সংবাদ শিরোনামঃ

গাজায় ইসরাইলি হামলা : বিপন্ন মানবতা ** ঈদের পর আন্দোলন ** ঈদবাজারের সিংহভাগই বিদেশী পণ্যের দখলে ** দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও দেশ গড়তে হলে রোজার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করতে হবে : মাওলানা আব্দুল হালিম ** রাজনীতিতে বদ্ধ ও গুমোট অবস্থা বিরাজ করছে ** ঈদের আনন্দ সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে ** এ যেন সেই ‘ভাতে মারবো, পানিতে মারবো’র মতো ব্যাপার-স্যাপার! ** সারাদেশে বিভিন্ন সংগঠনের ইফতার মাহফিল ** ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভ ** ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য ** সেকালের ঈদ **

ঢাকা, শুক্রবার, ১০ শ্রাবণ ১৪২১, ২৬ রমজান ১৪৩৫, ২৫ জুলাই ২০১৪

সেকালের ঈদ

মনসুর আহমদ

প্রকৃতি জগতে যেমন মনের অলক্ষ্যে ধীর পরিবর্তন ঘটে তেমনি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানেও পরিবর্তন ঘটে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের অতীত আনন্দ স্মৃতি আমরা ধীরে ধীরে ভুলে যাই।

যেমন বর্তমানে আমরা যে নিয়মে সিয়াম পালন করি তা শুরুতে এমন ছিল না। বর্তমান অবস্থা তার সংশোধিত রূপ। আবদুর রহমান ইবনে আবু লায়লা হজরত মুয়ায ইবনে জাবাল থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন’ সিয়ামের উপর দিয়ে তিনটি অবস্থা অতিবাহিত হয়েছে। নবী করীম [স.] মদীনায় উপস্থিত হয়ে প্রথমে প্রত্যেক মাসের তিন দিনের রোজা চালু করেন। আর সেই সাথে চালু করেন আশুরার রোজা। পরে আল্লাহ নাজিল করেন ‘কুতিবা আলাইকুমুস্’- তাত্তাকুন’ আয়াত খানা।

এমনভাবে ঈদ উৎসব পালনের ধরনে কালে কালে বেশ পরিবর্তন এসেছে। আমার শিশুকাল থেকে হাইস্কুল জীবনের শেষ ভাগ পর্যন্ত কেটেছে মায়ের কোলে, চাচী খালাদের সাথে। কাছ থেকে দেখেছি তাদের সিয়াম ও ঈদ উৎসব পালন। বর্তমান ডিজিটাল যুগের পরিবর্তনে অতীত দিে নর সেই চেহারা খুঁজে পাওয়া ভার। তাই বর্তমান কালের যুবা যুবতি, কিশোর কিশোরীদের সে কালের গ্রাম বংলার মা বোনদের ঈদ সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে কিছু ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হলো।

রমজান মাস মুসলমান সমাজের যুবক যুবতি, বুড়া বুড়ি সর্বস্তরের মানুষের জন্য আনন্দের মাস। তবে মা বোনদের জন্য এ মাসের আনন্দের পরিমাণটা একটু বেশি পরিমাণের এবং আনন্দের স্বাদটা কিছু ভিন্ন ধরনের। রমজান শুরু হওয়ার আগেই তাদের মাঝে দেখা দেয় ভিন্ন ধরনের উৎসাহ উদ্দীপনা। সারা মাসব্যাপী ইফতারীর আয়োজনে আর সেহরীর ব্যবস্থাপনায় তারা যে আনন্দ পায় তা তুলনাহীন। ইফতারীর সময় স্বামী-সন্তান সবকে নিয়ে একত্রে বসে পড়ে দোয়া দুরুদ পড়তে থাকে, তখন আল্লাহর রহমতের ঝর্ণা ধারা তাদেরকে সিক্ত করে। সেহরি সেরে যখন পুরুষেরা তারাবিহ পড়তে মসজিদে যায়, তখন মা বোনেরা ব্যস্ত হয়ে ওঠে ধোয়া পালা নিয়ে। তাদের তারাবিহ পড়ার সুযোগ কই? তা ছাড়া সেকালে গ্রাম গঞ্জে কোনো মসজিদে মহিলাদের তারাবিহ পড়ার ব্যবস্থা ছিল না যেমনটি বর্তমান কালে আছে। তবে আমার মা খালা ও ফুফুকে দেখেছি তারা জায়নামাজে বসে বসে তারাবিহ পড়তো। তারা অনেকেই জানতো না যে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া জরুরি।

তারাবি পড়ে যখন পরিবারের সবাই কান্ত শরীর নিয়ে  ঘুমিয়ে যেত, তখন দেখেছি মা-বোনদের জেগে ওঠে সেহরির আয়োজনে ব্যস্ত। সেকালে কম বাড়িতে ঘড়ির ব্যবস্থা ছিল আর মোবাইল তো ছিলই না। তাই লঞ্চ চলার শব্দ ও আকাশের আদম সুরত দেখে সবাইকে জাগিয়ে তোলা হতো। পাড়ার সব বাড়িতে সীমাহীন আনন্দ ছড়িয়ে পড়তো। বেশি লাফালাফিতে মেতে উঠতো শিশু কিশোরেরা। তাদের সামলাতেও গোটা দিনের সমস্ত কান্তি মুছে যেতো তাদের আনন্দের স্নিগ্ধ ধারায়। আনন্দ- উৎসবে সবকে ডুবিয়ে রাখাই ছিল মা বোনদের প্রধান কাজ।

