সংবাদ শিরোনামঃ

ভারতের নদী হত্যা অব্যাহত ** সরকার দ্রুত নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে ** সারাদেশে জামায়াতের বিক্ষোভ ** মোদি জিতলে ‘হারবে’ ভারত ** ১৮ দল আন্দোলনের ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে ** বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ; বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্য কোনো বিশেষ ধর্ম দায়ী হতে পারে না : সউদী রাষ্ট্রদূত ** বাংলাদেশ সম্প্রীতির দেশ ** পহেলা বৈশাখে ‘ফিলদি রিচ’দের তাণ্ডব! ** বাংলা নববর্ষ ** সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশ কুষ্টিয়াবাসী ** আত্রাইয়ে ইটভাটায় নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি কমে যাচ্ছে উৎপাদন, পরিবেশ হচ্ছে দূষিত ** ক্ষুধার জ্বালায় হনুমানগুলো কাতর **

ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪২১, ১৭ জমাদিউস সানি ১৪৩৫, ১৮ এপ্রিল ২০১৪

বাংলা নববর্ষ

ইকবাল কবীর মোহন
নবচেতনার উদ্দীপনা নিয়ে প্রতিবছর আসে বাংলা নববর্ষ। আসে পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ আমাদের আশা-আকাক্সক্ষা ও চেতনার প্রতীক। পহেলা বৈশাখের হাত ধরে নতুন বছরের যে আগমন ঘটে তা সমগ্র জাতিকে নতুন অঙ্গীকার ও চেতনায় জাগিয়ে তোলে। এদিন জেগে উঠে দেশ, জাগে বাংলাদেশের মানুষ। পুরনো বছরকে বিদায় দিয়ে বৈশাখের প্রথম দিনটিকে আমরা হাসিমুখে বরণ করি। দেশের মানুষ নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিনটিকে পালন করে। আবহমান কাল থেকেই এ দেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করার রেওয়াজ চালু আছে। বৈশাখের এই দিনটিতে গোটা দেশের মানুষ ফিরে পায় নতুন আস্থা ও বিশ্বাস। ফেলে আসা একটি বছরের কমতি ও অপ্রাপ্তিকে দূরে ঠেলে নতুন বছরে এগিয়ে যাবার চেতনা ও প্রত্যয় সবাইকে উজ্জীবিত করে। এ জন্য পহেলা বৈশাখ আমাদের কাছে অনেক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন।

বাংলা নববর্ষের প্রথম দিবসটি সরকারি ছুটির দিন। এদিনে ব্যবসায়ীরা হালখাতা উৎসব পালন করে। পহেলা বৈশাখে দেশের হাজার হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চলে উৎসবের আমেজ। পুরনো হিসাব-নিকাশ গুটিয়ে এদিনে ব্যবসায়ীরা নতুন হিসাব শুরু করেন। এ উপলক্ষে হাট-বাজার, দোকান-পাট ও গদিতে গদিতে মিষ্টিমুখের ধূম পড়ে যায়। নতুন বছরের সুখ ও শান্তি কামনায় অনেকে দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য তারা নতুনভাবে আশাদীপ্ত হন। এখন পুরো বৈশাখ মাস জুড়েই চলে হালখাতার উৎসব। এ সময় সবুজ শ্যামল বাংলার গ্রামে গ্রামে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রাম তখন সীমাহীন আনন্দ উৎসবে মেতে উঠে। গ্রামের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা এ সময় নানা পণ্য ও খেলনার পসরা সাজিয়ে মেলাকে আনন্দ ও উৎসবমুখর করে তুলে। এসব লোকজ মেলায় নিত্য-প্রয়োজনীয় ও সৌখিন পণ্যের পাশাপাশি নানা রকম খেলনাসামগ্রী পাওয়া যায়। গ্রামীণ কুটিরশিল্পে তৈরি এসব খেলনা সাধারণত এই বৈশাখী মেলা ছাড়া বছরের অন্য সময় চোখে পড়ে না। ছোটদের জন্য খেলনা, বেলুন, পোঁ পোঁ বাঁশি, ঝুনঝুনি ইত্যাদি মেলার অন্যতম আকর্ষণ। বিচিত্র খেলনা ও বাঁশির আওয়াজে খুকুমণিরা তখন পুরো গ্রাম মাতিয়ে তোলে। স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কুটিরশিল্প সামগ্রী, কারুপণ্য, হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী গ্রামের মেলাগুলোকে আকর্ষনীয় করে তুলে। বাহারী খাবারের মধ্যে চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা ইত্যাদি ও বিভিন্ন রকমের মিষ্টির সমারোহ দেখা যায় মেলাগুলোতে। নানা রকম খেলা যেমন-নাগরদোলা, ঘুরণচরকি, সার্কাস, পুতুল নাচ, বায়োস্কোপ ইত্যাদি গ্রামের বড়-ছোট সবাইকে আনন্দ দেয়। নববর্ষের মেলায় গ্রামেগঞ্জে আরো নানা অনুষ্ঠান যেমন-নৌকাবাইচ, বলি খেলা, গম্ভীরা, গরুর দৌড়, ঘোড় দৌড়, ঘুড়ি উড়ানো ইত্যাদির আয়োজন করা হয়। তা ছাড়া যাত্রা, পালাগান, জারিগান, কবিগান, গাজীর গানসহ বিভিন্ন ধরনের লোকসঙ্গীত, বাউল, মারফতি, মুর্শিদি ও ভাটিয়ালী ইত্যাদি আঞ্চলিক গান মেলার আকর্ষণকে আরো বাড়িয়ে তোলে। এসব খেলা, গান ও আনন্দ অনুষ্ঠান গ্রামের মানুষকে অনাবিল আনন্দ ও আবেগে উজ্জীবিত করে। গ্রামের সকল বয়সের মানুষ এসব আয়োজনে অংশ নেয়। বলতে গেলে, গ্রামের সকল মানুষ নববর্ষের এসব আনন্দ উপভোগ করার জন্য সারা বছর আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে।

