সংবাদ শিরোনামঃ

গণদাবি : লতিফ সিদ্দিকীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ** লতিফ সিদ্দিকীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে ** শিগগিরই এক দফার আন্দোলনে যাচ্ছে ২০ দল ** অর্থনৈতিক সঙ্কট ঘোচাতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করতে হবে ** কঠিন পরিস্থিতির মুখে ওবামা ** অবিলম্বে জঙ্গি ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে : ছাত্রশিবির ** সঙ্কট সৃষ্টির জন্য বিরোধী দল নয় আওয়ামী লীগই যথেষ্ট ** সার্ককে আরো কার্যকর করুন, জনগণের প্রত্যাশা দারিদ্র্যমুক্ত শান্তিপূর্ণ দক্ষিণ এশিয়া ** জামায়াতের অগ্রযাত্রায় দিশেহারা সরকার ** পলক ফেরে না যেখানে ** অধ্যাপক গোলাম আযম : যিনি আমার শিক্ষক ** বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় মুসলিম উম্মাহর প্রয়োজন নিরপেক্ষ মিডিয়া ** ভারতীয় ভিসার ই-টোকেন দালাল চক্রের হাতে ** বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো মিনি ক্যান্টনমেন্টে পরিণত হয়েছে **

ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪২১, ৪ সফর ১৪৩৬, ২৮ নভেম্বর ২০১৪

ফজলুল কাদির
ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাস করে তখন সবেমাত্র উত্তরবঙ্গের The taj of the east (প্রস্পেক্টাসে লেখা থাকতো কলেজের ভর্তি ফরমের উপর) বলে খ্যাত রংপুর কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হয়েছি। জি এল হোস্টেলে থেকে পড়ি। The taj of the east  à¦¬à¦²à¦¾à¦Ÿà¦¾ যে মিথ্যে নয় তিনশ’ একর জমির ওপর তখনকার তাজহাটের মহারাজার প্রতিষ্ঠিত অপরূপ নয়নাভিরাম স্থাপত্য শিল্প ও তার বিশালত্ব দেখে আভিভূত যে কেউ তা স্বীকার না করে পারবেন না। পরর্তীতে সামনে কত জায়গা থাকতেও বেশ কয়েক বছর পরে শিল্পবোধ জ্ঞানবিবর্জিত কাঠখোট্টা অধ্যক্ষের অবিবেচনাপ্রসূত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মূল ভবনের কাছাকাছি আধুনিক কলাভবন নির্মাণের কারণে এর অনুপম সৌন্দর্য আজ চিরতরে তিরোহিত।

আরো একটা বিষয় বলে রাখি, সে সময়কার কলেজের শিক্ষকমণ্ডলী ছিলেন গোটা বাংলার (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান ও পশ্চিমবঙ্গ) স্বনামখ্যাত অধ্যাপকগণ। এমন কলেজে যারা ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়ে গর্বিত মফঃস্বল স্কুল থেকে সদ্য আসা আমাদের অবাক অবাক ভাব দেখে তারা বলতেই পারেন, দেখ! দেখ! ওদের গা থেকে এখনও স্কুলের গল্প যায়নি। যা-ই হোক, সায়েন্সে ভর্তি হলেও যারা বায়োলজি পড়তে চাইতো না, তাদেরকে বায়োলজির পরিবর্তে অলটারনেটিভ সাবজেক্ট হিসেবে পলিটিক্যাল সায়েন্স বা ইকোনোমিক্স নিতে পারতো। অন্য অনেকের মতো আমিও পলিটিক্যাল সায়েন্স নিলাম।  ইংরেজি-বাংলা তো ছিলই। কোন সাবজেক্ট কে পড়াবেন তা নিয়েও আমাদের মধ্যে কৌতূহল ছিল। পলিটিক্যাল সায়েন্সের বিরাট এক ক্লাসরুমে গিয়ে বসলাম। পাশের এক সতীর্থকে কে পড়াবেন জিজ্ঞেস করতেই বললো, জানেন না বুঝি, প্রফেসর গোলাম à¦†à¦¯à¦®Ñ à¦†à¦¯à¦® স্যার। এই নাম প্রথম শুনলাম তাঁর। পাশের ছেলেরা বলাবলি করছিল, ভয়ঙ্কর কড়া স্যার। স্যার তো নয়, বাঘ।