গ্রামেই আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে। তখন দেখেছি, সকালে যখন পুরুষেরা বিছানায় পড়ে অনেকে ঘুমাতো, তখন আমার মা চাচীদেরকে দেখেছি সকাল বেলা উঠে সংসারের কাজ ঘোছাতে লেগে যেতেন। চলতো দুপুর পর্যন্ত। তাঁরা ফজরের পরে দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে কাটাবার সুযোগ পেতেন না। মাকে দেখেছি সারাদিন কাজে ব্যস্ত। এর পরে জোহরের নামাজ আদায় করে মা জায়নামাজে বসে দীর্ঘ সময় কুরআন তিলাওয়াতে কাটাতেন। আমাদের তিলাওয়াতে উৎসাহ দিতেন। এ ব্যবস্থা যে আমাদের বাড়িতেই ছিল তা নয়। পাড়ার প্রায় বাড়িতেই কম বেশি এমন চলতো। আবার দু’এক বাড়িতে মাথা গরম স্বামী নিরীহ স্ত্রী বেচারীর সাথে ঝগড়া করে সময় কাটিয়ে দিত।

ভোর রাতে মা ছোলার ডাল, খেসারী ডাল ভিজিয়ে রাখতেন। চিড়া ভিজাতেন জোহরের পরে। জোহরের পর পর শুরু হতো ডাল, আদা বাটা। বড় মজা হতো ইফতারির সময়। আসরের আগ থেকেই মা চাচীরা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন ইফতারের আইটেম বানাতে। ডালের বড়া, মলিদা বানাবার জন্য আদা বাটা, চাল গুঁড়া করায় ব্যস্ত হয়ে পড়তেন তারা। সাধারণ গৃহস্থের ঘরে ছোলার রেওয়াজ খুব একটা ছিল না। ডিম, আলুর চপ বানাতে তখনও পল্লীর মানুষ শুরু করেনি। মাগরিবের আজান পড়ার সাথে সাথে পানি, মলিদা, চিড়ার সরবত, মুড়ি ও ডাল বড়া দিয়ে ইফতার করাটাই ছিল তাদের কাছে বড় আনন্দের ব্যাপার। যারা মুড়ি বড়া সরবত তৈরি করতে পারতো না তাদের পানি ও মলিদাই ছিল ইফতারির প্রধান উপাদান।

তখনকার দিনে গ্রামে একটা ভালো রেওয়াজ ছিল ‘রোজা খোলান’। প্রায় বাড়িতে এটা হতো। সাধ্যানুযায়ী অনেক লোককে এতে দাওয়াত করা হতো। এসব অনুষ্ঠানে ছোলা, খেজুর ও শরবত পরিবেশন করা হতো। তবে মাগরিব নামাজ শেষে সবাইকে গোশত ও অন্যান্য সালুন দিয়ে পেট পুরে খাওয়ান ছিল রোজা খোলান অনুষ্ঠানের মূল কাজ। এ সব অনুষ্ঠানের দিন মা বোনদের মোটেই অবসর মিলত না। তবে সারদিনের কান্তির পরেও তারা আনন্দে মেতে উঠতো। নানা বাড়িতে এ অনুষ্ঠান বড় করে হতো। এ গ্রাম সে গ্রামে থেকে বৃদ্ধদের দাওয়াত দেয়া হতো বেশি। আমরা ছেলে কিশোররা এসব অনুষ্ঠানে খুব মজা পেতাম। এ সময় হুজুর, মৌলভীদের কদর খুব বেড়ে যেত। আমার বড় ভাই ছিলেন মাওলানা। নওয় মামু ছিল মওলবী। তাদের প্রায় রাতে সন্ধ্যায় রোজা খোলার দাওয়াত ও সেহরিতে মিলাদের দাওয়াতে যেতে হতো। আমার খুব ইচ্ছা হতো যেতে, কিন্তু তখন যে আমি মওলবী নই।

গ্রামের সহজ সরল মা বোনেরা উপলদ্ধি করতে পারতো না যে, রোজার এ শ্বাশ্বত বিধান লোভ, ভোগ ও ইচ্ছা শক্তির উপর বুদ্ধির বিজয়। রিপুর ইচ্ছা শক্তি বুদ্ধিকে স্থায়ী ভাবে হতবুদ্ধি করতে পারে না। সিয়াম সাধনার হুকুম বুদ্ধির দাবি নয়। তবে গভীর ভাবে ল্য করলে প্রতীয়মান হবে যে, সিয়াম ফরজ হওয়ার যুক্তি ঊর্ধ্ব- স্বত্তার মাঝে বান্দাহর আনুগত্যে বুদ্ধিগত আদর্শ বর্তমান রয়েছে। সিয়ামের এ সব তত্ত্বএ সব না বুঝেও মা খালারা অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে রোজা, ইফতারির আয়োজনের ব্যস্ত থেকে আনন্দ পেতো।