নববর্ষ নিয়ে আমাদের আগ্রহের শেষ নেই। এই নববর্ষের আগমন কিভাবে হলো তা নিয়ে কিছু জানা থাকা ভালো। বাংলা নববর্ষের প্রচলন কিন্তু হঠাৎ করে শুরু হয়নি। এর পেছনে রয়েছে একটি দীর্ঘ ইতিহাস। তবে সংক্ষেপে বলতে গেলে বাংলা সনের শুরু হয় ৯৬৩ হিজরি, ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল থেকে। আরবি হিজরি সালের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা সনের জন্ম।

মোগল স¤à§à¦°à¦¾à¦Ÿ আকবরের রাজত্বকালের আগে এখানে হিজরি সনের প্রচলন ছিল। স¤à§à¦°à¦¾à¦Ÿ আকবর হিজরি বছরকে সৌর বছরে পরিণত করে নতুনভাবে গণনা শুরু করেন। তিনি ফসল বোনা ও খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে এই নতুন সনটি চালু করেন। এই বাংলা সনের উদগাতা ছিলেন আকবরের ‘নওরতন’ সভার সদস্য আমীর ফতেহউল্লাহ সিরাজী। 

পহেলা বৈশাখ আমাদের গ্রামীণ পরিবেশের এক পুরনো ঐতিহ্য হলেও যুগের আবর্তনে এতে এসেছে বেশ পরিবর্তন। ঐতিহ্যবাহী নাগরদোলা, ঘুরণচরকি, সার্কাস, বায়োস্কোপ ইত্যাদির স্থলে এখন যন্ত্র ও বিদ্যুৎচালিত দোলা, চরকির প্রতিস্থাপন হয়েছে। সার্কাসের স্থলে যাদুপ্রদর্শন, টেলিভিশনে নাটক  সিনেমা ইত্যাদি দেখানোর আয়োজন করা হচ্ছে। বলি খেলা, গম্ভীরা, গরুর দৌড়, ঘোড় দৌড়, ঘুড়ি উড়ানো ইত্যাদির প্রচলন কমে গিয়ে অধিকাংশ স্থানে ক্রিকেট, ফুটবল ইত্যাদি খেলার প্রচলন হয়েছে। বাংলা সনের এই দিনে নতুন পোশাক, রঙিন শাড়ি পরিধান করা যেন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। প্রিয়জনকে ফুল উপহার, আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা করা ও অতিথি আপ্যায়ন বাংলা নববর্ষকে নতুন আঙ্গিক দান করেছে।

শহরে নগরে বাংলা নববর্ষ এখন একটি বড় উৎসবের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এদিনে শহরের লোকজন বিশেষ করে ছেলেমেয়েরা নববর্ষের জন্য নানা আঙ্গিকের তৈরি পোশাক পরিধান করে। রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরে সরকার ও নানা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় শোভাযাত্রার। এতে হাজার হাজার মানুষ বিশেষ করে কিশোরকিশোরীগণ অংশগ্রহণ করে। এসব মিছিলের বড় একটি বিষয় হলো নানা রঙের পোস্টার ও বিচিত্র মুখোশ। এই মুখোশগুলো সাধারণত মাছ, কুকুর, বিড়াল, হাতি, সাপ, বাঘ, সিংহ, মহিষ, বানর ইত্যাদি জন্তু জানোয়ারের মুখোচ্ছবির অনুকরণে তৈরি। তা ছাড়া যুবক যুবতীরা অনেকে মুখে ছাই-কালি মেখে অদ্ভুত পোশাকে সজ্জিত হয়ে জঙ্গিরূপ ধারণ করে। নববর্ষে শহরের মানুষের অন্যতম আকর্ষণ পান্তাভাত আর ইলিশ মাছ। বাসায় বাসায়, হোটেল-রেস্তোরা ও পার্ক বা কোনো মাঠে ছামিয়ানা টানিয়ে পান্তা ইলিশের আয়োজন করে অনেক সংগঠন। এদিন পান্তা-ইলিশের নামে অধিক মুনাফা হাতিয়ে নেয় ব্যবসায়ীরা। তারপরও মানুষ এতে বেশ আনন্দ পায়। এদিনে ছেলেমেয়েরা দলবেধে নানা স্থানে ঘুরে বেড়ায়। বিভিন্ন সংগঠন এদিনে আয়োজন করে আলোচনা সভার। পার্ক, রেস্টুরেন্ট ও বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে সেদিন থাকে উপচেপড়া ভীড়।