পড়ানোটাও কি বাঘের গর্জনের মতোই হবে? ভুলই বুঝি করলাম। পলিটিক্যাল সায়েন্সটা না নিয়ে ইকোনোমিক্স নিতেও পারতাম। ভাবনাটা শেষ হতে না হতেই ক্লাসে এসে ঢুকলেন à¦¸à§à¦¯à¦¾à¦°Ñ à¦†à¦®à¦¾à¦° দেখা প্রথম অধ্যাপক গোলাম à¦†à¦¯à¦®Ñ à¦†à¦¯à¦® স্যার। লম্বা- একটু হালকা-পাতলাই ছিলেন তখন। সেরওয়ানী ও পাজামা পরা। মাথায় জিন্নাত ক্যাপ। জিন্নাহ ক্যাপ তখন অনেকেই পরতেন। টকটকে ফর্সা রং। লম্বাটে মুখ-উন্নত নাসিকা। বাম হাতে আমাদের এ্যাটেনডান্স রেজিস্টার। তবে প্রথমেই তার ভাবলেশহীন গুরুগম্ভীর মুখ দেখে আমার অন্তরাত্মা আরো একবার কেঁপে উঠল।

আমার সমস্ত ভুল ভেঙ্গে দিয়ে সেই গাম্ভীর্যের ধূসর মেঘ সরে গেল তাঁর মুখ থেকে স্মিত হাসির রেখা তখন তাঁর ঠোঁটে। ‘সেটেল ডাউন প্লিজ’ বলে চেয়ারে গিয়ে বসলেন। এ্যাটেনডান্স রেজিস্টার খুলে নাম ধরে ডেকে ডেকে প্রেজেন্ট এ্যাবসেন্ট চিহ্নিত করছেন। যথারীতি দাঁড়িয়ে ‘ইয়েস স্যার’ বলে বসলাম। টিক মার্ক দিলেন। পেছন থেকে এক ছেলে তার ডাক আসতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, Make me present sir’ এবার নিশ্চয়ই স্যার ধমক দেবেন à¦›à§‡à¦²à§‡à¦Ÿà¦¾à¦•à§‡Ñ à¦à¦®à¦¨à¦­à¦¾à¦¬à§‡ বলা এটা বেয়াদবির শামিল! অবাক হলাম, বরং উল্টোটাই হলো। তিনিও হাসতে হাসতে বললেন, You have been marked present  à¦°à§‹à¦²à¦•à¦² শেষ হলে লেকচারের প্লাটফরম থেকে নেমে এসে দাঁড়িয়ে পড়াতে শুরু করলেন। তখন শুধু বাংলা ছাড়া সায়েন্স বা আর্টসের সব বিষয় ইংরেজির মাধ্যমেই পড়ানো হতো। এখন নাকি ইংরেজি বাংলায় পড়ানো হয় মানে ইংরেজি পড়ে তার বাংলা অর্থ বলে দেয়া হয়। আমার এখনও মনে হয়,  পলিটিক্যাল সায়েন্সের মতো এমন একটা নীরস সাবজেক্ট হেসে হেসে তিনি পড়াতেন কি করে? মনে হতো এমন হাসি অন্তর থেকে উৎসারিত স্নেহসিক্ত অমলিন হাসি। এ হাসিতে মনের ভয়-সংশয় সব যেন দূর হয়ে যায়। আন্তরিকতায় আপন করে নেয়ার এক এক অদৃশ্য চুম্বক শক্তি বোধ হয় তাঁর মাঝে কাজ করতো। এ একেবারে কাছে টেনে নেয়ার মতো!