এ ভাবে নানা ব্যস্ততায় মা বোনদের সিয়ামের মাস শেষ হতো । পশ্চিম আকাশে দেখা দিত শওয়ালের চাঁদ। আল বেদা, আল বেদা মাহে রমজান। রমজানের এক মাস সিয়াম সাধনার শেষে গ্রামে গঞ্জে বয়ে যেত খুশির মউজ।

ঈদের আর বেশি বাকি নেই। ঈদ আসে মুসলমানের ঘরে ঘরে আনন্দ বিলাতে। পৃথিবীতে মূল্য না দিয়ে যে কিছুই পাওয়া যায় না এবং সে মূল্য যে দুঃখের মূল্য । দুঃখের মূল্য দিয়েই আমাদের ঈদকে কিনতে হবে।

প্রথমেই অলোচনা করা যাক আমার নিজের দেশ বাংলাদেশের ঈদ উপভোগের কথা। বর্তমানে শিল্প বিপ্লবের যুগে ঈদ এলে মা বোনেরা ব্যস্ত হয়ে ওঠে শাড়ী পল্লীতে, টুপি বানাবার কারখানায়, নানা ধরনের শিল্প কারখানায়। সে কালের মা-বোনদের এসব ঝামেলায় জড়াবার সুযোগ ছিল না। তারা পিঠা শিন্নি ও চালের সেমাই বানাতে, ঘর দোর ধোয়া মোছা করতে ব্যস্ত থাকতো।

বর্তমান কালের ঈদ উপভোগের প্রথম প্রধান অনুষঙ্গ ঈদের মার্কেটিং। বাহরী শাড়ি ও ঈদের নানা ধরনের পোশাক সহ ঈদের মার্কেটিং করতে গিয়ে ম্লান হয়ে যাচ্ছে মা বোনদের প্রকৃত ঈদের আনন্দ। বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশে মানুষের ক্রয় মতা বেড়েছে। এ দাবি যে সত্য নয় তা সাধারণ মানুষের চেহারার দিকে তাকালেই অনুমান করা যায়। খাদ্য দ্রব্যসহ বিভিন্ন পণ্য দ্রব্যের দাম এত চড়া যে তা মানুষের হাতের নাগালের বাইরে। দ্রব্য মূল্যের অগ্নি মূল্যে সাধারণ মানুষ জ্বলে পুড়ে ছার খার হচ্ছে। যে কারণে ঈদের আনন্দ গ্রামের মা চাচীদের কাছে আজ বড়ই ম্লান।

ঈদের দিন খুব সকালে ঘরে ঘরে মা চাচীরা জেগে উঠতো আজান শুনে। তখন রেডিও টিভি ছিল না। ছিল না গান বাদ্য ও নাচ গানের এমন জমকালে আনন্দ। তারা মনের সুখে গুড়ের শিন্নি ও মলিদা বানাতো । ফজর শেষে শুরু হতো শিন্নি খাওয়ার ধুম। এ বাড়ি খাওয়া সে বাড়ি খাওয়া, পাড়াময় ঘুড়ে শিন্নি ও চালের সেমাই খাওয়ার সে কী উৎসব! মা বোনেরা সারাদিন ব্যস্ত থাকতো মেহমানদারি নিয়ে। এমন কি ঈদের সাজ গোজের অবসর মিলত না তাদের । আর গরিবদের মাঝে ফেৎরা বিলাবার কাজটা ছিল আমাদের দায়িত্বে।

ঈদের পরের দিন তারা সাধ্যানুযায়ী নতুন শাড়ি ও অলঙ্কারে সেজেগুজে বাপের বাড়ি, কেউ জামাই বাড়ি, কেউ বেয়াই বাড়ি বেড়াতে যেত। সেখানে মুরগীর ছালুন, মাছের ছালুন আবার কেউ কেউ কোর্মা পোলাউর ব্যবস্থা করতো। এ কালের মতো পাঁচ সাত দিন ধরে টিভির গোড়ায় তাদের বসে থাকার সুযোগ ছিল না।

সে কালে গ্রাম বাংলায় রিকশা টমটম এ সবের ব্যবস্থা ছিল না। নৌকাই ছিল একমাত্র ভরসা। ঈদের পর দিন আমার ছোট মামু নৌকা নিয়ে হাজির হতো আমাদেরকে নিতে। আমার মেঝ খালা বাড়ি ছিল আমাদের বাড়ির সাথেই। আমরা খালাতো ভাই বোনেরা মিলে নৌকায় চড়ে যেতাম নানী বাড়ি ঈদ খেতে। নানী আমাদের দিতেন নতুন লুঙ্গি ও জামা। সেকি আনন্দ।

এটাই ছিল সেকালের মোটামুটি গ্রাম বাংলার মা বোনদের ঈদের চিত্র। এভাবেই কাটতো সে কালের গ্রাম বাংলার মা বোনদের ঈদ। তাদের ঈদের আনন্দ ছিল অনাবিল পবিত্র।

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।