বলা প্রয়োজন, পহেলা বৈশাখ এদেশের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য আনন্দঘন একটি দিন। এটি খুশির উৎসব, প্রাণের মেলা। নতুন দিনের শপথে আগামীর পথ চলার একটি বিশেষ চেতনার দিন পহেলা বৈশাখ।

অথচ আজকাল এদিনটি উৎসব অনুষ্ঠানের আধিক্য, নীতি-নৈতিকতার বিপরীতে বাড়াবাড়ি, অশ্লীলতা ও নগ্নতায় পর্যবসিত হয়েছে। নববর্ষের উৎসবে একদা হৃদয় আবেগের যে উচ্ছ্বাস ও প্রীতিময় আন্তরিকতা ছিল, তা এখন কৃত্রিমতা ও হৃদয়হীন আচার-অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। নাগরিক সভ্যতার যান্ত্রিক আগ্রাসন, চাকচিক্য ও বাড়াবাড়ি নববর্ষের মূল চেতনাকে উদ্দেশ্যহীন করে তুলেছে। নববর্ষ আমাদের জাতীয় ঐক্য ও ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবির দিন হলেও এখন তা হিন্দি কনসার্ট ও বিজাতীয় আদলে সাজানো এক দিকশূন্য মেলায় পরিণত হয়েছে। এসব ব্যত্যয় ও নীতিভ্রষ্টতা বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতিকে পতনের দিকে পরিচালিত করছে বলে সুশীল সমাজের আশঙ্কা। এ বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। আমরা আশা করি, আমাদের নতুন প্রজন্ম এমন কোন কাজে গা ভাসিয়ে দেবে না, যার কারণে এই জাতির সৌন্দর্য,  রীতি ও ঐতিহ্য হারিয়ে যাবার আশঙ্কা তৈরি হয়। 

বৈশাখ যেমন আনন্দ বয়ে আনে তেমনি বৈশাখের রয়েছে আরেকটি ভয়ঙ্কর রূপ। এ সময় প্রকৃতি রুদ্ররূপ পরিগ্রহ করে। কালবৈশাখীর ঝড় অনেক সময় দেশের জন্য বয়ে আনে সীমাহীন কষ্ট।  ঝড়ের তাণ্ডব দেশের অনেক এলাকায় ধ্বংসলীলা ডেকে আনে। এতে অসংখ্য ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়, অনেক ফসল নষ্ট হয়। মানুষের প্রাণহানির মতো ঘটনা নববর্ষের আনন্দের পরিবেশকে তছনছ করে দেয়। তারপরও নববর্ষ আমাদের জীবনে জাগায় নতুন আশা। জীবনের দীনতা, জড়তা ও গ্লানিবোধ মুছে দিয়ে আমরা লাভ করি একটি আশাদীপ্ত জীবন। বৈশাখের আগমনে আমরা পুরাতন ও জড়াজীর্ণ জীবনকে ঝেড়ে ফেলে একটি সুন্দর জীবনের আশায় উদ্দীপ্ত হই। তাই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বৈশাখকে নতুন সৃষ্টির অগ্রদূত ও সুন্দরের অগ্রপথিক হিসাবে বরণ করেছেন। তিনি এই দিনটিকে তার ‘কালবৈশাখী’ কবিতার মাধ্যম স্বাগত জানানোর জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সুন্দরভাবে বলেছেন,

‘ওরে-তোরা সব জয়ধ্বনি কর

তোরা সব জয়ধ্বনি কর

ওই নতুনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখী ঝড়

তোরা সব জয়ধ্বনি কর।’

আমরা পহেলা বৈশাখকে প্রাণঢালা অভিবাদন জানাই। আমরা চাই, এই বৈশাখ আমাদেরকে নতুনভাবে জাগিয়ে তুলুক। একটি গৌরবান্বিত স্বাধীন জাতি হিসাবে মাথা উচু করে দাঁড়াবার সাহস ও শক্তির উৎস হোক-এই নববর্ষ। পহেলা বৈশাখ হোক প্রেমের গৌরব ও মহত্বের সৌরভে তাৎপর্যময়। নববর্ষ নির্ভিক চিত্তের গৌরবে উদ্ভাসিত হোক -এটাই আমাদের কামনা। বাংলা নববর্ষ তোমাকে জানাই শুভেচ্ছা। শুভ নববর্ষ।

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।