পড়ানোর সময় অন্য স্যারের ক্লাসে পেছনের বেঞ্চে বসে নিচু স্বরে অনেক ছাত্রই গুজ গুজ করে গল্প করতো। কিন্তু আযম স্যারের সময় কারো কোনো টুঁ শব্দটি করার জো ছিল না।

আমাদের ইংরেজি পড়াতেন অভিজ্ঞ পৌঢ় শিক্ষক প্রফেসর এইচ আর লাহিরী। পড়াতেন ভালো। কিন্তু হলে কি হবে? তাঁর গৎবাধা উচ্চারণে ইংরেজি পড়ানোটা অন্যের কাছে কেমন লাগতো জানি না, কিন্তু আমার কাছে একঘেঁয়ে লাগতো। কিন্তু গোলাম আযম স্যার পড়াতেন অন্য এক চমৎকার স্টাইলে। পুনরাবৃত্তি ঘটতো না কোনো কথার। কখনও বা দ্রুতলয়ে, আবার কখনও বা অতি ধীরলয়ে গাঢ় à¦¸à§à¦¬à¦°à§‡Ñ à¦¸à§‡à¦Ÿà¦¾ বিষয়বস্তুর গুরুত্বের ওপর এ্যমফ্যাসিস তথা জোর দিয়ে। বুঝে উঠতে এতটুকু বেগ পেতে হতো না কাউকে। রাশভারী পণ্ডিতের পড়ানো বিষয়বস্তু বুঝতে ধাক্কা খেতে হয় না বারবার। পড়ানো শেষ হলে মনে হতো আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন সৌম্য-শান্ত-বিদগ্ধ জ্ঞানী এক পুরুষ! হাসিটা তাঁর ঠোঁট থেকে তখনও মিলিয়ে যায়নি। জ্ঞানের কতটুকু তাঁর কাছ থেকে আমরা নিতে পারলাম বা নিতে পারলাম à¦¨à¦¾Ñ à¦ নিয়ে তাঁর সামনে তখন আমরা সবাই প্রশ্নবোধক!

কিন্তু তাঁর স্মিত হাসিটি ক্লাস থেকে বেরুতে না বেরুতেই উধাও। আবার সেই আগের মতোই গম্ভীর। অন্য সময়ে এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে প্রশস্ত বারান্দা দিয়ে যাওয়ার পথে দেখি অন্য ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা (তখন ছাত্রীর সংখ্যা ছিল স্বল্প) সবাই বারান্দার দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমবারের মতো একজনকে জিজ্ঞেস করতেই একজন বলে উঠল, জানেন না বুঝি, গোলাম আযম স্যার তাঁর ক্লাস থেকে এখন বেরিয়ে আসবেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দেখি, স্যার ক্লাস থেকে বের হচ্ছেন। দু’পাশের ছাত্রছাত্রীরা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কেউ সালাম দিচ্ছে। মাথা একটু নুইয়ে সালামের জবাব দিতে দিতে না থেমেই চলে যাচ্ছেন। তাঁকে সালাম দেব কি করে? তাঁর দিকে হাততুলতেই সাহস হচ্ছিল না। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল কোনো অনুষ্ঠানের প্রধান বা বিশেষ অতিথি হিসেবে। তাঁকে যেন সংবর্ধনা জানাচ্ছি আমরা। আমার মনে হতো স্যার এসব খুব একটা আমলে নিতেন না। সোজা গিয়ে ঢুকতেন টিচার্স কমন রুমে।

এমনটি কিন্তু অন্য কোনো স্যারের বেলায় ঘটতো না বরং অন্য স্যারেরা চলার পথে মাঝে মাঝে ছাত্রদের গায়ে হাত দিয়ে একটু সরিয়ে কমনরুমে যেতেন।

ক্লাসে যাওয়ার সময় টিচার্স কমনরুমের দিকে নজর পড়তো। দেখি তাঁকে ঘিরে সব অধ্যাপকই আলোচনায় মেতে উঠেছেন। আসরের মধ্যমণি তিনি!

