মনোভাবের কোন পরিবর্তন হলো না। কুরাইশরা এ নির্দশন থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিল এবং কুফরীর পথে আরো কয়েক কদম অগ্রসর হলো। মানবতার শ্রেষ্ঠ বন্ধু নবী করিম (সা.) মুক্ত পরিবেশে ফিরে আসলেন ঠিকই কিন্তু কাফের মুশরিকদের প্রতিবন্ধকতা পূর্বের চাইতে কঠোর থেকে কঠোরতর হলো।  (বুখারী, সীরাতে ইবনে হিশাম)

জাবালে নূর

কাবা শরীফ থেকে ৭/৮ কি.মি. দূরে অবস্থিত জাবালে নূর। এটি পবিত্র কাবার পূর্ব-উত্তর দিকে। মানব জাতির মুক্তির দিশারী, পথপ্রদর্শক মহাগ্রন্থ আল-কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিল এ পাহাড়ে অবস্থিত হেরা গুহায়। এ ঐতিহাসিক ‘হেরা’ গুহাটি পাহাড়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে অবস্থিত। প্রতি বছর একমাস নবী করিম (সা.) এ হেরা গুহায় নির্জনে কাটাতেন। জাহেলিয়াতের যুগে কুরাইশরাও একইভাবে মূর্তিপুজা বাদ দিয়ে নিভৃত তপস্যায় মগ্ন হতো। নবী করিম (সা.)-এর বয়স যখন ৪০ বছর তখন তিনি নির্জনে একমাস সময় কাটানোর জন্য হেরাগুহায় অবস্থান করছিলেন। সেটি ছিল রমজান মাস। রাসূল (সা.) বলেন, ‘আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। এ অবস্থায় জিব্রাঈল একখণ্ড রেশমি কাপড় নিয়ে আবির্ভূত হলেন। ঐ রেশমি বস্ত্রখণ্ডে কিছু লেখা ছিল। জিব্রাঈল আমাকে বললেন ‘পড়–ন’। আমি বললাম, ‘আমি পড়তে পারি না’। তখন তিনি আমাকে এমন জোরে আলিঙ্গন করলেন যে আমি ভাবলাম মরে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘পড়–ন’। আমি বললাম, ‘আমি পড়তে পারি না’। তিনি পুনরায় আমাকে সজোরে আলিঙ্গন করলেন। এবারও চাপের প্রচণ্ডতায় আমার মৃত্যুর আশঙ্কা হলো। আবার তিনি ছেড়ে দিলেন এবং বললেন, ‘পড়–ন’। আমি বললাম ‘কি পড়ব?’ তিনি বললেন, ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকা...’। অর্থাৎ ‘পড়–ন আপনার সেই প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পড়–ন আর আপনার প্রভু সদাশয় অতি। তিনিই কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষকে সেইসব শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানতো না।’

রাসূল (সা.) বললেন, অতঃপর আমি শুনানো আয়াত কয়টি পড়লাম। এই পর্যন্ত পড়িয়েই জিব্রাঈল থামলেন এবং তারপর চলে গেলেন। এরপর আমি ঘুম থেকে উঠলাম। মনে হলো যেন আমি আমার মানসপটে কিছু লিখে নিয়েছি।

এর পর আমি হেরাগুহা থেকে বেরিয়ে এলাম। পর্বতের মধ্যবর্তী এক স্থানে পৌঁছে হঠাৎ উপর থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম। ‘হে মুহাম্মদ! আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আমি জিব্রাঈল।’ আমি উপরে আসমানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম জিব্রাঈল একজন মানুষের আকৃতিতে আকাশের দূর দিগন্তে ডানা দুখানা ছড়িয়ে দিয়ে আছেন এবং বলছেন ‘হে মুহাম্মদ! আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আমি জিব্রাঈল।’ আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আকাশের অন্যান্য প্রান্তে তাকিয়ে দেখি সর্বত্রই তিনি একই আকৃতিতে বিরাজমান। এইরূপ নিশ্চলভাবে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি পিছনে সরতে বা সামনে এগোতে সক্ষম হচ্ছিলাম না।   (চলবে)

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।