আরো পরে তাঁর পরিচয় আমার কাছে বিধৃত হলো ক্রমশ। সেটা পরে জেনেছি। সেটা ছিল তাঁর ছাত্র জীবনের গৌরবময় কৃতিত্বপূর্ণ পরিচয়- তাঁর Extra curricular activities। ঢাকা ভার্সিটিতে তিনি দু’বার ছাত্র সংসদের সেক্রেটারি জেনারেল হয়েছিলেন নেতৃত্বে অসাধারণ যোগ্যতার কারণেই। অসাধারণ বাগ্মীও ছিলেন তিনি।

১৯৫২ সাল। তখন চলছিল বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রাণের দাবি ও দুর্বার আন্দোলন। সে আন্দোলনের স্ফূলি       ঙ্গ ছড়িয়ে গেলো তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের আনাচে-কানাচে সবখানে। রাষ্ট্র ভাষার এ অভূতপূর্ব আন্দোলণ ছাত্র-জনতাকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছিল।

১৯৫২ সালের মাঝামাঝি। কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আমি তখন। বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে রংপুর কারমাইকেল কলেজের, যেহেতু তখন অন্য কোনো কলেজ ছিল না, ছাত্রদের নগ্নপদে সেদিন ছিল প্রথম মিছিল। সে মিছিলে নগ্নপদ আমিও। চলমান মিছিলের পাশেই দাঁড়িয়ে পুলিশরা থ্রি নট থ্রি রাইফেলে গুলি ভরছিল। আমরা যেমন ছিলাম উত্তেজিত, তেমনি ছিলাম শঙ্কিত। রংপুরের ইতিহাসে বাংলা ভাষা আন্দোলনে রংপুর কারমাইকেল কলেজ ছিল পথিকৃৎ।

একদিন ক্লাসে গিয়ে জানলাম, স্যার এখন আর ক্লাস আসবেন না। জেলে তিনি। জেলে? পাশের সহপাঠী বলল, জানিসনে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার পক্ষে বক্তৃতা দেয়ায় তাঁকে এ্যারেস্ট করে জেলে নিয়ে গেছে এবং সেই সঙ্গে বাংলার অধ্যাপক জমির উদ্দীন স্যারকেও। তাকাতেই বলল, গোলাম আযম স্যারের বক্তৃতা তো শুনিসনি তুই! শুনলে বুঝতি! রাষ্ট্রভাষা নিয়ে এমন সাহসী বক্তৃতা আমি অন্য কারো মুখে শুনিনি। তাঁর মুখ থেকে কথা à¦¨à§ŸÑ à¦¯à§‡à¦¨ আগুনের ফুলকি ঝরছে। শেষে বলল, তা না হলে তাঁকে এ্যারেস্ট করবে কেন?

মাস দেড়েক কি দুয়েক শেষে জেল থেকে ফিরে এলেন স্যার দু’জন। দেখলাম জমির স্যার মোটা হয়েছেন একটু। আর গোলাম আযম স্যার আগের চাইতে আরও শুকিয়ে গেছেন। জেলের ভাত কারো সহ্য à¦¹à§ŸÑ à¦•à¦¾à¦°à§‹ হয় না।

এখানে গোলাম আযম স্যারের দীপ্যমান শিক্ষক জীবনের অনন্য এক ঘটনার কথা উল্লেখ না করলে তাঁর মতো একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে জানা, আমার ধারণায়, এক রকম অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। স্মৃতি সব সময় মধুর ও সুখকর হয়। স্মৃতি আবার লোমহর্ষক ও ভয়ঙ্করও হতে পারে এবং সে স্মৃতি ভয়ঙ্কর শক্ত আঁচড় কেটে যায়, যা কোনোদিন কোনোক্রমে কখনও মুছে ফেলা যায় না মন থেকে।

একজন শিক্ষক, শুধু একজন শিক্ষক হিসেবেই স্যার যে কতটা ভয়লেশহীন ও অকুতোভয় ছিলেন, অন্যায়ের কাছে কোনো শর্তেই কোনোক্রমেই নতজানু হননি, জীবন-মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে জেনেশুনে অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি কখনও, তার ছাত্র হিসেবে সেই অচিন্তনীয় ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী ও চাক্ষুস সাক্ষী আমি। তাঁর সেই অনুকরণীয় ও অভাবনীয় একক দৃষ্টান্ত আগে বা পরে আজ পর্যন্ত কারো মধ্যে দেখিনি। ছাত্রজীবনে স্কুল ও কলেজের অনেক শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে পেয়েছি সৎ ও আদর্শ হিসেবে। কিন্তু তাঁর মতো শিক্ষক হিসেবে দুর্জয় অসম সাহসিকতার বাস্তব দৃষ্টান্ত আর দ্বিতীয়টি জানা নেই।

এ অভাবনীয় ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আজও আমার গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের অন্যতম ডিরেক্টর সহকর্মী মোফাজ্জল হোসেন খান সাহেবকে ঘটনাটি বলেছিলাম। তিনি হতবাক না হয়ে পারেননি।

তখন ১৯৫৩ সাল। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে (তখন অন্য কোনো শিক্ষাবোর্ড ছিল না) আমাদের ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা চলছিল। আমার পরীক্ষার সিট পড়েছিল কলেজের সেই বিরাট হল ঘরটায়। যারা দেখেছেন, তারাই হল ঘরটার বিশালত্বটা বুঝতে পারবেন। হল ঘরটার চারদিকে প্রবেশ পথে উঁচু বুলন্দ দরজাগুলো এক হাত দিয়ে একা কোনো দপ্তরি খুলতে পারতো না। একজনকেই শুধু একদিকে একটামাত্র দরজার পাল্লা দু’হাত দিয়ে  সজোরে ঠেলে ঠেলে খুলতে বা বন্ধ করতে হতো।

যাক সে কথা! হলঘরে যথারীতি পরীক্ষা চলছে। সে হলের ইনভেজিলেটর ছিলেন গোলাম আযম ও আর একজন স্যার। দশ-পনেরো মিনিট পর পর গোলাম আযম স্যার গোটা হলঘরটাই একবার করে ঘুরে ঘুরে দেখে আসছেন। একবার হঠাৎ যেন সচকিত হয়ে উঠলেন তিনি! আরও একবার এসে ঘুরে গেলেন তিনি। আমরা, আশেপাশে যারা বসেছি, সবাই দেখছিলাম, একজন বিহারী পরীক্ষার্থী হলে বই খুলে দেদারসে নকল করে যাচ্ছিল। স্যার এবার তার কাছে সোজা এসে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন “Are you taking unfairrness?” ছেলেটি জবাব : I am to pass’ sir. আর নকল করতে নিষেধ করে তিনি তার কাছ থেকে নকলগুলো চাইলেন। ছেলেটি ছিল মোটাসোটা কালো ভীমাকৃতি দশাসই চেহারার। পেশাবহুল বক্সিং করা দুর্দান্ত এক বলিষ্ঠ শরীর তার। আমরা জানতাম তার এ বেপরোয়া ভাবের জন্যেই ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও তাকে ভয় করে চলতো।

ছেলেটা হঠাৎ এক কাণ্ড করে বসলে! প্যান্টের পকেট থেকে ভোজালির মতো ইস্পাতের ছোরাটি বের করে সেটা ডেক্সের ওপর সাজোরে গেড়ে দিল। চকচকে ছোরাটি কাঠে অনেকখানি বসে গিয়ে একটু একটু করে তখনও কাঁপছিল। স্যার ওসবের দিকে দেখে একটুও তোয়াক্কা না করে টান দিয়ে নকলসহ তার খাতাটি কেড়ে নিয়ে নিলেন। ছেলেটি তখন মরিয়া! ওই ছোরাটি ডেক্স থেকে একটান মেরে তুলে নিয়ে স্যারের ঠিক পিঠ বরাবর সোজা তাক করে বীভৎস এক খুনীর মতো তাঁর পেছনে পেছনে বড় বড় পা ফেলে থপথপ করে যেতে লাগলো। মুহূর্তের মধ্যেই হয়তো ছোরাটি পিঠ ভেদে করে আমূল বিদ্ধ হয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাবে। ঘটে যাবে এক নৃশংস অপ্রতিরোধ্য এক হত্যাকাণ্ড যা আমাদের কাছে একেবারে অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয়। আমি, সত্যি বলতে কি এর চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারছিলাম না।

আরও যেটা আমাদের হতভম্ভ করলো, সেটা হলো এত কিছু যে ঘটে গেল, স্যার তা গ্রাহ্যের মধ্যে আনলেন না, পেছন ফেরে সেদিকে একবারও তিনি তাকালেন না পর্যন্ত। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে সোজা গিয়ে বসলেন তাঁর চেয়ারে। বসে তাৎক্ষণিকভাবে কাজটিও করলেন। ইংরেজিতে ছেলেটির Explulsion লিখে হলের সবাইকে তা পড়ে শুনিয়ে দিলেন এবং সেই সঙ্গে হল থেকে Terminate ও করে দিলেন। কণ্ঠস্বর একটু কাঁপল না à¦¤à¦¾à¦à¦°Ñ à¦•à¦¾à¦à¦ªà¦² শুধু আমাদের অন্তর। সর্বসমক্ষে এত বড় যে সাংঘাতিক কাণ্ডটা ঘটে গেল, তা তার মুখ দেখে বোঝবার সামান্যতম উপায়ও নেই। অবাক হই ভেবে যে, এত কিছুর পরেও ছেলেটির বিরুদ্ধে Attempt to Murder-এর কোনো কেইস বা জিডিও করলেন না তিনি।

আগেই বলেছি, শিক্ষা জীবনে অনেক নীতিবান, সৎ, আদর্শ শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের কাছে পাঠ নিয়েছি। নীতিকেই আঁকড়ে ধরে আজীবন অনড় ছিলেন তাঁরা। তাঁদেরকে নীতিচ্যুত বা স্বার্থান্ধ হতে কখনও দেখিনি। কিন্তু জীবন-মৃত্যুর এমন সন্ধিক্ষণে, সঙ্কটের এমন কঠিন মুহূর্তে অটল ও অবিচল দৃঢ়তা, আপসহীন অকল্পনীয়  দুঃসাহসের এমন সর্বোত্তম পরাকাষ্ঠা আমি কারো মধ্যে দেখিনি।

ছেলেটি ভেবেছিল, স্যার হাত খাতাটা ফেরত দেবেন। শেষ পর্যন্ত যখন কিছুই হলো না এবং তার ভবিষ্যৎ শিক্ষা জীবনের ইতির কথা ভাবতেই তার অন্তরাত্মা নিশ্চয়ই কেঁপে উঠেছিল। ছেলেটি তখনও স্যারের সামনে ছোরা হাতে দাঁড়িয়ে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় সে। কিন্তু যাঁর মৃত্যুর ভয়-ডর নেই, তাঁকে মারতে চাইলেই তো মারা যায় à¦¨à¦¾Ñ à¦†à¦° মারাটা হয়তো সহজও নয়।

আত্মোপলব্ধিতে সেদিন যা হৃদয়াঙ্গম করলাম, মারণাস্ত্র হাতে ভীষণ মারমুখী হয়েও ছেলেটি এমন অপূর্ব (অপূর্বই বলবো আমি) সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তার চাইতে কমজোর একেবারে নিরস্ত্র এক অসম সাহসীর সামনে এক সশস্ত্র অকুতোভয় প্রতিশোধস্পৃহা বলদৃপ্তের এমন অবিশ্বাস্য নিদারুণ পরাজয় চোখের সামনে নির্বাক হয়ে দেখলাম। অকপট সরল সত্যের সামনে মিথ্যার, আদর্শের সামনে অনাদর্শের ও তরবারির চাইতে তীক্ষè শাণিত বিবেকের সামনে হিংস্র প্রতিশোধের ্মনে করুণ অসহায় আত্মসমর্পণ আর কখনও আমি দেখিনি।

আর কোনো উপায় না দেখে এক বুক হতাশা নিয়ে ছেলেটি বিধ্বস্ত পরাজিত এক সৈনিকের মতো মাথা হেঁট করে হল থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো।

পাঠককুল মাফ করবেন। একটু তুলনা করেই বলি। আজকাল কী হচ্ছে? পরীক্ষায় অসদুপায়ের কোনো প্রতিবাদ করতে বা বাধা দিতে গেলে কী হচ্ছে তার পরিণতি? পিতৃসম শিক্ষাদাতা তাঁরই সন্তানসম ছাত্রের হাতে নিগৃহীত হচ্ছেন। শুধু মারধরেই শেষ নয়, শিক্ষককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে পর্যন্ত! আবার স্বয়ং অভিভাবক ও ছাত্রটির শিক্ষকই তার অসদুপায় অবলম্বনে নির্লজ্জ সহযোগিতা করছেন।

মাতৃসমা সম্মানিতা শিক্ষিকা তাদেরই ছাত্রদের কাছে লাঞ্ছিত হচ্ছেন। এতেই যদি শেষ হতো, তাহলে অতোটা  দুঃখ হতো না। সেই মাতৃসমা শিক্ষিকা তাঁর পুত্রসম বেশরম ছাত্রদের দ্বারা ধর্ষিতা হচ্ছেন! এর চেয়ে জাতির কাছে লজ্জার বিষয় আর কী হতে পারে?

একটু ভাবুন তো! অবক্ষয়ের আর কত নিচে আর কত তলদেশে নামলে এটা সম্ভব হতে পারে? আর কত নিম্নগামী হতে পারি আমরা? আসলে আমরা কি বিবেক ও মনের সৎ সাহসের প্রায় সবটাই হারিয়ে ফেলেছি?

ছাত্র জীবনের ইতি টানার পর কর্মজীবনে প্রবেশ। নাহ্ এর মধ্যে স্যারের সঙ্গে দেখা আর হয়নি। দেখা-সাক্ষাৎ যা হয়েছে তা পত্র-পত্রিকার মাধ্যমেই। ঢাকা থাকাকালীন পাকিস্তান শাসনামলে পল্টনের ঈদের বিশাল জামায়াতে তাঁকে দু’ দু’বার ইমামতি করার ছবি দেখেছি পত্রিকায়। ইমাম মানে তো নেতা! সেদিক থেকে এক সময় নেতাও ছিলেন তিনি। সাম্প্রতিই জেনেছি, কুরআনের তাফসিরসহ তিনি প্রায় ষাটটির মতো গ্রন্থ-বই লিখে রেখে গেছেন।

তবে একটি ঘটনা এক সময় আমাকে খুব আলোড়িত করেছিল। সেটা মাঝে মাঝে আমার মনকে  আজও নাড়া দেয়। ঘটনার দিক থেকে যেমন এটি ব্যতিক্রম, তেমনি দেশের প্রচলিত রাজনীতির নিয়ম-নীতি ভঙ্গকারী অচিন্তিতপূর্ব এক ঐতিহাসিক বিরল ঘটনাও বটে। এর মূল্যবোধকে অবমূল্যায়ন বা খাটো করে দেখবার কারো কোনো অবকাশ নেই। দেশের দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির’ নেত্রী দু’জনেই নির্বাচনের আগে একবার দোয়া নিতে গিয়েছিলেন গোলাম আযম স্যারের কাছে। দোয়াও তিনি à¦•à¦°à§‡à¦›à¦¿à¦²à§‡à¦¨Ñ à¦®à§à¦– ফিরিয়ে নেননি।

এর পরের খবর তো পাঠককুলের অজানা নয়। এসবের অন্যতম পাঠক আমিও।

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।